মহড়া
এক
আজ আমাদের থার্ড ইয়ারের সেকেন্ড সেমেস্টার শেষ হল ।
এগজাম হল থেকে বেরিয়ে আমি,
সাহিল, আর্য, দেবদত্ত
আর ইন্দ্রায়ুধ সোজা ক্যান্টিনে ঢুকলাম । তাড়াতাড়ি স্যান্ডুইচ আর কোক নিয়ে আমরা
কোনার টেবিলে গিয়ে বসলাম ।সকাল থেকে তেমন কিছু খাইনি বলে প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল
।আমরা দিল্লি আইআইটির স্টুডেন্ট, যদিও হায়ার সেকেন্ডারি
থেকে আমরা একই স্কুলে সহপাঠী ছিলাম ।
ওরা খেয়ে যে যার হোস্টেলে চলে যাবে
। আজ রাতেই দিল্লি থেকে ট্রেন ধরবে হাওড়া যেতে । আমি আসতে আসতে খাচ্ছি, খুব রিল্যাক্স
লাগছে । এগজাম খারাপ হয়নি ।
“তাহলে সুমেধা তুই থেকে যাচ্ছিস? সাহিল খেতে
খেতে জিজ্ঞেস করল ।
“হ্যাঁ ভাবছি, কাল থেকে টানা
ছুটি ।ইন্টার্নশিপের জন্য হাতে এখনও আট দিন সময় আছে, ভাবছি
কোলকাতায় পাপার কাছ থেকে ঘুরে আসবো- না এখান থেকেই ডাইরেক্ট ইনটার্নশিপে মান্ডি
চলে যাব বুঝতে পারছি না । দেখি পাপা কী বলে ।”
“হোস্টেলে কেউ থাকবে না । তোর ভয় করবে না?” আর্য
বলল ।
“ভয়? কীসের?” আমি
স্যান্ডুইচে কামড় দিয়ে চোখ তুলে বললাম ।
“ভূতের?” দেবদত্ত মাথা নিচু করে একমনে খেতে
খেতে বলল ।
“ফুঃ!” আমার হাসি পেল ।
“সেকী? তুই ভূতের ভয় পাস না?” দেবদত্ত মাথা তুলে চোখ তুলে তাকাল ।
আমি
হাসতে হাসতে বললাম, “যার কোন অস্তিত্বই নেই তাকে ভয় পাব কেন? তোরা
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে দে রে । সায়েন্স আর ভূত দুটো এক সাথে যায় না ।”
“ছাড়, কেমন এগজাম দিলি বল?” ইন্দ্রয়ুধ জিজ্ঞেস করল ।
এতক্ষণ চুপচাপ খেতে খেতে আমাদের কথা শুনছিল । ও আমাদের সেশনের সবচেয়ে সম্ভাবনাময়
স্টুডেন্ট । পরনে ঢোলা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর ঢোলা টি শার্ট, চোখে হাই পাওয়ারের চশমা ।
“ওই হল । তোর
?” আমি ওকে এক পলক দেখে ফের খাওয়ায় মন দিলাম ।
“হল ।”
আমি ওর হাতে
একটা বই দেখলাম ।“এটা কী বই রে?”
“আমাদের বংশের হিস্ট্রি,পড়বি?”আমি জানতাম ইন্দ্রায়ুধ উত্তর কলকাতার
বিখ্যাত জমিদার বংশের ছেলে ।
“দেখি ।”
ইন্দ্রাযুধ বইটা হাতে দিতে দেখি কভার পেজটা নেই, খুব পুরোনো । ভেতরটা খুলে দেখি জনৈক মাইকেল ব্রুকের ‘এ ট্রু স্টোরি’ । পাতা উলটে বললাম,“কেমন রে? পড়েছিস?”
“হুম ।খারাপ না ।
দেখ জীবনের কত কিছুই তো বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না তবুও তো ঘটে।”
“মানে?”
“মানে? মানে ধর,তুই তো ভূত বিশ্বাস করিস না?”
“না ,বোগাস!” বিরক্ত লাগল আবার প্রসঙ্গটা ওঠায় ।
“করিস না,কিন্তু ধর দেখে ফেললি” ।ইন্দ্রায়ূধ ফাজলামির
হাসি হাসছে ।
“ফালতু বকিস না
।”আমি ক্যান্টিনের বাইরে তাকালাম, ঝকঝকে রোদ ।
“না রিয়েলি!”
