গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৬

অসিতবরণ চট্টোপাধ্যায়

আশামুকুল

"এই যে দাদারা দিদিরা বোনেরা গরমাগরম  ঘুগনী খান। বিষ্ণুপুরী ঘুগনী। ফ্রেশ এন্ড হাইজিনিক ঘুগনী।  খেয়ে তৃপ্তি পাবেন।  মাত্র পাঁচটাকা। খেয়ে দেখুন দাদারা, তারপর বলবেন। খারাপ হলে পয়সা ফেরৎ।"
বিভিন্ন আওয়াজের মাঝে এই বাক্যগুলো বেশ স্পষ্ট শোনাত। ও উঠলেই যাত্রীরা হামলে পড়ত ঘুগনির জন্য।
ধোপদুরস্ত চেহারা। পরিস্কার করে মুখ সেভ করা। হকার বলে মনেই হত না। আর পাঁচটা হকারের মত না। বাঁ হাতে টিনের চাদরায় লুকোনো উনুনের উপর ঘুগনির হাঁড়ি। গলায় ঝোলানো ছোট্ট ঝুড়ি,তাতে সাজানো থাকতো নারকেল কুচি, পেঁয়াজকুচি ধনেপাতা,গোলমরিচগুড়ো,বাহারী লবনের কৌটো আর প্লাস্টিকের চামচ।
আমি তখন গোয়ালতোড় সেচ দপ্তরের কংসাবতী  সেকশান অফিসে  কর্মরত। প্রায় প্রতি সপ্তাহের উইক এন্ডে বাড়ি যাতায়াতের সুবাদে পুরুলিয়া এক্সপ্রেস ট্রেনে ওকে দেখতাম। প্রথমদিকে ঘুগনী খাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করিনি। তারপর একদিন হঠাৎই পাতার বাটিতে নিয়ে ফেললাম ঘুগনী। ঘুগনীর স্বাদগন্ধ আমাকে আকৃষ্ট করল। একটা নুতনত্বের স্বাদ পেলাম। এরপর যেদিনই যাতায়াত করতাম সেদিনই  অন্যকিছু খাই বা না খাই ঘুঘনী মাষ্ট।
লক্ষ্য করতাম ও বিষ্ণুপুরে ঘুগনী নিয়ে উঠত,যেত খড়গপুর পর্যন্ত। আবার খড়গপুর থেকে দুপুরে টুনটুনি প্যাসেঞ্জার ট্রেনে বিষ্ণুপুর।
আমি একদিন সন্ধ্যেবেলায় কিছু কাজ সেরে কোয়াটারে ফেরার জন্য মেদিনীপুর ষ্টেশন থেকে ট্রেনে উঠলাম। দেখলাম ঘুঘনীওলা ব্যাজারমুখে বসে আছে জানালাধারে। হাঁড়ি বা ঝুড়ি কিছুই নেই ওর সঙ্গে। আর পাঁচটা দিনের মত ওর গলায় আওয়াজ নেই। আমি ওর পাশে গিয়ে বসলাম। ট্রেনে খুব একটা ভীড় নেই। বললাম,
---- কি ব্যাপার? এত চুপচাপ কেন?
ও বলল,
---- ভীষণ মনকষ্টে আছি স্যার।
---- কেন?
---- আজ দুপুরবেলা আমার স্ত্রী এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছে।
----- এতো ভাল খবর। তা তোমাকে এত উদ্বিগ্ন লাগছে কেন?
---- সে তো ঠিক বলছেন স্যার। কিন্তু আমার স্ত্রীর রক্তের গ্রুপ বি নেগেটিভ। আর যে ছেলে জন্মেছে তার রক্ত এ পজিটিভ। কয়েকঘন্টার মধ্যে রিগাল ইঞ্জেকশেন দিতে না পারলে ছেলেটা বাঁচবে না স্যার।
-----বাঁচবে না কেন? ভগবান আছেন, কিচ্ছু হবে না। তা ওরা আছে কোথায়?
----- গোয়ালতোড় প্রাথমিক হাসপাতালে।
চমকে উঠলাম আমি। বললাম,
---- আমি তো ওখানেই থাকি। তোমার শ্বশুরবাড়ী কোথায়? এখন যাবেই বা কোথায়?
