গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৬

সুবীর কুমার রায়

মহাদেব বাবুর মাহাত্ম্য

১৯৮০ সালের আগষ্ট মাসের একটা বিকেল, আমি আমার দুই বন্ধু, দিলীপ ও অমলের সাথে চাম্বা থেকে ভারমোর এসে পৌঁছলাম। উদ্দেশ্য ভারতীয় কৈলাস, মণিমহেশ দর্শন। শুনেছিলাম দেশ ভাগের আগে যাঁরা ঢাকা, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল, চট্টোগ্রাম, ইত্যাদি জায়গায় বংশানুক্রমে বসবাস করতেন, দেশ ভাগের পর তাঁরা স্বভূমি ছেড়ে নিরাপদ ভারতবর্ষে এসে পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করেন। মহাদেবের নিজস্ব বাসভুমি কৈলাস যখন চৈনিকরা অধিগ্রহণ করে, তখন আমাদের মহাদেববাবু তাঁর সৈনিক, নন্দি ও ভৃঙ্গিকে বগলদাবা করে কৈলাস থেকে পলায়ন করে মণিমহেশে ঘাঁটি গেঁড়ে বসেন। তাই মণিমহেশকে ভারতীয় কৈলাস বলা হয়। মহাদেবের মতো একজন শক্তিশালী দেবতা কেন চৈনিকদের কঠোর হাতে দমন না করে, স্বপরিবারে ভিটা ছেড়ে পলায়ন করলেন বলতে পারব না, তবে একবার সরজমিনে বাবার নতুন বাসস্থানটি দেখার, মনে বড় সাধ জাগলো।
যাবার আগে ভ্রমণ সংক্রান্ত বইতে মণিমহেশের মাহাত্ম্য, ও ভারমোরে প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের কর্মী, শান্তি রঞ্জন রায় সম্বন্ধে অনেক তথ্য, অনেক গল্প পড়ে যাবার সুযোগ হয়েছিল। জানা গেল শান্তিবাবু মণিমহেশ যাত্রীদের নানাভাবে সাহায্য করে থাকেন। যাবার পথে চাম্বাতেই কয়েকজন মণিমহেশ ফেরত অভিযাত্রীর কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, মণিমহেশের পথে এই মুহুর্তে আর কোন যাত্রী নেই। শান্তিবাবুর ডেরার সন্ধানও পাওয়া গেল, তাঁকে ভারমোরের স্টুডিও কৈলাসে পাওয়া যাবে। সম্ভবত তিনি কাজের ফাঁকে স্টুডিওটিও চালান।
ছোট্ট জায়গা, বাস থেকে নেমে স্টুডিও কৈলাস খুঁজে নিতে অসুবিধা হবার কথা নয়। ডান হাতে ছোট্ট দোকান, কিন্তু দোকানের মালিক দোকানে নেই। বাম দিকে একটা ছোট মন্দির বা আশ্রম জাতীয় কিছু, সেখানে কয়েকজন দাঁড়িয়ে ও বসে। তাদের একজনকে দেখে মনে হ’ল বাঙালী, কাজেই শান্তিবাবু হলেও হতে পারেন। তাঁদের দিকে হাত তুলে শান্তিদা বলে দু’বার চিৎকার করতেই একজন ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, যদি এই ভদ্রলোক শান্তিদা হন, তাহলেতো মিটেই গেল, আর না হলে ওঁর কাছেই শান্তিদার খোঁজ নেওয়া যাবে। যদিও জানিনা শান্তিদা এরকম এক পান্ডব বর্জিত জায়গায় এখনও কর্মরত আছেন কী না।