“ভাট্ বকছি,
তুই দেখেছিস?” সরাসরি ওকে চার্জ করলাম ।
“হুম।” ইন্দ্রয়ুধের সংক্ষিপ্ত জবাব । সাহিল,দেবদত্ত,
আর্য খাওয়া ছেড়ে আমাদের কথা শুনছে হাঁ করে । বিশেষ করে ক্লাসের
মোস্ট ইন্টেলিজেন্ট স্টুডেন্ট ভূত দেখেছে ব্যাপারটা ঠিক হজম হচ্ছে না বোধ হয় ।
“কী ভূত মামদো না
শাঁকচুন্নি? নাকি স্কন্ধকাটা?”আমি
হাসতে হাসতে বললাম ।
“রিয়েলি,
ট্রাস্ট মী” । ইন্দ্রায়ুধ হঠাৎ চেয়ার
ছেড়ে উঠে গলার চামড়াটা দু আঙুলে চিপে ধরল।
“কোথায়? আমি মজা পেলাম । চোখ নাচিয়ে হাসি দিলাম ।
“আমাদের দেশের বাড়ি,আই মিন মহরাতে ।” ইন্দ্রায়ুধ বেশ গম্ভীর এখন ।
“মহরা? আর্য আর দেবদত্ত এক সাথে বলে উঠল ।
“হ্যাঁ বিহারে ।”
“তুই তো কলকাতার
ছেলে? ইজন্ট ইট?” সাহিল জিজ্ঞেস
করল ।
“আরে মহরাতে আমার
ঠাকুর্দার জমিদারী ছিল ।আমার ঠাকুমা ঠাকুর্দার সাথে বনিবনা না হওয়ায় বাবাকে নিয়ে দাদামশাই
এর কাছে কলকাতায় চলে আসে । সেই থেকে আমরা…………” ।ইন্দ্রায়ুধ বেশ সিরিয়াস ।
আমি শুনছিলাম এবার
বললাম, “বুঝলাম ।মহরাতে এখন কে আছে?”
“কেউ না । শুধু প্রাসাদ
থেকে খানিকটা দূরে নায়েব মশাইএর বাংলো বাড়িটা আছে, সেখানে
শিউশরন নামে কেয়ারটেকার থাকে ।”
“তা কেমন ভূত দেখেছিস?”
আমার চোখে তাচ্ছিল্য । ইন্দায়ুধ সেটা খেয়াল করে বলল
“ফরগেট ইট।”
“বল না?”
“তোকে বলে লাভ?
তুই না বিলিভ করবি- না ভেরিফাই করবি ।” এবার
ওর চোখে তাচ্ছিল্য ।
মাথাটা গরম হয়ে গেল । বললাম, “তোদের ছেলেদের
ওই একটা দোষ বুঝলি? তোরা স্বীকার করিস না মেয়েরাও বোল্ড
হতে পারে, ইন্টেলেজেন্ট হতে পারে ।” আমার খাওয়া হয়ে গেছিল আমি ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম
।
অমনি
ইন্দ্রয়ুধের বত্রিশটা দাঁত বেরিয়ে পড়ল । আমার হাত টেনে আবার বসিয়ে বলল, “লিসন, ডু ইউ ওয়ান্ট টু ভেরিফাই?”
“ইয়া ।আই ওয়ান্ট
।”
“বাট ।”
“হোয়াট বাট?”