---- আমার শ্বশুরবাড়ী ওখানেই স্যার, ঘোষ পাড়ার দত্ত বাড়ীতে। আমি এখন ওখানেই যাবো।
---- ঠিক আছে চলো। আমিও রোড চন্দ্রকোনা ষ্টেশনে নেমে গোয়ালতোড় যাবো। ষ্টেশনে জীপ আসবে আমায় নিতে,তুমি আমার সঙ্গে যেতে পারো।
---- তাহলে তো খুব ভাল হয় স্যার। ইঞ্জেকশেনটা ওখানে পাওয়া যায়নি বলে খড়গপুর গিয়েছিলাম। তার আগে মেদিনিপুরে খুঁজে কোথাও পাইনি। খড়গপুরে পেয়েছি। বরফে মুড়ে তাই নিয়ে যাচ্ছি। জানিনা ছেলেটা কেমন আছে।
কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা রোড চন্দ্রকোনা ষ্টেশনে নেমে গেলাম। ষ্টেশনে গাড়ী অপেক্ষা করছিল। গাড়ীতে চড়ে ড্রাইভার সন্ম্যাসীকে বললাম ---- জলদি চালাও।
মিনিট পনেরোর মধ্যে নয়াবসত কিয়ামাচা পেরিয়ে কাদড়া জঙ্গল লাগোয়া মেন রাস্তার উপরেই গোয়ালতোড় প্রাথমিক স্বাস্থকেন্দ্রে পৌঁছালাম। দুজনে নেমেই সোজা চলে গেলাম মেটারনীটি ওয়ার্ডে। কর্তব্যরত নার্স ইঞ্জেকশেন নিয়ে ডাক্তারবাবুকে কল দিলেন।
ডাক্তারবাবু এসেই বললেন
 
----দুজনের অবস্থাই খারাপ। আন্ডারওয়েট বেবী। তায় রিগ্যাল এবং প্রিম্যাচিয়োর। মা অপুষ্টির শিকার। ইতিমধ্যে বেবীর ঘাড় ষ্টিফ হয়ে গেছে। দেখা যাক কি করতে পারি।
এ কথা বলে ডাক্তার বাবু যা যা করনীয় করলেন। বেডের কাছে গিয়ে দেখলাম বেবী রিকেট গ্রস্ত। খুব ছোট বেবী। বুকের দুধও টানতে পারছে না। মায়ের অবস্থা তথৈবচ। কঙ্কালসার চেহারা। ড্যাবড্যাব করা দুই চোখই সার।
বেরিয়ে এলাম দুজনেই। বললাম 
----চল তোমার শ্বশুরবাড়ি পৌছে দি। কিছু পেটে দিয়ে রাতটা একটু বিশ্রাম নাও। তখন কাল সকালে আসবে।
----না স্যার, খেয়ে দেয়ে এখানেই ফিরে এসে বাইরে শুয়ে থাকবো, যদি কোন প্রয়োজন হয়।
বললাম, 'ঠিক আছে তাই করো। তা তোমার নামটা এখনো আমার জানা
  হয়নি।
---- নির্মল, নির্মল সেন।
বালিবাঁধের ঠিক পরেই ডানদিকে ব্লক অফিস, বাঁদিকে কংসাবতী ইরিগেশান অফিস। আমি নেমে গিয়ে সন্ম্যাসীকে বললাম,
----ওনাকে ঘোষপাড়ায় পৌঁছে দিয়ে
  এসো।
পরদিন সকাল থেকেই মনটা খচখচ করছিল। একবার দেখে এলে কেমন হয় এই ভেবে। নিজেই ভেবে দেখলাম ও তো আমার কেউ নয়। দেখতে যাওয়াটা একটু বেশিই আদিখ্যেতা হয়ে যাবে। ও তো ঘুঘনীওলা বইতো কিছু নয়। ওর বৌ এর বাচ্ছা হয়েছে তো আমার কি?
এইসব সাত পাঁচ ভাবছি। হঠাৎ দেখি নির্মল এসে হাজির। বললাম,
---- সব খবর ভাল আছে তো?