ভদ্রলোক আমাদের কাছে এসে প্রথমেই বললেন— “আপনাদের তো ঠিক চিনলাম না”? অর্থাৎ ইনিই দি গ্রেট শান্তিদা। আমি একমুহুর্ত সময় নষ্ট না করে বললাম, আমরা গত বছরের আগের বছর এসেছিলাম, মনে নেই? উত্তরে তিনি শুধু  বললেন— প্রতি বছর এত লোকের সাথে আলাপ হয় যে, সবাইকে মনে রাখা যায় না। আমাদের সাথে দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের সুবাদেই বোধহয়, তিনি আমাদের তিনজনকে তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন। চা তৈরী করে খাওয়ালেন, নিজের জীবনের অনেক কথা বললেন। ছোটবেলায় তিনি তাঁর বাবার সাথে ঝগড়া করে, বাঁকুড়া না পুরুলিয়ার বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে উড়িষ্যার এক ভদ্রলোকের কৃপায় লেখাপড়া শিখে, বড় হয়ে চাকরি নিয়ে এখানে এসে হাজির হন। তাঁর  একটি ছোট্ট মেয়ে আছে, তার নাম তিনি সন্তোষি রেখেছেন, ইত্যাদি অনেক কথা। যাইহোক, তিনি রাতে থাকার হোটেল ও কৃষাণ নামে একটি ছেলেকে কুলি কাম গাইড হিসাবে ঠিক করে দিলেন। আমরা হোটেলে গিয়ে উঠলাম।
পরদিন সকালে আমরা ধানচৌর উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে বিকালের দিকে ধানচৌ এসে পৌঁছলাম। রাতটা সেখানেই একটা তাঁবুতে কাটিয়ে পরদিন সকালে মণিমহেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। শুনলাম মণিমহেশের মুল মন্দিরটি ভারমোরে অবস্থিত। জন্মাষ্টমী থেকে রাধাষ্টমী পর্যন্ত সময়টাতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে আসেন। ভারমোর থেকে মণিমহেশে ছড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। এর সত্যাসত্য আমার জানা নেই, জানার আগ্রহও বিশেষ নেই।
একসময় নির্বিঘ্নে মণিমহেশ এসে পৌঁছলাম। জলাশয়ের পাশে পাথরের মাঝে ইতস্তত ত্রিশুল পোঁতা, সেখানেই কিছু কঞ্চি জাতীয় কাঠি ও ত্রিশুলের সাথে ঘন্টা বাঁধা জায়গায় দেবতার স্থান। সম্ভবত একজন পুরোহিতকে ঘিরে পাঁচ-সাতজন দেহাতি মানুষ বসে। পুরোহিত ভদ্রলোক তাদের মণিমহেশের মাহাত্ম্য ও গল্প শোনাচ্ছেন। আমি হিন্দী বড়ই কম বুঝি, তবু যেটুকু বোধগম্য হ’ল, মণিমহেশ সম্বন্ধে ভদ্রলোকের বক্তব্যের সাথে আমার পড়া গল্পের কোন মিল খুঁজে পেলাম না। শেষে আমি আমার বিশুদ্ধ হিন্দীতে বললাম, “ইয়ে বাত সাহি নেহি”। পুরোহিত ভদ্রলোক একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে চুপ করে গিয়ে, হয়তো একটু বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। বিশ্বস্ত অনুচরেরাও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। এবার আমার বিপদে পড়ার পালা। ভদ্রলোককে আমার বক্তব্য বুঝিয়ে বলতে গেলে দোভাষী লাগবে। তবু বাধ্য হয়ে আবার বলতেই হ’ল, “আপ যো কাহানী বাতাতে হ্যায় ও সাহি নেহি”।