“যদি কিছু হয়ে যায়
দেন ইউ ডোন্ট ব্লেম মি ।”
“ডান ।” আমি সপাটে ওর
তালিতে তালি বাজালাম । বাকিরা ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল ।
আমি লাইব্রেরির বই
জমা দেব বলে উঠে পড়লাম ।কিছুটা এসে পেছন ফিরে দেখি চার মাথা এক । বুঝলাম আমাকে
নিয়েই আলোচনা হচ্ছে । ছোট থেকেই অন্য মেয়েদের থেকে আমি আলাদা । মাথায় ছোট করে
বয়কাট চুল, আর কোনও দিন শাড়ী বা শালোয়ার পরনে ওঠেনি,
ছোট থেকেই জিন্স, টি শার্ট, শর্টস পরতেই অভ্যস্ত । পাপা আর্মি অফিসার হওয়ার দৌলতে আমি হর্স রাইডিং,
ড্রাইভিং, শুটিং থেকে ক্যারাটে সব জানি
। মা না থাকায় ছোট থেকেই সেল্ফহেল্প । ছেলেরা আমায় প্রেম নিবেদনের চেয়ে বন্ধুত্বে আগ্রহী
বেশি । আমারও মন্দ লাগে না । আফটার অল আমাকে ওরা মেয়ে বলে আলাদা ছাড় দেয় না,
যেটা আমার সব চেয়ে অপছন্দ ।
#দুই#
সারাটা রাস্তা
ইন্দ্রায়ুধের বইটা পড়তে পড়তে এসেছি । অনেক কিছুর মধ্যে সারার্থ হল ইন্দ্রায়ুধের
পিতামহের জমিদারি ছিল মহরায় ।তিনি ছিলেন যেমন সুপুরুষ, তেমনি গুনি
।বিলেত থেকে উচ্চ শিক্ষিত ও শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক, প্রকৃতি
প্রেমিক ও ভীষণ একগুঁয়ে । তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিলেত যাবার আগেই বিয়েটা দেওয়ায়
বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি । লাট সাহেবের মেয়ে একটি পুত্র সন্তান নিয়ে পিতার ঘরে
ফিরে যায় । সেখানেই তিনি সুখে কালাতিপাত করতেন জনশ্রুতি ছিল ।
খানিকটা
বাউন্ডুলে প্রপিতামহ রং ক্যানভাস নিয়ে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন । প্রজারা তার
অলক্ষ্যে তাকে খানিকটা ভালবেসেই পাগলা রাজা বলত । ছবি আঁকতে গিয়ে এ হেন পাগলা রাজা
শেষে প্রেমে পড়লেন এক ভিল রমণীর ঘন কালো চোখের, যে আবার
বিবাহিত ও বছর দুইয়ের এক পুএ সন্তানের জননী । বিষয়টা ছিল এক তরফা, কিন্তু পাগলা রাজার অবুঝ প্রেম তাকে জোর করে তুলে আনে প্রাসাদে । তাকে
এক প্রকার সোনার খাঁচায় বন্দিনী করে রাখে । আর এমন করলে বনের পাখির যা হাল হয়
ভিলনিরও তাই হল । নাওয়া খাওয়া ছেড়ে শুকোতে লাগল ।
এদিকে ভিলনির
ছবিটি নিয়ে তখনকার ইংরেজ শিল্প মহলে হইচই পড়ে গেল । তদনীন্তন বড়লাট ছবিটি কিনতে
চাইলেন । কিন্তু তিনি তা দেবেন কেন? ফলে তার বিরূদ্ধাচারণ
শুরু করল বড়লাট ।অন্য দিকে ভিল জনগোষ্ঠি তলায় তলায় রাজার বিরূদ্ধে এক জোট হচ্ছিল ।
একদিন ভোর রাতে
রাজা যখন ভিলনির মন ভোলাতে তাকে রাগ ভৈরবী গেয়ে শোনাচ্ছেন আর ভিলনির গভীর কালো চোখ
দিয়ে নীরবে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে, তখন ভিলরা বিদ্রোহ ঘোষণা