---- হ্যাঁ স্যার, দুজনেই মোটামুটি ভাল আছে। তবে ডাক্তারবাবু
  বলেছেন বিপদ এখনও কাটেনি।
---- সব ঠিক হয়ে যাবে। ওপরওলা আছেন।
---- না স্যার আর যেই থাকুক ওপরওলা নেই। থাকলে তিনি পুরোপুরি
  অন্ধ।
----তা কেন? ভগবানের উপর বিশ্বাস হারাণো পাপ।
----বিশ্বাস রেখে কি হবে স্যার? কিসের পাপ বলতে পারেন? জানেন এই বত্রিশ বছরে একটাই সত্য উপলব্ধি
  করেছি তা হলো গরীব হয়ে জন্মানোটাই পাপ। আর ভগবান? ও তো পাথর। ও খায় না দায়, শুনতে পায়, না দেখতে পায়? আমি বিশ্বাস করি না স্যার।
আমার রাঁধুনি অমল ঘোষ ততক্ষনে চা বিস্কুট নিয়ে এলো। নির্মলকে বললাম চা খেতে। দু তিনদিনের অযত্নলালিত দাড়ি,উস্কোখুস্কো বাবরী চুল দেখে বোঝাই যাচ্ছিল না এ সেই ঘুঘনীওলা নির্মল। বললাম,
---- ভগবানে বিশ্বাস রাখতে হয়। ভগবান যা করেন তা মঙ্গলের জন্যই করেন।
এ কথা বলতেই তপ্তকড়াই এ হঠাৎ জল পড়ার মত ঝাঁঝিয়ে উঠল নির্মল।
---- ভুল বলছেন স্যার। ভগবান আপনাদের জন্য,ভগবান বড়লোকদের জন্য,ভগবান রাজনীতিবিদদের জন্য।
---- এসব কথা হঠাৎ বলছ কেন?
----তবে শুনবেন স্যার আমার কথা? বিচার করবেন তো ভগবান কত মঙ্গলময়?
এমন সময় অমল রুমে ঢুকেই প্রশ্ন করল,
---- বাবু বাজার করতে যাচ্ছি। কি বাজার করব?
বললাম,---- এই ভদ্রলোক আজ এখানেই খাবেন। কাঁচা আনাজ ছাড়াও একটু মাছ নিয়ে আসিস।
নির্মল হাঁইহাঁই করে উঠলো, বলল,
---- না না স্যার। আমাকে আবার হাসপাতাল যেতে হবে।
---- তাতে কি,খেয়েদেয়ে যাবে। অনেক করে বোঝানোর পর সে রাজী হলো। তারপরেই বললাম,
---- হ্যাঁ যা বলছিলে বলো। আমি শুনবো।
নির্মল বলতে শুরু করলো,
---- স্যার আমার বাড়ী বিষ্ণুপুরের কাদাপাড়ায়। বাবা ছিলেন প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক। এখন অবসরপ্রাপ্ত, এবং পক্ষাঘাতগ্রস্ত। বিছানায় শুয়ে থাকেন আর ফ্যাকাসে চোখে উপরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। দুরসম্পর্কিত এক পিসিমা
  আমাদের বাড়ীতে থাকেন। তাঁর একমাত্র পুত্র বৃহস্পতি তাঁকে ঘরছাড়া করেছে। তাই দুমুঠো অন্নের তাগিদে থেকে গেছেন আমাদের বাড়ীতে। বাবার দেখাশুনা পিসিমাই করেন। বাবাকে বাথরুম করানো, তেল মালিশ করা, খাওয়ানো সবকিছুই উনি করেন।
আমরা এক ভাই,এক বোন। আমি ইংলিশ এ মাস্টার ডিগ্রী করেছি বিদ্যাসাগর ইউনিভারসিটি থেকে। পাশ করেছি এগারো বছর আগে।
বোন গ্র‍্যাজুয়েশান করেছে বছরসাত আগে। বোনের জন্মের দুবছরের মধ্যেই মা ক্যান্সারে মারা যান। বিষন্ন হয়ে পড়েন বাবা। তাঁর ঐ মানসিক অবস্থা নিয়ে আমাদের পড়িয়ে মানুষের মত মানুষ করার স্বপ্ন দেখতেন। আমরা দুজনেই বড় হতে লাগলাম। বাবা কোনদিন মায়ের বা সংসারের অভাব বুঝতে দেননি।
বোন বড় হওয়ার আগে পর্যন্ত বাবা ই রান্নাবান্না কাপড়কাচা,বাসনমাজা প্রায় সব কাজই করতেন। তিনি এক স্বপ্নের মধ্যে বাঁচতে চেয়েছিলেন। আমরা বড় হব, চাকরী করব, নিজের পায়ে দাঁড়াবো,বাড়ীতে স্বচ্ছলতা আসবে। আরও কত কি।