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে গুম হয়ে থেকে বেশ অবজ্ঞার সাথেই জানতে চাইলেন আসল ঘটনা তাহলে কী। এবার আমার ঘামার পালা। গল্পটা বেশ বড়, শুধু বড়ই নয়, কাক, সাপ, ভেড়া, মেষপালক, ইত্যাদি অনেক চরিত্র আছে। কিন্ত ওখানে খাল কাটার সম্ভাবনা না থাকলেও, বিপদরূপী কুমির আমি নিজেই ডেকে এনেছি। কাজেই হিন্দীতে ঐ গল্প বলা আমার কম্ম না হলেও, পিছিয়ে আসারও আর কোন সুযোগ নেই।
অগত্যা আমার নিজস্ব হিন্দীতেই গল্পটা বলতে শুরু করলাম। আমার সবথেকে বড় অসুবিধা, আমি হিন্দীতে কোন বাক্যই শেষ করতে পারি না। প্রতিটা বাক্যই মাঝপথে এসে হোঁচট খেয়ে থেমে যায়, তখন আবার ফিন রামসে শুরু করতে হয়। যাইহোক, কৈলাস ছেড়ে মহাদেব একপ্রকার পালিয়ে এসে মণিমহেশে বসবাস শুরু করেন। এটা কেউ জানতেও পারে নি। একদিন এক মেষপালকের একটি মেষ হারিয়ে গেলে, হারানো মেষের সন্ধান করতে করতে সে মণিমহেশ গিয়ে হাজির হয় এবং মহাদেবের সাক্ষাৎ পায়। মণিমহেশে আসার কারণ শুনে মহাদেব তাকে বর দিয়ে বলেন যে, সে তার বাসস্থানে ফিরে গিয়ে যতগুলি মেষের কামনা করবে ততগুলি মেষ সে পাবে, তবে একটি শর্তে। মহাদেব যে মণিমহেশে আছেন, একথা সে কাউকে জানাতে পারবে না। মহাদেবের কথায় মেষপালক বাড়ি ফিরে এসে অনেক মেষ কামনা করে এবং মহাদেবের কথামতো পেয়েও যায়। রাতারাতি সে অনেক মেষের মালিক হয়ে যায়। কিন্তু সে মহাদেবের কথা রাখে নি। সে একটা সাপ, একটা কাককে নিয়ে আবার মণিমহেশে যায়। মহাদেব তাকে দেখে রুষ্ট হয়ে শাপ দেন। মহাদেবের অভিশাপে উপস্থিত সকলেই পাথর হয়ে যায়।
অনেক বছর আগের ঘটনা, মেষপালকের সাথে বোধহয় আরও কেউ ছিল, আমি ঠিক স্মরণ করতে পারছি না। তবে আমার সাথে ঐ ভদ্রলোকের গল্পের বিন্দুমাত্র মিল না থাকলেও, গল্পের চরিত্রগুলো, অর্থাৎ সাপ, কাক, ভেড়া ইত্যদি ও তাদের পরিণতি প্রায় একই ছিলো। তবে গল্প বলার গুণে না হিন্দী বলার গুণে বলতে পারব না, বাবারও যেমন বাবা থাকেন, আমাকেও বোধহয় সেরকম আধ্যাত্মিক জগতের একজন মহাপন্ডিত ভেবে, স্বয়ং মহাদেবের খাসতালুক থেকে আসছিও ভেবে থাকতে পারেন, আমাকে অতি বিনয়ের সাথে বললেন “আপ বৈঠিয়ে সাহাব”। অতএব বসতেই হল।
ভদ্রলোক আমাদের আম লজেন্স্ ও বরফ প্রসাদ দিলেন। এবার আঙ্গুল তুলে দুরের পাহাড়ের দিকে দেখিয়ে আমাদের  সকলকে পাহাড়ের গায়ে কাক, সাপ ইত্যাদির পাথর হয়ে যাওয়া মুর্তি দেখাবার চেষ্টা করলেন। এতদুর থেকে জ্যান্ত সাপ বা কাক দেখাই অসম্ভব, তো দুরের পাহাড়ের গায়ে একই রঙের পাথরের সাপ বা কাক দেখা, তবু আমার মতো সম্মানীয় ও শিববিশারদ ব্যক্তিকে বাধ্য হয়েই আলাদা আলাদা ভাবে কাক, সাপ, ভেড়া, মেষপালক, প্রত্যেককে