গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ২৫ জুন, ২০১৬

পলাশ কুমার পাল



কান্না

বোর্ডে অঙ্ক বোঝাতে বোঝাতে দীপ দেখল শ্রেণিকক্ষে একটা মেয়ে অঙ্ক না করে কাঁদছে। অথচ এই মেয়েটাই প্রত্যহ সবার আগে অঙ্ক করে দেখায়। কিন্তু আজ? প্রথম শ্রেণির ছোট্ট পৌলমীর কান্নার সঙ্গে মনের অভিমানগুলোও যেন ফুঁপিয়ে উঠছে। দীপ চক ডাস্টারটা টেবিলে রেখে পৌলমীর দিকে এগিয়ে যায়। নিয়মিত প্রথম বেঞ্চে বসা পৌলমীকে শেষ বেঞ্চে দেখে একটু খটকাও লাগে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, "কী হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেন?"উত্তরের পরিবর্তে ফোঁপানোর শব্দ আরও বেড়ে যায়। পাশাপাশি অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি জিজ্ঞাসার চোখে তাকালে নানা জনে নানা উত্তর দেয়। কেউ বলে, "ওকে রাজ মেরেছে।" কেউ বলে, "না স্যার, পেন আনেনি। তাই কাঁদছে।" কেউ বা বলে, "স্যার 'কে বাড়িতে ওর মা খুব বকেছে!"..
অনেকেই শিক্ষক দীপকে নানা সম্ভাব্য কারণের কথা বলে। দীপ  বুঝতে পারে না কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা! কিন্তু কোনো একটা কারণ তো আছেই। পৌলমীর দিকে তাকিয়ে দেখে দু'গাল অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে হোঁস-ফোঁস করছে। সামনে ব্যাগের উপরে খাতাতেও কয়েক ফোঁটা অশ্রু। বারেবারে দু'হাতে করে চোখ মুছছে। কখনো পরনের জামাটা দিয়ে মুছে নিচ্ছে দুটো গাল। নিজের ভিতরের কান্নাটাকে যেন লুকোবার চেষ্টা। অথচ কান্নাকে লুকাতে পারছে না। পৃথিবীতে খাঁটি কান্না বা অভিমানই সেই দুর্লোভ জিনিস; যাকে লুকানো যায় না, তবে মনের হতাশার পাথরটাকে গলানো যায় কিছুটা। দীপ মাথায় পিঠে স্নেহের হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞাসা করে আবারও, "কী হয়েছে তোমার? মা বকেছে?"পৌলমী আবারও ফুঁপিয়ে ওঠে। দীপ তাকে কাছে ডাকে। কোলে করে চোখ মোছাতে মোছাতে বলে, "কী হয়েছে  বলো? আমি কাউকেএএ বলব না! আমাকে বলোওও!"রিতা বলে শ্রেনির একটা মেয়ে বলে ওঠে, "স্যার, ওর মা আজ 'কে টিফিন দেয়নি!"
টিফিন দেয়নি!এটাও কি সম্ভব? হয়তো কাজের ব্যস্ততার মাঝে দিতে ভুলে গেছে। দীপের এটাই মনে হয়।
-তোমায় টিফিন দেয়নি ?

-না, আমি নিইনি! অভিমানী কণ্ঠে পৌলমী বলে ওঠে।
-কেন? নাওনি কেন?" দীপ পৌলমীর চোখ মোছায়।
-নাআআ! আমায়,আমায় চাউ করে দেয়নি কেন!কাঁদতে কাঁদতে একটু থেমে বলে, প্রতিদিন সবাইকে তার মায়েরা কত ভালো ভালো টিফিন করে দেয়! আমার মা দেয় না!
-তোমার মা তো অন্য টিফিন দেয়...
-হুম। কিন্তু...
-কিন্তু কী? তোমার মা কত ভালোবেসে তোমায় টিফিন করে দেয়। যা পারে সেটাই তো দেবে! রাগ করলে হবে! ছিঃ রাগতে নেই...
চোখের জল মোছাতে মোছাতে দীপ লক্ষ্য করে তার হাতের চকের গুঁড়োগুলো পৌলমীর গালে লেগে যাচ্ছে। সে পকেট থেকে রুমাল বের করে অশ্রু মোছায়। পাশ থেকে রিতা আবারও বলে, "স্যার জানেন, গতকাল আমি টিফিনে 'কে চাউ দিয়নি বলে কাঁদছিল। তাই অরুণ স্যার 'কে বলেছে যেন ভালো টিফিন আনে। অরুণ স্যারের কথাটা দীপের যেন কেমন লাগে। কী বলে পৌলমীকে সান্ত্বনা দেবে সেটাও সে বুঝে উঠতে পারে না। নিজের শৈশবের দারিদ্রতার কথা তার মনে পরে। তবে এমনতর পরিস্থিতিতে তাকে কখনো পরতে হয়নি। ছোট্ট থেকে এমন বৈতনিক বিদ্যালয়েও সে যায়নি। গ্রামের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়েই পড়েছে। তাই হয়তো... তবে বেকার জীবনে অর্থের তাগিদে আজ সে বৈতনিক  বিদ্যালয়ের শিক্ষক। এখানে শিক্ষার সুব্যবস্থা অর্থাত্গাদা গাদা পুঁথিকে ছোট ছোট শিশুর মগজে ঢুকিয়ে দেবার নানা সূত্র আছে। এটাই তার মনে হয়। অথচ এই মধ্যবিত্ত, দরিদ্র ধনীর পার্থক্য মেটাবার...? শিশুরা তো এত সব বোঝে না। তারা কেবল সমতাই জানে।
'মাসের অল্প শিক্ষণ অভিজ্ঞতায় দীপ ছোট্ট পৌলমীর সমস্যার সমাধান খুঁজে পাচ্ছিল না। শ্রেনিকক্ষের মধ্যে দুটি ফ্যান একটা জোড়ে একটা ধিক ধিক করে ঘুরছে। দীপ সেই দিকে তাকিয়ে কিছু একটা উপায় ভাববার চেষ্টা করে।

কিছুক্ষণ বাদে পৌলমী দীপের মুখটাকে বামহাতে করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে, "জানো স্যার, আমাকে অনেকেই তাদের টিফিনে যা আনে দেয়। আমি একদিনওও কাউকে কিছুউ দিতে পারি না! তাই মা'কে বলেছিলাম একদিন ভালোও কিছু করে দিতে। ওদের'কে দেব। মা কথা দিলেও আজওও কিছুউ করে দিল না। বললে, আমরা নাকি গরীব!"

"গরীব কাকে বলে, স্যার?" একটু থেমে পৌলমী আবারও বলে। দীপ নিশ্চুপ হয়ে যায়। সংজ্ঞাটা তারও ঠিক জানা নেই। ছোট্ট শিশুটার কাছে নিজেকেই গরীব বলে মনে হয়। এদের পড়াবার জন্য সে যে বেতন নেয়!দীপ অপলকে পৌলমীর দিকে তাকিয়ে থাকে। কত মিষ্টি মেয়ে! অথচ ছোট্ট গাল-দুটোতে অশ্রুর প্লাবন। চোখগুলোও লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। গরীবের সংজ্ঞা না জানলেও দীপের মনে হয় এটাই যেন ধনীর শ্রেষ্ঠ পরিচয়। এটাই হয়তো সব প্রশ্নের,সব সমস্যার সমাধান!