আমি মাস্টারস করে ইন্টারভিউ এর পর ইন্টারভিউ  দিতে লাগলাম। লিখিত পরীক্ষায় খুব ভালভাবে পাশ করি তো মৌখিকে ডাঁহা ফেল। আমার মামা কাকা নেই আমার কোন আত্মীয় এম এল এ, এম পি, বা মিনিষ্টার নেই। লিখিত পরীক্ষায় সত্তরের মধ্যে আটষট্টি পেয়ে প্রথম স্থান পাই কিন্তু পাঁচজন মৌখিক পরীক্ষকের কাছ থেকে মাত্র দুই। অথচ যে কিনা লিখিত পরীক্ষায় পঁঞ্চান্ন সে মৌখিকে আঠাশ পেয়ে দিব্য চাকরী হাতিয়ে নেয়। একবার তো একজন বলেই ফেললেন পাঁচলাখ দিতে পারলেই চাকরী। বাবা ওই পরিমান টাকা স্বপ্নেও দেখেননি।  আমার চাকরী  হলোনা, কেননা ভগবান মঙ্গলময়।
ভেবেছিলাম বোনটার একটা কিছু হবে। বোনটা ছিল অসম্ভব বুদ্ধিমতী। অঙ্কে ইউনিভারসিটির টপার ছিল। সেও চেষ্টা করছিল একটা চাকরীর। কিন্তু বয়সের উন্মাদনায় প্রেমে পড়ল এক ছেলের। ছেলেটা দেখতে খারাপ ছিল না। কিন্তু মুখোশের আড়ালে ছিল এক বীভৎস মুখ। চাকরীর প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে যায় এক নকল অফিসে। বোন বুঝতে পারেনি। ছেলেটা বলেছিল ওটা তার বসের কোম্পানি।  দুমাস সেখানে চাকরী করল আটহাজার টাকা মাস মাইনায়। বাড়ীতে  তখন আমাদের খুশির বন্যা। দুবেলা দুমুঠো অন্নের যোগানেই আমরা খুশি ছিলাম। বাবার ঔষধের খরচা, জামাকাপড় সবেরই জোগান দিত বোন। আমরা জানতাম না ওই টাকার বিনিময়ে বোন তার দেহটাকে বাজী রেখেছে।
হঠাৎ দুমাস পর ও বলল তাকে দিল্লীর গাজিয়াবাদের অফিসে বদলী করেছে। শুনে বাবা ভাবলেন নিশ্চয়ই পদোন্নতি হয়েছে। তিনিও বলেছিলেন ভগবান মঙ্গলময়, যা করেন মঙ্গলই করেন। আপনি কি বলেন স্যার?
মঙ্গলময়ের ইচ্ছায় বোন চলে গেল গাজিয়াবাদ। এখানে ছিল দুজন ক্লায়েন্ট আর ওই অফিসে অগুনতি  নিত্যনতুন ক্লায়েন্ট। টাকার পাহাড়।
চারমাস পরে বোন এল বাড়ীতে। বাড়ীর চৌকাঠের ওপার থেকেই বাবাকে প্রণাম করে বলল,
 
---- বাবা পবিত্র চৌকাঠ পেরিয়ে আজ আর তোমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করার মত পবিত্রতা আমার অবশিষ্ট নেই তাই দুর থেকেই প্রণাম করছি। সেই সঙ্গে রেখে গেলাম এই দু লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা। আমি নেক্সট ফ্লাইটেই দিল্লী চলে যাচ্ছি।
বাবা নির্বাক হয়ে রইলেন কিছুক্ষন। সম্বিত ফিরে পেলেন যখন দেখলেন সামনে তাঁর আদরের মেয়ে নেই,গাড়ী চড়ে ফিরে যাচ্ছে নিজের ঠিকানায়। সামনে পড়ে আছে দু লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকার তিনটে বান্ডিল।
বাবা হতভম্ব হয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে। আমি বাড়িতে ছিলাম না। বাবা কতক্ষন মাটিতে পড়েছিলেন জানিনা। আমি বাড়ীতে ঢুকে দেখি, বাবা মেঝেতে পড়ে আছেন, মুখটা বেঁকে গেছে, শরীরের বামদিক অবশ হয়ে গেছে। একটা গোঁঙানির শব্দ পেলাম। চৌকাঠের পাশে পড়ে আছে তিনটে টাকার বান্ডিল। যে পরিমান টাকা একসঙ্গে আমরা চোখে দেখিনি।
ভগবান মঙ্গলময়,কি বলেন স্যার?