করল । তারা দেউল টপকে ভেতরে ঢুকে বিষাক্ত বর্ষা ছুড়ে দিল রাজার বুকে । রাজা হাসতে
হাসতে লুটিয়ে পড়ল ভিলনির কোলে । সেই প্রথম ভিলনি দু হাতে রাজার মুখ তুলে ধরে তার
অধরে নিজেকে ডুবিয়ে দিল । রাজা ধীরে ধীরে চোখ বুজল ঠোঁটে তার লেগে থাকল এক টুকরো
হাসি । এবার ভিলনি রাজার মাথাটা খুব যত্নে কোল থেকে নামিয়ে ছুটে যায় খোলা ঝুল
বারান্দায়, নীচে পড়ে বন্দিত্ব থেকে, জীবন থেকে মুক্তি পেতে তার দু সেকেন্ড সময় লেগেছিল ।
একপ্রকার পাপাকে না জানিয়েই দিল্লি থেকে ট্রেনে চেপে বসেছিলাম । আসলে যেহেতু আমি বরাবর বাইরে পড়াশোনা করেছি তাই একা কোথাও যেতে পাপার কোন কালেই আপত্তি ছিল না । আমার আসার খবর শিউশরনের কাছে আগেই ইন্দ্রায়ুধ দিয়ে
রেখেছিল । ট্রেন থেকে নেমে এক মাইল হেঁটে কাল রাতে বাংলোয় পৌঁছেছি । এখানে সন্ধে সাতটার পর সব বন্ধ, না বাস, না টাঙ্গা, না রিকশ, কিছুই নেই । ফিরে এত ক্লান্ত ছিলাম যে শিউশরনের কাছে যাহোক কিছু খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছি ।
শেষ রাতে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল । কী
একটা পাখি তীক্ষ্ণস্বরে ডেকে উঠল । দরজা খুলে উঠোনে এসে দাঁড়ালাম । কী অসাধারণ
লাগছে! এখন শীতের শুরু,
অদ্ভুত ভালো একটা আবহওয়া । চাঁদের আলোয় দূরে কুয়াশা মাখা আবছা
পাহাড় যেন ঘুমিয়ে আছে ।পাখির ডাকে ডাকে ঘুম ভেঙ্গে একটা মায়াময় জগৎ ধীরে ধীরে যেন
আঁখি মেলতে চাইছে । পায়ের কাছে যা পেলাম তাই পায়ে গলিয়ে উঠোনে নেমে এলাম । কেমন
একটা শীত শীত ভাব, ঠান্ডা ঠান্ডা ভাবটা আমার ট্রাক শ্যুট
অগ্রাহ্য করায় হাত দুটো বুকের কাছে উঠে এল । দু পা হেঁটে এলে কেমন হয়? ভাবনা আর কাজের মধ্য্যে মাত্র দু সেকেন্ডের ব্যবধানে আমি হাঁটতে লাগলাম
।
পথের দুপাশে
হালকা ঝোপঝাড়, বুনো ফুলের গন্ধে, আর শিশির ধোয়া ঘাসের মায়া ভরা ছোঁয়ায় আমার ছেলেমানুষের মত পাগলামিতে
পেয়ে বসল । পা দিয়ে হাওয়াই চটিটাকে আবার উঠোনে ছুড়ে দিয়ে আমি খালি পায়ে হাঁটছি,
ভালোলাগার একটা শিরশিরানি কেমন করে যেন আমার শরীর মনে নেশার ঘোর
লাগাচ্ছে ।
আমি হাঁটছি
চাঁদের আলোয় আধো অন্ধকারে ।গতকাল বুঝি পূর্ণিমা ছিল অথবা আজ হবে বোধ হয় ।চারিদিক
আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে । কত দূর কে জানে চলে এসেছিলাম, হঠাৎ
দেখি একটা পুরোনো ইঁট খসা বিশাল বাড়ি । বেশ সুন্দর কারুকার্য সহ ঝুল বারান্দা,
আজ লতানো গাছের অত্যাচারে অসহায় । দেউড়ির ভাঙ্গা লোহার গেট
পেরিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালাম ।
কার বাড়ি এটা?
