গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ২৫ জুন, ২০১৬

সুবীর কুমার রায়



                                
বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী

স্নাতক হওয়ার পর উঠেপড়ে চাকরির চেষ্টায় লেগে গেলাম। চাকরির বাজার তখন এখনকার মতো খারাপ না হলেও, সহজলভ্য  মোটেই ছিল না। প্রাণের বন্ধু দিলীপ স্নাতক হওয়ার আগেই সংসারের অর্থনৈতিক চাপে সম্বলপুরে একটা রাইস মিলে সামান্য বেতনের চাকরি নিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। পরীক্ষার ঠিক আগে ওকে ওখান থেকে ছুটি নিয়ে এসে পরীক্ষা দিয়ে স্নাতক হয়। তারপর একদিন সেই লোভনীয় চাকরির মায়া কাটিয়ে ঘরে ফিরে এসে আমার মতোই ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে শুরু করে। মাঝে চরম দুর্দিনে কিছুদিন ধুপকাঠির ব্যবসা শুরু করে ক’পয়সা লাভ করেছে সেই জানে, তবে সেখান থেকেও রণে ভঙ্গ দিয়ে স্থিত হয়ে বাড়িতে বসে চাকরির চেষ্টা শুরু করলেও, ব্যবসায়ী হওয়ার মোহ সে আর ত্যাগ করতে পারেনি।
এ হেন দিলীপ একদিন জানালো যে সে প্লাস্টিকের ছিপির ব্যবসা করবে বলে মনস্থির করেছে এবং আমাকে সে তার সঙ্গে নিতে চায়। আমি সরাসরি জানালাম যে ছিপির ব্যবসা সম্বন্ধে আমার কোন ধারণাই নেই। সে বিজ্ঞের মতো জানালো যে মায়ের পেট থেকে পড়েই কেউ ব্যবসাদার হয় না। চেষ্টা, অনুশীলন, ইচ্ছা, লেগে থাকা ইত্যাদি, মানুষকে সামান্য ব্যবসা থেকে শিল্পপতি তৈরি করে। উদাহরণ স্বরূপ কে ফুটপাথে গামছা বিক্রি দিয়ে জীবন শুরু করে আজ দেশের এক নম্বর সুটিং শার্টিং ফ্যাক্টরীর মালিক হয়েছে, কে সামান্য চায়ের দোকানে কাজ করে আজ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বড় বড় শহরে পাঁচতারা হোটেলের মালিক হয়েছে, ইত্যাদিও জানাতে  ভুললো না। সে আরও জানালো যে সে অনেক খোঁজখবর নিয়ে এটা বুঝেছে যে এই ব্যবসায় লাভের পরিমান অনেক। আমি জিজ্ঞাসা করলাম বিভিন্ন মাপের প্লাস্টিকের ছিপি কোথায় কিনতে পাওয়া যায় তা ওর জানা আছে কী না। সে শুধু বললো এখন অন্য কারো মেশিন থেকে তৈরি করাতে হবে, ঠিকমতো ব্যবসা চললে পরে নিজেরাই তৈরি করবো।
বুঝলাম সে অনেক খোঁজখবর নিয়ে মনস্থির করে, তবে এই ব্যবসায় নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঐ রোগাপটকা, কলেজ কেটে গামছা পরে গঙ্গার ঘাটে ব্যায়াম করা দিলীপের মধ্যে যে একজন সুপ্ত রতন টাটা বিরাজ করছিল আগে কে জানতো? ভাবলাম ও যখন সবই জানে, সবই করবে, তখন ওর সাথে থাকলে যদি দু’পয়সা আয় হয়, তো হোক না।
ও নিজেই একদিন জি.ডি.ফার্মাসিউটিক্যালে বোরোলিনের ছিপির অর্ডার সংগ্রহে গেল। বুঝলাম ‘মারি তো গন্ডার, লুটি তো ভান্ডার’ একেই বলে। ভাবলাম ওর হবে, ও অনেক উঁচু থেকে শুরু করতে জানে। আর সব ব্যবসায়ী বহু সাধনা করে যেখানে গিয়ে পৌঁছয়, ও সেখান থেকে শুরু করতে চলেছে। পশুপাখির মা’রা খাবারের সন্ধানে গেলে, বাচ্চারা যেমন ভালো খাদ্যের আশায় মা’র ফেরার অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে থাকে, আমিও সেরকম ভালো আয়ের আশায় ওর ফেরার অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে থাকলাম।  