দেখতে  পেয়ে উল্লাসিত হতেই হ’ল। প্রত্যেক জায়গা থেকে কিছু না কিছু স্মৃতি চিহ্ন হিসাবে নিয়ে আসার অভ্যাস, তাই ভদ্রলোককে খুব নরম গলায় বললাম, “ইয়ে যো ত্রিশুল হায় না, উসমে শিউজীকা স্পর্শ্ হ্যায়। মেরা পিতাজী মাতাজী ইধার আ নাহি পায়েগা। হাম এক ত্রিশুল লে যায়, তো উনলোগ ভী শিউজীকা স্পর্শ্ পায়গা। এক ত্রিশুল লে যাঁউ? শুনে ভদ্রলোক যেন একটু লজ্জাই পেলেন। তিনি খুব মিষ্টি সুরে বললেন—“লে যাইয়ে সাহাব”। আমি একটা বেশ শক্তসমর্থ ত্রিশুল তুলে নিয়ে গুছিয়ে বসলাম।
এবার দিলীপের জন্য একটা ম্যানেজ করতে হবে। একটু সময় নিয়ে দিলীপকে দেখিয়ে আবার শুরু করলাম, “ইয়ে যো হামারা বন্ধু হায় না, উনকো পিতামাতা হররোজ শিউজীকে লিয়ে জীবন উৎসর্গ্ কিয়া। উনকো পিতামাতাকে লিয়ে আউর এক ত্রিশুল লে যাঁউ”? আমার ঠাকুর দেবতায় বিন্দুমাত্র আস্থা না থাকলেও, দিলীপের বাড়ির লোকজনের ভগবানের ওপর ভীষণ আস্থা। তবে আমার ঐ বক্তব্যের যে প্রকৃত অর্থ কী দাঁড়িয়েছিল, আজও ভাবলে হাসি পায়। ভদ্রলোক এতটুকু সময় নষ্ট করে আমায় বিব্রত না করে বললেন, লে যাইয়ে জনাব। দিলীপকে একটা ত্রিশুল তুলে নিতে বললাম। প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, এই ঘটনার বহু আগেই দিলীপের বাবা ইহলোকর মায়া ত্যাগ করে সম্ভবত শিবলোকেই চলে গেছিলেন। এবার আমার কদর বুঝে অমুমতির তোয়াক্কা না করে অমলকেও একটা ত্রিশুল আমিই তুলে নিতে বললাম। অমল ত্রিশুল নিয়ে কাকে খুঁচিয়ে মারবে জানিনা, তবে উৎসাহের আতিশয্যে একটা করে ত্রিশুল উপড়ে তুলছে, আর নাঃ এটা ভালো নয়, নাঃ এটা কিরকম বাঁকা মতো, ইত্যাদি বলে সেগুলোকে মাটিতে শুইয়ে রাখছে। শেষে পছন্দমতো একটা জুতসই ত্রিশুল তুলে নিয়ে এসে আমাদের পাশে বসে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেটা পরখ করে দেখতে শুরু করলো। আমি তাকে আর নতুন করে ত্রিশুল উৎপাটন থেকে বিরত করে, একটু এদিক ওদিক ঘুরে, ধানচৌ ফিরে আসার জন্য তাদের কাছ থেকে বিদায় চাইলাম।
এবার আমাদের সাথে আর এক ভদ্রলোক সস্ত্রীক বেড়াতে এসেছেন। তাঁরা চাম্বায় আমাদের অপর সঙ্গীদের সাথে রয়েছেন। ফেরার পথে একটু নীচ থেকে তাঁর জন্যও একটা ত্রিশুল সংগ্রহ করা হ’ল। ত্রিশুল হাতে অনেক পথ পার হয়ে, ধানচৌ এর তাঁবু থেকে মালপত্র নিয়ে সেই পুরাতন পথ ধরে এঁকেবেঁকে একসময় ভারমোর এসে পৌঁছলাম। শান্তিদার সাথে দেখা হতেই তিনি আঁতকে উঠে বেশ বিরক্তের সঙ্গেই বললেন, “এটা আপনারা কী করেছেন? এখানকার লোকেরা তো আপনাদের পিটিয়ে মেরে ফেলবে”। এখানকার মতো নিরীহ সাদামাটা মানুষ যে পিটিয়ে মানুষ খুন করতেও পারে, জানা ছিল না। আমাদের অপরাধটা ঠিক কী তাও বুঝতে পারলাম না।  