এটাই কি ইন্দ্রায়ুধদের রাজবাড়ি? ভাবনাটাকে
রূপ দিতে পায়ে পায়ে ঢুকলাম তার ভিতরে । পায়ের তলায় আগাছারা হঠাৎ যেন ঘুম ভেঙ্গে
জেগে গেল, খালি পা দুটোকে যেন জড়িয়ে ধরতে চাইছে । কেমন
যেন গা ছমছম করে উঠল । ফিরে যাব? কিন্তু কেন যে না ফিরে আরও
গভীরে চললাম জানি না ।
সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম
দেখি ওপরে লম্বা বারান্দার ধার দিয়ে বিশাল বিশাল ঘর, সব
তালা বন্ধ । একটা ঘরে তালা খোলা, দমকা হাওয়ায় হঠাৎ দরজাটা
খুলে গেল । পায়ে পায়ে কখন যে ঘরের মধ্যে চলে এসেছি বুঝিনি । মাকড়সার জালে ভরা
দেওয়ালে বিভিন্ন শিকারের নিদর্শণ, হরিণ, বুনো মোষ, বাঘের মুখ । এত ছবি দেওয়ালে,
অযত্নে এখনো কী রকম জীবন্ত ।
আমি যেন নিজেকে
আয়ত্বে রাখতে পারছি না, এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বের
হতে হবে, কিন্তু কেন পারছি না ? ছবি
গুলো টানছে, কাছে গেলাম, মনে হল
অয়েল পেন্টিংস । এগুলো কি ইন্দ্রায়ুধের ঠাকুরদা এঁকেছিলেন? ছবি গুলো দেখতে দেখতে একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল । এক ভিলনি বড় একটা
হাঁড়ি নিয়ে পাথরের ওপর বসে । পরনে তার শুধু একটা নীল শাড়ি হাঁটু পর্যন্ত ফেরতা
দিয়ে পরা । অসাধারণ তার যৌবনের লাবণ্য, অসাধারণ তার চোখ।
যেন অকুল সমুদ্রের বিষ্ময় আর নীল আকাশের গভীরতা মিলেমিশে একাকার ঘন কালো দু চোখে ।
একি সেই ভিল
রমনী যার কথা বইটাতে পড়েছি? একী চোখের পলক পড়ল যেন! ভালো
করে দেখি বড় বড় চোখ করে ভিলনি যেন আমায় দেখছে । একী আবার যেন চোখের পলক পড়ল!
শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা হিম স্রোত বয়ে গেল, আমি ভুল
দেখছি না তো? আরে আবার, আবার,
আরে সত্যি !
আমার সমস্ত শরীর
শক্তিহীন হয়ে গেল । আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে না আর এক মুহুর্ত এখানে নয়, এ জায়গা থেকে এক্ষুনি বের হতে হবে । আমি প্রাণপণে মনের জোর সংগ্রহ করে
ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে সিঁড়ির দিকে গেলাম । দেখি সিঁড়িময় হাজার হাজার টিকটিকি,
মাকড়সা, আরশোলা । আমি চোখ বন্ধ করে
দুড়দাড় করে নামতে লাগলাম খালি পায়ে । তাদের গায়ে পা পড়ল কী পড়ল না দেখছি না । সিঁড়ি
দিয়ে নেমেই দেখি একটা বিশাল সাদা রাজহাঁস । গলা দুলিয়ে দুলিয়ে উঠোনময় হাঁটছে ।
অদ্ভূত ভাবে সে এবার আমার দিকে এগিয়ে আসছে । আমি ভয়ে সাদা, এটা রাজহাঁস না অন্যকিছু ভাবার সময় নেই, আমি সমস্ত শক্তি
জড় করে ভাঙ্গা দেউল টপকে ছুটছি । ছুটছি, ছুটছি , পিছন ফিরে তাকানোর সময় নেই । পা বুনো কাঁটাঝোপে, পাথুরে মাটিতে ক্ষতবিক্ষত, ট্রাকশ্যুট ভেদ করে
পা কাঁটাঝোপে ফালা ফালা, এসব দেখার অবকাশ কোথায় ? সামনে মাঠ, মাঠের পরে দিগন্ত, দিগন্তের মাথায় লাল আকাশ, ভোর হয়ে আসছে ।
মাঠের শেষে চাষিদের কথার আওয়াজ পেলাম, সবাই কাজে
বেরোচ্ছে। আমি পথের ধারে একটা বাঁশের মাচায় বসে পড়ে হাঁফাতে লাগলাম ।
“ক্যা বিবিজি
এহাঁ ক্যা কর রহিহো?” তাকিয়ে দেখি চৌকিদার শিউশরন। হাতে
তার ধামা, বোধ হয় খেত থেকে সবজি তুলে আনতে চলেছে ।
“কুছ নহি বস্,
এহ্ সুবহ্ আচ্ছা লাগ রাহা হ্যায় ।” বললাম
বটে কিন্তু এখন সকালের সৌন্দর্য মন ছেড়ে গেছে, আর একটু
আগের অভিজ্ঞতা সমস্ত মনকে গ্রাস করে নিয়েছে।
শিউশরন কে বললাম
“আচ্ছা শিউশরন, ওই যে মাঠের শেষে
বড় বাড়িটা ওটা কাদের বাড়ি?”