সেই সময় দূর্গা বা ঐ জাতীয় বড় কোন একটা পূজো ছিল। ও ফিরে আসার পর জানা গেল যে ঐ কোম্পানির লোক তার কাছে এই জাতীয় কাজে তার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে কী না, নিজস্ব মেশিন আছে কী না, পুঁজির পরিমান কত, ইত্যাদি অনেক কিছু তথ্যের খোঁজখবর নিয়ে জানিয়েছে যে তাদের অর্ডার অনেক টাকার ও অনেক মালের জন্য হয়। খুব ভালো মেশিন ছাড়া তাদের ঐ কোয়ালিটির ছিপি তৈরি করাও সম্ভব নয়। যাহোক্ সান্তনা পুরস্কার হিসাবে তারা দিলীপকে বলেছে যে তারা বোরোলিনের একটা বড় ব্যানার দিতে পারে, সেটা পুজো প্যান্ডেলে টাঙ্গালে একটা টাকা তারা বিজ্ঞাপন বাবদ দিতে পারে। বেচারার এমন ফাটা কপাল, যে কোন পূজোর সঙ্গে সে প্রত্যক্ষভাবে যুক্তও নয়।
ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো, হয়তো বা শেষ হয়ে যাওয়াই উচিৎ ছিল, কিন্তু দিলীপ সে ধাতুতে গড়া ছেলেই নয়। সে তখন ব্যবসা করে বাড়ি, পাড়া, দেশ ও দশের মুখ উজ্জল করার ব্রত নিয়ে ফেলেছে। ভেঙ্গে না পড়ে সে আমায় বললো, “চল রুপালী প্লাস্টিকের ওখানে গিয়ে ওদের এ ব্যাপারে একটু সাহায্য করতে অনুরোধ করে দেখি কি বলে”। রুপালী প্লাস্টিক, প্লাস্টিক শিল্পে একটা স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান, প্রচুর দামি দামি যন্ত্রপাতি নিয়ে তাদের ব্যবসা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, এমনকী বিদেশেও তারা প্রচুর মাল রপ্তানি করে। সেইসময় অবশ্য তাদের ব্যবসা এত বড় ছিল না, তবু বেশ বড় ও নামি প্রতিষ্ঠান হিসাবে অবশ্যই পরিচিতি ছিল, কাজেই আমাদের অনুরোধের ফল কি হতে পারে বুঝতেই পারছি। তাই তাকে মিনমিন্ করে বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে অন্য একদিন যাওয়া যাবে। কিন্তু সে তখন রণমুখী ঘোড়া, আমার ছেঁদো কথায় কান দেবে কেন? সে বেশ জোর গলায় বললো “ব্যবসায় কাল বলে কোন কথা হয় না, সব কাজ সাথে সাথে করে ফেলতে হয়, নে চল্ এখনি যাওয়া যাক”।  
ইচ্ছা না থাকলেও যা ঝড়ঝাপটা ওই সামলাক্ গোছের একটা মনোভাব নিয়ে ওর পিছু পিছু যেতেই হ’ল। ওখানে গিয়ে দিলীপ এক ভদ্রলোককে সব কথা খুলে বলতে ভদ্রলোক বললেন, “আপনারা কিরকম সাহায্য আশা করেন? আপনারা যদি অর্ডার ধরে আনতে পারেন, আমরা রিজোনেবল্ রেটে মাল তৈরি করে দিতে পারি”। ভেবেছিলাম আমাদের পাল সাহেব রাজা পুরুর মতো স্টাইলে বলবে,
“একজন শিল্পপতি অপর একজন শিল্পপতির কাছ থেকে যেরকম সাহায্য আশা করে”, কিন্তু সেই সব উক্তির ধারে কাছে না গিয়ে বললো, “এই মুহুর্তে আমাদের হাতে কোন অর্ডার নেই”। ভদ্রলোক বললেন, “ ঠিক আছে, আপনারা বরং এক কাজ করুন। লেভেল ক্রসিং-এর কাছে যে বাড়িতে মনসা মন্দির আছে, ঐ বাড়ির ভদ্রলোককে গিয়ে আমার কথা বলে সব কথা খুলে বলুন। উনি আপনাদের অবশ্যই সাহায্য করবেন”। সেইমতো আমরা মনসা মন্দির সংলগ্ন সেই বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলাম। মনসার কৃপায় না অভিশাপে বলতে পারবো না, ভদ্রলোকের একটা চোখ আবার নষ্ট। ভদ্রলোককে সব কথা খুলে বলায় তিনি বললেন, “আপনারা যদি দু-চারদিন পরে আসেন তাহলে আমি ছিপির কিছু স্যাম্পেল ও একটা ঠিকানা দিয়ে দেব। সেখানে গিয়ে আমার কথা বলে স্যাম্পেল দেখিয়ে কথা বলে দেখুন, যদি কিছু উপকার হয়”।