মনে হচ্ছিল ওর চোখে আগুনের গোলা। মুখে একরাশ তাচ্ছিল্যের অভিব্যক্তি।
 
একটু দম নিয়ে আবারও বলতে শুরু করল নির্মল।
বুঝলাম বাবা কিছু কথা বলতে চাইছেন। পারছেন না। জড়িয়ে যাচ্ছে তাঁর কথা। কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। আমি ঘাবড়ে গেলাম। কোত্থেকে এত টাকা এল, কেনই বা এল কিছুই বোঝা গেল না।
বাবাকে ধরাধরি করে বিছানায় শোয়ালাম। টাকার বান্ডিলগুলো বাবার ঈশারা মত একটা টিনের বাক্সতে রেখে দিয়ে কোবরেজ বাড়ী গেলাম দৌড়ে। ওনি এসে দেখলেন, কিছু ভেষজ বড়ি আর মালিশ তেল দিয়ে চলে গেলেন। যা আজও চলছে নিয়মিত।
আমার রান্নার হাতেখড়ি বোধহয়  সেদিনই হল। ফেনভাত আর আলুভাতে। নিজের রান্না করা খাবার আর কাউকে খাওয়ানো যে কত আনন্দের হতে পারে সেদিনই বুঝলাম। 
হাত পুড়িয়ে রান্না বেশীদিন করতে হয়নি। মাসখানেকের মধ্যেই ছাতনার পিসিমা এলেন বাড়ীতে। বললেন,
---বাছা তোর ভাই বেস্পতি আমাকে বাড়ীছাড়া করেছে তাই তোদের শরণাপন্ন হলুম বাবা। আমার কিচ্ছু দরকার নেই বাবা, দুগ্রাস ভাত আর একটু মাথা গোঁজার আশ্রয় চাই বাবা। আমি সব কিছু করে দেব।এমনকি দাদার সেবাটাও করে দেব।
বেস্পতি ওরফে বৃ্হস্পতি মল্লিকের কান্ডকারখানা শুনে তাজ্জব বনে গেলাম। যেখানে আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেখানে একজনের চাপ নেওয়া কি কঠিন সেটা পেনশানভোগী সংসারীরা খুব ভালই উপলব্ধি করতে পারবেন। তাছাড়াও টিভি সিরিয়ালের বিধবা পিসিমাদের কান্ডকারখানা দেখেছি বলে দোনামনা করছিলাম, কিন্তু বাবার মাথা নাড়া দেখে সম্মতি দিলাম।
পিসিমা সংসারের হাল ধরলেন। আমি হকারী ধরলাম। সহজ কাজ ঘুগনী বেচা, তাছাড়া এই লাইনে তখনো কোন হকার ঘুঘনী নিয়ে ব্যবসায় নামেনি। অতএব ছাতনার পিসিমার তৈরী ঘুঘনী  হকারী করে প্রথমদিনেই বাজীমাত করলাম।
কিছুটা বাবা সুস্থ হতেই টাকার ব্যাপারটা জানতে চাইলাম। বাবা শুনতে পেতেন, বুঝতেও পারতেন কিন্তু কথা বলতে পারতেন না। তাই স্লেটে লিখে দিলেন " ওই টাকা তোমার বোন তৃপ্তির পাপের টাকা, ওই টাকার একপয়সাও ছোঁবে না। ওই টাকা বিষ্ণুপুরের কোন অনাথআশ্রমে দিয়ে দিও। তোমার পিসি থাকুক। ওর অমর্যাদা করো না। তুমি যেমন হকারী করছ করো। কোন কাজই ছোট না। আরেকটা কথা বলে রাখি বছরখানেক বাদে গোয়ালতোড়ের ঘোষপাড়ার নবীন দত্তের মেয়ে সুধাকে বিয়ে কোর। ওরা খুব গরীব, কোন পণটন নিও না। ওরা গরীব হলেও সত্যিকারের মানুষ। অনাড়ম্বর বিয়ে করবে।
