গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৬

বিশ্বজিৎ সরকার

 সুধা

শেষরাতে চুপিসারে আধাঁর নেমেছিল রাত জোনাকির বুকে...শিকারি পাখিটা তখন বোধ করি বিগত রাতের ব্যর্থতা আর আজকের উল্লাসে,আগামি কালের উৎকণ্ঠাতে ক্লান্ত হচ্ছিল... আজ আর তার কোনো তারা নেই বাসায় ফেরা নিয়ে... সে জানে অন্ধকার ফিকে হতে এখনও অনেক টা সময় লাগবে... আজ আর যেহেতু আর শিকার ধরার তারা নেই সে চাইছিল  বাকি রাতটুকু একটু উপভোগ করা যাক... এমন সুযোগ তো আর রোজ বারবার আসে না... যামপ্রহরী শেয়াল দু-প্রহরের জানান দিয়ে গেলো তীব্র তীক্ষ্ণ সুরে

একগাছা দড়ি হাতে চুপিসারে একটা  গাছের নিচে এসে দাঁড়ায় সুধা....মানুষের মতো দেখতে লাগছে গাছটাকে এখন...  যেন সে দীর্ঘকালের নিঃসঙ্গ কেউ হাত বাড়িয়ে আছে আপনজনের অপেক্ষাতে... কাউকে পেলেই প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে রাখবে বুকের ভিতর.. কোনোদিনও তাকে দূরে যেতে দেবে না... গাছটার দিকে তাকিয়ে সুধা ভাবতে থাকে  তার বিগত জীবনের পদ্মপাতা থেকে ঝরে পড়া কয়েক ফোঁটা স্মৃতি... সেও যেন অনেকটা একই রকম ভাবে কখন যেন ভালবেসে হাত বাড়িয়ে ৠতব্রতকে আকরে ধরে বাঁচতে চেয়েছিল... ৠতব্রত যাকে সে ব্রত বলে ডাকত.. যাকে সে প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিল... সেই কিনা... না থাক আজ  আর সে ভাবতে চায় না ঐ সব ...কি হবে আর ওসব ভেবে... তার এখন সময় শেষ হতে চলেছে.. আর তো কিছুক্ষণ মাত্র তারপর সে একটা প্রকৃত মাংস পিন্ডে পরিণত হবে..ঠিক সেরকমই মাংসপিন্ড যে রকম সে ছিল ব্রতর কাছে ...দড়ির ফাঁসটা গাছের ডালে ছুড়ে  দেয়...আচ্ছা অনেকেই  শুনেছি মরার সাথেও ওই সব করে...শব সাধনা না কি একটা বলে বেশ.. আচ্ছা ব্রতও কি  তবে ওর বন্ধুদের সাথে সব সাধনায় মেতে উঠবে...দড়ির ফাঁসটা ঠিক করতে করতে সে ভাবতে থাকে..... ভালোই হবে... অট্টহাসি হেসে ওঠে  সুধা... শিকারি পাখিটা হঠাৎই  ডানা ঝাপটিয়ে প্রাণপনে বাসায় ছোটে ... হা হা হা!!!  ভালোই হবে... ব্রতদের কোন চাপ থাকবে না ... কেননা মৃতরা কোন চিৎকার করে উঠেছে বলে কেউ জানে না... অবশ্য সে চিৎকার করতেই বা পেরেছিল কখন!...মুখ তো বাধাই ছিল.. এর পর তো  সে গোঙানি টুকুও করতেপারবে না.. কষ্ট করে হাত-পাও বাধতে হবে না..... ভালোই হবে ওর পলিটিক্যাল বাপের মনে কোনো টেনশন কাজ করবে না.. নিশ্চিত মনে সমাজকে সেবা করতে পারবেন... মৃতদেহ তো আর  থানা পুলিশ করতে যাবেনা... পলিটিকাল পার্টির নেতাদের এই এক গঙ্গা স্নান.... ভোট বাক্সে প্রভাব না ফেললে সব পাপ কিছু পাপ মুক্ত...ভালোই হবে তাকে দিয়ে সব রাজনৈতিক দলের ভোট বাক্স ভরানোর প্রণামী আদায় করা তাকে সহ্য করতে হবে না.. আবার সে হেসে ওঠে ...দড়ির ফাঁস টা শক্তপোক্ত ভাবে আকড়ে ধরে আছে গাছটা.. শেষবারের মতো  সুধা দেখে নিতে চায় মায়ের কোল থেকে দূরে চলে যাবার শিশুর মত.. . আকাশের কালো মেঘ একটু আধটু পর্দা  সরিয়ে হাল্কা পূর্ণিমার আলোর ঝিলিক দেখা যাচ্ছে়... সেই অল্প আলোতে সে স্পষ্ট দেখতে পারল একটা ইঁদুর... একটা ছোট্ট-খাট্টো ইদুর আজ আর পালাচ্ছে না...হয়তো সে পালালেও মরবে... তাই সামনে থেকে মৃত্যু থেকে মৃত্যু কে দেখার বাসনায় সে... পেঁচাটা হতভম্ব... এরম তো কোনো দিন হয় না... অবাক হয় সুধা...তার চোখ চলে যায় গাছে আটকে থাকা দড়ির ফাসে... না ভাবতে থাকে সে.. না নিজের শরীরটাকে সে আর এখন মাংসের পিন্ডের টুকরো ভাবতে দিতে চায় না সে...সে একজন নারী ... তার শরীরের বাইরেও তার নারীত্বের পরিচয়টাই সবচেয়ে বেশি... যার মূল্য পয়সা দিয়ে মাপা যায় না...নারীত্ব, নারীর  মূল্য তাকে প্রমাণ করে দেখানো বাকি আছে এখনো ... 

সে হাঁটতে থাকে যে পথে সে এসেছিল.. শুধু এখন তার হাতে নেই দড়িগাছা... অনেকটা পিছনে তখন  একটা দড়ি ফাঁস হয়ে বিস্ময়ে হাঁসফাঁস করতে থাকে গাছের ডাল থেকে...কখন যেন মেঘ পুরো সরে গেছে... সমস্ত জগৎ-সংসার পূর্ণিমার জোৎস্নাতে ভেসে যাচ্ছে... হঠাৎ  যাম-প্রহরী শেয়াল শেষ প্রহরের ডাক দিয়ে যায়