কথামতো দিন দুয়েক পরে আবার তাঁর কাছে যাওয়া হ’ল। তিনি আট-দশটা বিভিন্ন মাপের ছিপি দিয়ে প্রত্যেকটার গ্রোস হিসাবে দাম বলে দিলেন, সঙ্গে ক্যানিং স্ট্রীটের একটা দোকানের কথাও বলে দিলেন। অর্ডার সংগ্রহ হলে, তিনি ছিপি সংগ্রহ ও সরবরাহের ব্যাপারেও  সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। তিনি নিজে এই কাজটা করে মুনাফা না করে, আমাদের কেন সাহায্য করছেন বোঝা না গেলেও দুরে, বহুদুরে কিছুটা আশার আলো যেন দেখতে পেলাম।
বাড়ি ফিরে দিলীপকে বললাম, ছিপিগুলোর কোনটার কত দাম মনে থাকবে না, আমি বরং ছোট ছোট সাদা কাগজে দাম লিখে কাগজটা মুড়ে নির্দিষ্ট ছিপির ভিতর ঢুকিয়ে রাখি। দাম বলার সময় কাগজটা খুলে নিলেই হবে, তাহলে আর কোন সমস্যা থাকবে না। সেইমতো শ্রীকান্তের মেজদার মতো কোন কাগজে আট টাকা, কোন কাগজে ছ’টাকা, কোন কাগজে দশ টাকা ইত্যাদি লিখে, নির্দিষ্ট ছিপির ভিতর গুঁজে দিলাম। এবার কিন্তু আশার আলোটা বেশ উজ্জল বলেই মনে হ’ল।
একদিন কাগজ লাগানো ছিপি নিয়ে আমরা দু’জন স্বশরীরে নির্দিষ্ট দোকানে গিয়ে হাজির হলাম। দোকানে একজন ভদ্রলোক বসে আছেন, তাঁকেই আমাদের প্রেরকের পরিচয় দিয়ে আসার উদ্দেশ্য বললাম। উনি জানালেন যে দোকানের মালিক এখন নেই, আমরা যেন মালিক থাকাকালীন এসে সরাসরি মালিকের সাথে কথা বলি। মালিক কখন আসবেন, কতক্ষণ থাকবেন ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করছি, এমন সময় মালিক এসে উপস্থিত হলেন। দোকানের ভদ্রলোক দোকানের মালিককে আমাদের আগমনের কারণটি খুলে বললেন।
দিলীপ মনসার আশীর্বাদ ধন্য ব্যক্তিটির পরিচয় দিয়ে বললো “আমরা প্লাস্টিকের ছিপি সাপ্লাই করে থাকি”। মালিক ভদ্রলোক বললেন, “স্যাম্পেল এনেছেন”? বুঝতে পারছি ভদ্রলোকের সাথে আমাদের মৌ সাক্ষরের দোর গোড়ায় এসে পৌঁছে গেছি। অত্যন্ত গাম্ভীর্যের সাথে আমাদের প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান দিলীপ চন্দ্র পকেট থেকে ছিপিগুলো বার করলো, পাশেই দাঁড়িয়ে প্রতিষ্ঠানের সি.ই.ও. এই শর্মা। কিন্তু দিলীপকে আর কষ্ট করে ছিপি থেকে কাগজ খোলার কাজটা করতে হ’ল না, ততক্ষণে অধিকাংশ কাগজ ছিপি থেকে বার হয়ে নিজেদের মুক্ত করে ফেলেছে।
দিলীপের হাত থেকে একটা ছিপি তুলে নিয়ে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, “এটা কত করে গ্রোস দিচ্ছেন”? দিলীপ গম্ভীর হয়ে বললো, “এটা আট টাকা গ্রোস”। ভদ্রলোক বললেন, “এটা আমি ছ’টাকা করে কিনে থাকি”। এবার আর একটা ছিপি তুলে নিয়ে অনেক নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “এটা কত করে দিচ্ছেন”? দিলীপ জানালো, “এটা ছ’টাকা গ্রোস পড়বে”। ভদ্রলোক একটু অবাক হয়ে বিষ্ময় প্রকাশ করে বললেন, “সেকি, কিভাবে দিচ্ছেন? এটাতো আমি ন’টাকা করে কিনি মশাই”। বুঝলাম থলির ভিতর থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ার মতো, ছিপির পেট থেকে কাগজ বেরিয়ে পড়ায় দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল এখন দাদখানি বেল, মুসুরির তেল, হয়ে গেছে। ভদ্রলোকের অসীম ধৈর্য বলতে হবে, এর পরেও কয়েকটার দাম করে কোনটার অনেক বেশি, কোনটার অনেক কম দামের গল্প শুনে হঠাৎই আমাদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে কর্মচারীটিকে একজনের কথা বলে বললেন, “ও এলে বলবে বিকালে আমার আসতে একটু দেরি হবে”। এরপর আমাদের সাথে একটাও কথা না বলে, তিনি চলে গেলেন। পাল গ্রুপ অফ্ ঈন্ডাস্ট্রীজের সেখানেই জীবনাবসান হ’ল।