একবছর পেরোনোর পর স্যার বাবার কথামত  আমি দত্তবাড়ির সুধাকেই বিয়ে করলাম। বিয়ের পর বেশ ভালই চলছিল। সুধা বাড়ীতে সংসারের প্রায় সব চাপই হাসিমুখে কাঁধে নিয়ে নিলো। এমনকি পিসিমার ভারাভারও নিল। ওর রান্নার হাতটাও ভাল। জানেন সুধার তৈরী ঘুঘনী  দুতিনটে ষ্টেশানের মধ্যেই এক হাঁড়ি শেষ হয়ে যেত। দেড় বছর ভালই ছিলাম স্যার। চাকরী না পাওয়ার ব্যাথা প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। কিন্তু_____
একদিন সুধা বললো সে নাকি কনসিভ করেছে। পিসিমার সে কি আনন্দ। কালী দুর্গার ফটোতে মাথা ঠুকে বললেন 
----ভগবান মঙ্গলময়। এবার মা দুর্গা
  মুখ তুলে চেয়েছেন।
খুশির ঝরণাধারায় ভরে গেলো ঘর। যেহেতু সুধা একা হাতে বাড়ীটা সামলাতো তাই খাটাখাটনিও বেশী হওয়ার কথা চিন্তা করে আমরা সকলে মিলে সাব্যস্ত করলাম, সন্তান জন্মানো অবধি সুধা বাপের বাড়ীতেই থাকুক।
সেইমত সে বাপের বাড়িতেই থাকতো, তখন বুঝিনি বাপের বাড়ীর নিদারুণ দারিদ্রতার কারণে সে অপুষ্টিতে ভুগবে। নবাগত আসছে জেনে আমিও বেশী পয়সা রোজগারের ধান্দায় থেকে খুব বেশি সময় দিতে পারিনি ওকে। ওর প্রতিবেশীরা বলত সুধার ছেলেই হবে। ছেলে হলে নাকি মেয়েরা একটু শুকায়, হাড়গিলে হয়। এত সব শুনেও আপনি কি বলবেন স্যার, ভগাবান মঙ্গলময়,ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন।
আমি কি বলবো বা আমার কি বলা উচিৎ  ভেবে পেলাম না। শুধু বললাম
---- আপনি স্নান করবেন? আলাদা গামছা আছে। কুয়োপাড়ে স্নান করে নিতে পারেন।
----না স্যার। স্নান করার দরকার নেই। আজ তিনদিন বিক্রিবাটা করিনি। ভাবছি কি করবো। কি করে সব সামাল দেব। তাছাড়া খেয়েদেয়ে এখুনি হাসপাতাল পৌঁছাতে হবে।
আমি আর জেদাজিদি করিনি। 
আমি স্নান সেরেই অমলকে হাঁক পাড়লাম খাবার দেওয়ার জন্য। নির্মল তৃপ্তি করে খেলো। হাতমুখ
  ধুয়েই হাসপাতাল যাওয়ার জন্য ব্যাস্ত হয়ে পড়ল।
আমি ওকে পাঁচশ টাকা দেব ভেবে ওকে বললাম,
---- নির্মল তুমি এই পাঁচশ টাকা হাতের কাছে রাখো। দরকারে কাজে লাগবে।
---- না স্যার টাকা নিতে পারবো না।
করুণা নয় স্যার, আপনি ব্রাহ্মন সন্তান, আমায় আশীর্বাদ করুণ যেন এই পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারি। ভগবান যদি মঙ্গলময় হয়ে থাকেন তাহলে টাকার দরকার হবে না।
বলেই হনহন করে হাঁটতে শুরু করলো। ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
পরদিন ওর সঙ্গে আর দেখা হয়নি। তার পরদিন আমার মনটা আনচান করছিল ওর সঙ্গে দেখা করার জন্য। শেষমেশ সন্ধ্যের গোড়ায় গোড়ায় মোটরবাইক করে হাসপাতালে পৌঁছালাম। অনুমতিক্রমে ওয়ার্ডে ঢুকে নির্দিষ্ট বেডের কাছে গিয়ে দেখি তৃপ্তি নেই। গা টা ছমছম করে উঠল। একজন কর্তব্যরতা নার্সকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম,
---- সিস্টার ১৪ নং বেডের তৃপ্তি সেন কোথায়?
