গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ২৫ জুন, ২০১৬

কাওসার পারভীন


আরশিনগর


টিম টিমে আলোয় আবছা একটা ছায়া। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে।এই নিশুতি রাতে কে ! কুপির আলোয় এবারে অস্পষ্ট দেখা যায় অবগুন্ঠিত সদ্য যৌবনা এক নারী।
- কে  তুই?
'আমি দূর গাঁ থেকে এসেছি গুরুজি । সংসার আমারে নিল না, ঘর আমারে ঠাঁই দিলনা, তাই ঘর ছেড়েছি,আমায় আপনার শিষ্য কইরে নেন গুরুজি। আমার মন টানে লালনের গীতে। আমার এই জীবনে মিলনের আশা যে নেই গুরুজি। তাই আমি আপনার কাছে আসছি । আমারে ফিরায়ে দিয়েন না,দয়া করেন গুরু। নইলে যে আমার এ কূল ও কূল দু'কূল ই যাবে। '
গুরুজি চোখ বুজে শুনছিলেন,মাথায় হাত রাখলেন,ঘরহারা এই নিশি কন্যার।
-  নাম কি তোর ?
- কাজললতা
-সাধনা যে কত কঠিন তা কি তুই জানিস?'
-আমি জানি,আর জানি বইলাই আমি আইসি গুরু !
মন টেনেছে সেই জ্ঞান হবার পর থেকেই লালনের গীতে, সুর গেঁথেছে অন্তরে সেই কবে থেকে। এমন কুচকুচে কালো মেয়ের হিল্লে হলো বলে মা বাপের কাঁধ থেকে বোঝা গেছে সেই ঢের। আত্মভোলা মেয়েটা পুকুর ঘাটে কলসী ভরে আনতে গিয়ে,আনমনে গেয়ে উঠে ,
"আমি একদিনও না দেখিলাম তারে...
বাড়ির কাছে আরশিনগর ,একঘর পড়শি বসত করে "
চকিতে ঘাটের দিকে নজর পড়ে, অনতি দূরে দাঁড়িয়ে আছে অচেনা এক যুবক ! বিমোহিত হয়ে গীত শুনছে । চোখ পড়তেই লজ্জায় মাথার আঁচল টেনে দেয়। কপালে সিঁদুর,হাতে শাঁখা পলা !
যে মেয়ের কণ্ঠে এত দরদ! সে থাকবে গৃহ বন্দী !
" থামলে কেন কন্যা ? তুমি কি জান ? স্বয়ং বিধাতা তোমার কণ্ঠে কি সুধা ঢেলে দিয়েছেন ! "
ভীত হরিণীর মত কাজলকালো চোখে এক নজর তাকিয়ে কলসী কাঁখে নিজ পথে পা বাড়ালো
যুবকের চোখে বিস্ময় ! অন্তরে বিষণ্ণতার ছায়া।
ফিরতি পথে পা বাড়িয়ে পরের চরণ ধরে--
"গেরাম বেড়ে অগাধ পানি 
নাই কিনারা নাই তরণী পারে,
বাঞ্ছা করি দেখব তারে
আমি কেমনে সেথা যাই রে।।"
বিমুগ্ধ নয়নে ঘাড় ফিরিয়ে কাজললতা চেয়ে থাকে,ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় সুর।
বাড়ী ফিরতে দেরি হলো,স্বামীর ঘর থেকে অপমান আর অত্যাচারের দাগ শরীরে নিয়ে অবশেষে ঘরছাড়া। গুরুজীর ডাকে সচকিত হয় !
'এই জগত দেখবি অন্তর দিয়ে, অন্তরের চোখ আর বাহিরের চোখ এক নয়,একথা মনে রাখিস।' খেয়ে নে মা। খেয়ে নে' লালন অনুসারী গুরুজীর আখড়ায় এই নিশুতি রাতেও শিষ্যরা জেগে আছে কেউ কেউ। বড় চেনা কণ্ঠে দরদী গলায় কে যেন গেয়ে ওঠে--
"সময় গেলে সাধন হবেনা ,
দিন থাকিতে দিনের সাধন, 
কেন জানলে না তুমি !"