শিউশরন চোখ
কপালে তুলে বলল “ক্যা বিবিজি আপ গয়ে থে বঁহা ক্যা?”
“না আমি দূর
থেকেই দেখেছি ।” আমি মিথ্যে বললাম ।
“কভি মত্ জাইয়ে
বঁহা ।”
“কিঁউ?”
“বহ জাহগা ঠিক
নহি হ্যয় বিবিজি ।”
“পর কিঁউ?”
“হামি আপকো বাদ
মে বলবে, আপ অভি ঘর চলিয়ে ।”
অদ্ভুতভাবে
বৃদ্ধ শিউশরন আমাকে আদেশ করল, আর আমিও বাচ্চা মেয়ের মত
তার আদেশ পালন করলাম ।
বাংলোয় ফিরে
আমার ধুম জ্বর এল । একেবারে যাকে বলে কাবু করে দেওয়া । কখন যে শিউশরন ঘরে ঢুকছে
কাকে কী বলছে কিছুই মনে নেই । তিন দিন পর জানকি মাই মানে শিউশরনের বউ আমার চুলে
গুচ্ছের তেল দিয়ে আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, “বিবিজী আজ আপকে
বাবুজী আয়েগা, সামান বাঁন্ধ লিজিয়ে ।”
“মানে? আমার পাপা আসবেন? তিনি কী করে জানেন আমি এখানে?”
শিউশরণ দেখি
হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল “বিবিজি হামায় ক্ষমা কর দেনা,
হামি ছোটে নবাব কো টেলিফোন মেঁ বতায়া । বহ আপকে বাবুজিকো বুলায়া
।আপ নেহি জানে
এহি তিনঠো দিন আপকা ক্যা হালত থী । আপ জান সে বচগয়া এহি বস্ বহুত
হ্যায় ।ভগবান কে লিয়ে আপ এঁহা সে যাইয়ে ।”
#তিন#
পাপার সাথে ফিরে
এলাম কলকাতায় । বিষয়টা নিয়ে কাউকে কিছুই বলিনি, কারণ কেউই
কিছু বিশ্বাস করবে না জানি । একদিন বিকেলে ইন্দ্রায়ুধ ফোন করল “আছিস”?
“হ্যাঁ”।
“আজ বিকেলে
যাচ্ছি, থাকিস” । ও লাইনটা কেটে
দিল ।ইন্দ্রায়ুধ আগেও এসেছে আমাদের বাড়ি তাই বাড়ি চিনতে অসুবিধা হবে না ।
ঠিক বিকেল
চারটেতে এল ।এসেই আমার দিকে তাকিয়ে বলল “সরি !”
আমি আসলে কদিনের
জ্বরে বেশ কাহিল হয়ে গেছিলাম তবুও জোর করে হেসে বললাম, “হোয়াট
সরি?”
ও আমার মুখের
দিকে তাকিয়ে থাকল নরম চোখে । আমি ওর দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের সঙ্গে বললাম, “এই সেন্টু খাচ্ছিস কেন? এ্যাম ওকে ।”
এবার ও আবার সেই
ওর স্বভাবসিদ্ধ জ্বলজ্বলে বুদ্ধিদৃপ্ত চোখে তাকাল । তার পরেই বত্রিশটা দাঁত বের
করে ফিচেল হাসি দিল । আমি ওর ঝকঝকে সাদা সমান দাঁতগুলোকে দেখছি হঠাৎ ওর দম ফাটা
হাসি শুনলাম । আমি ওকে হাসতে দেখে অবাক হলাম । তবুও ওর হাসি থামার অপেক্ষায় তাকিয়ে
আছি । কিন্তু হাসি না থামায় আমি বিরক্ত হয়ে চিৎকার করলাম, “নন সেন্স, পাগলের মত হাসছিস কেন?”
ও কোনো রকমে
হাসি চেপে বলল, “তুই তাহলে ভূত দেখেছিস”?
“এতে আবার হাসির
কী হল”? আমি বিরক্ত বোধ করছি ।
ও সোফায় পায়ের
ওপর পা তুলে জমিয়ে বসল ।“না বলছি কেমন ভূত দেখেছিস”?