---- আপনি ওর কে হন?
 
---- ওর স্বামীর বন্ধু।
---- আপনি কিছু জানেন না?
----না।
----গতকাল রাত দুটোয় তৃপ্তি সেন মারা গেছেন। বেবী এখনো বেঁচে আছে। ওর মামাবাড়ীর লোকেরা নিয়ে গেছে। ডেডবডি বিষ্ণুপুর নিয়ে গেছেন নির্মলবাবু।
চমকে উঠলাম আমি। বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। চুপচাপ বেরিয়ে এলাম। রাত্রে কোনমতেই ঘুম এলো না। বারবার কেন জানিনা নির্মলের বৌ তৃপ্তির ফ্যাকাসে মুখটা আর ড্যাবড্যাব করা চোখ দুটো মনে পড়ছিল। সেই সঙ্গে চিঁ চিঁ করা শীর্ণকায় শিশুটাকে। কি হচ্ছে ওর? কে জানে।
একটা ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কখন সকাল হল জানিনা। স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে অফিসের কাজে মন দিলাম। কয়েক দিনের মধ্যেই ভুলে গেলাম সবকিছু। 
এক দেড়মাস পেরিয়ে গেল। চার পাঁঁচ বার বাড়ি যাতায়াত করলাম। ঘুঘনীওলা নির্মলকে আর দেখতে পাইনি। শুনতে পাইনি সেই কন্ঠস্বর। "এই যে দাদারা,দিদিরা বোনেরা, গরমা গরম বিষ্ণুপুরী ঘুঘনী আছে, দেবো নাকি?"
ও কোথায় জানার কৌতুহল অদম্য কিন্তু জানার উপায় নেই। একদিন গোয়ালতোড়ের সারেঙ্গা মোড়ে অনিলের চায়ের দোকানে বসে আছি বিকেলবেলা। হঠাৎ চোখে পড়ল গ্লাস কাপ ধোয়া ছেলেটার দিকে। কোথায় যেন দেখেছি। মনে পড়ল এ সেই ছেলে, যে তৃপ্তির জন্য হাসপাতালে খাবার নিয়ে যেত আর হাসপাতাল বারান্দায় পড়ে থাকতো। তৃপ্তির ভাই অর্থাৎ নির্মলের শ্যালক। ওকে ডেকে বললাম,
---- এই তুই নির্মলের শালা না?
---- হ্যাঁ বাবু।
---- তোর জামাইবাবু
  কোথায় রে?
----জানিনা বাবু। দিদির দেহ যেদিন নিয়ে গেল সেদিনই দিদির মরদেহ দেখে পক্ষাঘাতগ্রস্ত তাউই মশায় হার্টফেল করে মারা গেলেন। একই দিনে দুজনের শ্রাদ্ধকার্য হলো, তারপরদিন থেকেই আর জামাইবাবুর খোঁজ পাওয়া যায়নি। ভগবানের ইচ্ছায় ভাগ্নে আমাদের বাড়ীতে ভালই আছে। দুলেপাড়ার এক দুলেবৌ ওকে প্রতিদিন দুধ খাওয়ায়,পরিচর্যা করে বিনিপয়সায়।
আমি মনে মনে বললাম,'আবার ভগবানের ইচ্ছায় _
পাঠকদের উদ্দ্যেশে বলি, যদি কোনদিন কেউ সুঠাম সপ্রতিভ বাবরী চুল, টিকোলো নাক, কপালের বাঁদিকে কাটাদাগ যুক্ত ঘুগনীওলাকে কোন ট্রেনে বা বাসে হকারী করতে বা বিড়বিড় করতে দেখেন তাহলে প্লিজ তাকে বলে দেবেন " তার ছেলে 'আশামুকুল' বেঁচে আছে,সুস্থ আছে।"