ভদ্রলোক এবার বললেন সারা দেশ থেকে মানুষ এসে এখানে দেবস্থানে ত্রিশুল পুঁতে মনস্কামনা পুরণের জন্য মানত করে যায়। মনস্কামনা পুরণের আগেই ত্রিশুল তুলে নিলে, ইচ্ছা পুরণের কোন সম্ভাবনাই থাকে না। কোনটা কার ত্রিশুল বোঝার উপায় না থাকায়, কোন ত্রিশুলই তোলা বা নিয়ে যাওয়া উচিৎ নয়। যাইহোক তুলে যখন এনেইছেন, কেউ দেখে ফেলার আগে ওগুলোকে ফেলে দিন বা ব্যাগে পুরে নিন। এতকষ্টে বয়ে নিয়ে এসে ফেলে দিয়ে যেতে মন চাইলো না, তাই কাঁধে ঝোলানো কাপড়ের শান্তিনিকেতনি ব্যাগে ওগুলো পুরে ফেলে, হোটেলে খেতে গেলাম। সেখান থেকে ফিরে শান্তিদার সাথে পাশের আশ্রমে গেলাম, তাঁর সাথেই আশপাশটা বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে দেখলাম। ত্রিশুলগুলোর সামনে তিনটি ও পিছনে একটি ছুঁচালো অংশ ব্যাগ ফুঁড়ে, প্যান্ট্ ফুঁড়ে আমার ঊরু ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। তবু পিটুনি খেয়ে মরার চেয়ে ক্ষতবিক্ষত ঊরু নিয়ে আধমরা হয়ে থাকা, অনেক আরামপ্রদ ও নিশ্চিন্তের বলে মনে হ’ল।
ঠাকুর দেবতায় আমার কোনকালে বিশ্বাস বা আস্থা ছিল না, আজও নেই। শুনেছি মহাদেব ভদ্রলোক অতি অল্পেই তুষ্ট হ’ন। সামান্য ফুল বেলপাতা, তাও গোলাপ, চাঁপা বা জুঁই-রজনীগন্ধা নয়, আকন্দ, ভাট বা ধুতরোর মতো বুনো ফুলেই তিনি সন্তুষ্ট। কিন্তু আমার কাছ থেকে কোনদিন তাঁর সেটুকুও প্রাপ্তি না হলেও, তিনি আমাকে খুব পছন্দ করেন, বিপদে আপদে পরোক্ষভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, এটা আবার দেখলাম।
ফেরার পথে বাসে বসার জায়গা না পেয়ে বিড়ির ধোঁয়ায় অতিষ্ঠ হয়েও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আসার সময়, মণিমহেশ নিয়ে ঠাট্টা তামাশা ও আলোচনা চলছে। আমাদের কথা বা ভাষা কারো বোঝার কথাও নয়। সম্ভবত স্থানীয় দরিদ্র একজন  মানুষ হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে বসলেন আমরা কোথা থেকে এসেছি, কোথায় গিয়েছিলাম। তাকে ওয়েষ্ট বেঙ্গল বললে তিনি বুঝতে না পারায়, আবার বললাম বঙ্গাল সে। তিনি এবার জিজ্ঞাসা করলেন, বঙ্গাল হিন্দুস্থানের মধ্যে কী না। তাঁকে এবার ব্যাখ্যা করে বোঝালাম যে, কাশ্মীর যেমন একটা রাজ্য, হিমাচল প্রদেশ যেমন একটা রাজ্য, মাদ্রাজ বা গুজরাট যেমন একটা রাজ্য এবং হিন্দুস্থানের মধ্যে অবস্থিত, বঙ্গালও সেরকম হিন্দুস্থানেরই একটা রাজ্য। তিনি আমার কথা কতটা বুঝলেন জানি না, তবে আমরাও হিন্দুস্থানে বাস করি শুনে খুব খুশি হয়ে, এবং আমরা মণিমহেশ থেকে ফিরছি শুনে, নিজে উঠে দাঁড়িয়ে আমায় বসার