টি টেবল থেকে আজকের খবরের কাগজটা খুলে আমার দিকে না তাকিয়েই
ইন্দ্র্রায়ুধ জোর করে সিরিয়াস হবার চেষ্টা করল।
আমি ভেতর ভেতর
অস্থির ছিলাম কাউকে অন্ততঃ ব্যাপারটা বলার, তাই বললাম,
“সত্যি রে কত কিছুরই বুদ্ধি দিয়ে বিশ্লেষণ করা যায় না, কিন্তু ঘটে” ।
এবার ও আবার
আমার দিকে তাকালো । দু চোখে চাপা ফাজলামির হাসি ।“বল দেখি
শুনি, বিশ্লেষণ করতে পারি কিনা?”
আমার চোখ এড়াইনি
ওর হাসিটা । এ হাসিটা আমার গা জ্বালিয়ে দেয় । আমি বললাম, “তোকে বলে লাভ? তুই কি আবার যাবি ওখানে?”
এবার আবার দাঁত
বার করতে করতে বলল, “আমি একা নয়, সাহিল আর্য দেবদত্ত আর তুই, পাঁচ জনেই যাব ।
তবে এবার পিকনিক করতে । প্রোজেক্টর গুলো ছাড়া ।”
“মানে?” আমি চিৎকার করে উঠলাম ।
ইন্দ্রায়ুধ
হাসতে হাসতে বলল, “হ্যাঁ তুই ঠিক শুনেছিস ।প্রোজেটর ।তুই
সব প্রজেক্টরের দেখানো চলমান ছবি দেখেছিস?”
“মানে ভিলনির
চোখের পাতা পড়া? সিঁড়িতে আরশোলা টিকটিকি মাকড়সা সব?”
উত্তেজনায় আমার গলা কাঁপছে ।
“হ্যাঁ সব ।”
ইন্দায়ুধের চোখে দুস্টুমি ।
“আর ভোরের পাখির
সেই কর্কশ আওয়াজ? যা শুনে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল ?”
“আরে ধুস,
এমন বাঁশি নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় নাইট ডিউটি দেয় শুনিসনি?”
“আর শিউশরন?
ও যে বলল ‘বহ জাগহা ঠিক নেহি হ্যায়?”
“আমরা যে দুদিন
আগে গিয়ে ওখানে লুকিয়ে ঘাঁটি গেড়ে ছিলাম, সব রকম ভয়
ধরানোর ব্যবস্থা পাকা করছিলাম, তা তো ও জানতো না । কিন্তু
মাঝে মধ্যে হয়তো টুকটাক আওয়াজ বা সিগারেটের আলো দেখে থাকবে । আসলে হয়তো তোর মতই
অপদেবতার অস্তিত্ব ভেবেছিল, আফটার অল গ্রামের অশিক্ষিত লোক
।”
“কী শয়তান তুই!”
আমি হাতের কাছে কিছু না পেয়ে পেতলের ফুলদানিটা ছুড়ে মারলাম ওর
দিকে । ও কায়দা করে লুফে হাসতে হাসতে বলল, “আমি একা নই,
প্লানটা চার জনেরই । তবে মানতেই হবে তোর সাহস আছে । তুই যদি
মহরায় যেতে না চাইতিস বা ভোর বেলা না বেরোতিস তাহলে পুরো ব্যাপারটাই মাঠে মারা যেত
।”
কিন্তু কেন জানি
না মাথায় হঠাৎ রাজহাঁসের কথাটা এল । ওটা? ওটা তাহলে কী
ছিল? পায়ের নীচের লতাগুলো পা জড়িয়ে জড়িয়ে ধরছিল বেশ মনে
আছে, তবে? আমি ইন্দ্রায়ুধকে
জিজ্ঞেস করতে গিয়েও চেপে গেলাম, দেখি দরজা দিয়ে পাপা হাত
তালি দিতে দিতে ঢুকছে । পেছনে দাঁত বের করতে করতে দেবদত্ত, আর্য, আর সাহিল । সবাই বলে উঠল “থ্রি চিয়ার্স ফর সুমেধা, হিপ হিপ হুড়রে ।”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম । নাঃ থাক ।
আর জিজ্ঞেস করব না । এগুলো আমারই থাক ।