জায়গা করে দিলেন। বাস কিছুটা যাবার পর কন্ডাক্টারের কাছ থেকে খবর পাওয়া গেল, যে সামনে কিছুটা দুরে একটা ছোট্ট ধ্বসের জন্য বাস আর যেতে পারছে না। তিন কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে চাম্বা যাবার বাস পাওয়া যাবে। চাম্বা থেকে ভারমোরগামী বাসগুলো আর এগলে বাস ঘোরানো যাবে না বলে, ওখান থেকেই বাসের মুখ ঘুরিয়ে চাম্বা ফিরে যাচ্ছে। তিন কিলোমিটার পথ হাঁটাটা আমাদের কাছে কোন সমস্যা নয়, কিন্তু সঙ্গের মালপত্র কাঁধে করে তিন কিলোমিটার পথ হেঁটে যাওয়া নিয়ে আমরা একটু চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়তে ভদ্রলোক আমাদের ভয় পেতে নিষেধ করে জানালেন, আমরা শিউজীর জায়গা থেকে ঘুরে আসছি, কাজেই তিনি নিজে আমাদের মালপত্র বয়ে নিয়ে গিয়ে আমাদের ঐ তিন কিলোমিটার দুরের বাসে তুলে দেবেন। ধ্বসের জায়গায় এসে জানা গেল রাস্তা মেরামত হয়ে গেছে কাজেই আমরা নিশ্চিন্তে চাম্বা এসে পৌঁছলাম। ভদ্রলোক নিজে বাসের ছাদ থেকে আমাদের মালপত্র নীচে নামিয়ে এনে দিলেন। জানিনা ভদ্রলোকের এই অযাচিত সাহায্যের পিছনে মহাদেবের ইচ্ছা বা হাত ছিল কী না, তবে সম্ভবত এই মহাদেববাবুই, এর পরেও আমাকে একবার বিপদের সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।  
বছর দুয়েক পরে কাশ্মীর-অমরনাথ ঘুরে বৈষ্ণুদেবী দেখে জম্মু স্টেশনে এসে ফেরার টিকিটের জন্য রেলের টিকিট কাউন্টারে অনেক লোকের পিছনে লাইন দিলাম। এখন অনলাইন কম্পিউটারের যুগ, কিন্তু সেদিন জম্মু স্টেশনে যতগুলো কাউন্টার ছিল, তার প্রায় সবকটাই মিলিটারিদের জন্য সংরক্ষিত, বাকি দু-একটিতেও মিলিটারিরা সাধারণ মানুষের সাথে লাইনে দাঁড়িয়েছে। আমি আমার সামনে লাইনে দাঁড়ানো ভদ্রলোকটির সাথে কথা প্রসঙ্গে সদ্য শুনে আসা অমরনাথের মাহাত্ম্য নিয়ে লেকচার দিচ্ছি। অনেকেই পিছন ফিরে আমার শ্রীমুখনিঃসৃত বাণী শুনছেন। হঠাৎ মনে হ’ল সামনের ভদ্রলোক হিন্দু না মুসলমান, জানা হয়ে ওঠেনি, তাই হজরতবালের মাহাত্ম্য সম্বন্ধে শুনে আসা কিছু গল্পও বর্ণনা করলাম। লাইনের সামনের দিক থেকে এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে, আপ ইধার আইয়ে জনাব, বলে আমায় লাইনের প্রায় একেবারে সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন। এতবড় লাইনের একজনও আপত্তি করলো না দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। দিলীপ আমায় জিজ্ঞাসা করলো, তুই এত শিব ভক্ত কবে থেকে হলি। আমি তাকে ইশারায় চুপ করে যেতে বললাম। মহাদেব না মহম্মদ, কার ইচ্ছায় জানি না, তবে খুব সহজেই সেবার ফেরার টিকিট হস্তগত হয়েছিল।