গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৬

দেবরাজ দাশগুপ্ত

যাপিত জীবন

(২য় অংশ - গত সংখ্যার পর)

পাঁচ

সারাদিন অফিসে যে খুবই ব্যাস্ততার মধ্যে কাটে এমন নয়,কিন্তু অফিসে থাকাটাই শরীর ও মনে ক্লান্তি সৃষ্টির পক্ষে যথেষ্ট।পিটার অফিস থেকে এসে রুমে দরজা লাগিয়ে দেয়।দীপ জানে সে ল্যাপটপে কোরিয়ান মুভি আর মিউজিক ভিডিও দেখে টাইম পাস করে।আর ক্ষুধা লাগলে কাপ নুডুলস বানিয়ে খায়।আর দীপও তো খুব একটা আলাদা নয়।
 সন্ধ্যায় ডিনারের পর পিটার আমাকে বলল, দীপ,কোন কাজ আছে তোমার?
না,তেমন কিছু নেই।
আচ্ছা,একটা কাজ করো তাহলে।এয়ারপোর্ট চলে যাও।জিনির সাথে একজন ক্লায়েন্টও আসবে।
  হেড অফিসের স্টাফ জিনির আসার কথা ছিল আগামীকাল, সে তথ্য দীপের জানা ছিল।প্রশ্ন করল,আজ কেন চলে আসছে?
ক্লায়েন্টকে হোটেলে পৌছে দিয়ে তোমরা দুজনে চলে আসবে। পিটার কোন প্রয়োজন মনে করে না দীপের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার।
পিটার যেহেতু বস তাই ওর আদেশে না করার প্রশ্ন উঠতে পারে না কিন্তু কয়েকটা বুদবুদ তৈরী হয়। জিনিকে রিসিভ করতে যাওয়ার কথা তো পিটারের।
এয়ারপোর্টে এসে জিনিদের ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করছিল। ফোন এল। ফোন আসাটা সমস্যা নয় , সমস্যা হল মানিকের প্রশ্ন। দুজন ভারতীয় যখন নিজেদের মধ্যে অফিসের বাইরে কথা বলে তখন হিন্দীই চলে।
কি ব্যাপার ? কি করতেছো?
না,এইতো,বিশেষ কিছু করার নেই।
কোথায় এখন তুমি?ফ্ল্যাটে না বাইরে?
 মানিকের কাছ থেকে লুকিয়ে বাচা যাবে না।আর এখন তো ধরেই ফেলেছে,আত্নসমর্পনই বাচাঁর উপায়।
এয়ারপোর্টে এসেছি তো ? এরিকা আসবে কিছুক্ষন পরে।
এরিকা যে আসবে সেটা তো জানি।কিন্তু তোমার তো আসার কথা না।মানিকলাল জানতে চাইল বসসুলভ কন্ঠে,পিটার কোথায়?
সে ফ্ল্যাটেই আছে।
সে মস্তি মারতেছে ।আর তার কাজ করার জন্য তুমিও ড্যাং ড্যাং করে চলে এসেছো।
কি আর কাজ বলুন?অধস্তন কর্মচারীর স্বভাবজাত নরম গলায় দীপ বলল, না আসলে পিটার কি ভাবত ,বলুন?
আরে,পিটার গয়া তেল লেনে। ওপাশে মানিকের কন্ঠ উত্তেজিত হয়।এভাবেই তো তোমরা ওদের মাথায় তোল।পিটার তোমাদের কি ভাবে জানো?সে ভাবে তোমরা ওর কর্মচারী।
দীপ কিছু বলল না।
কিন্তু তোমরা তো বুঝ না, সেও কোম্পানির একজন কর্মচারী।
এবারও দীপ কিছু বলল না।
পিটার কিছু করার কথা বললে আমারে আগে জানাইও ।মানিক বলল।
 এসব অফিস পলিটিক্স দীপের একদম ভাল লাগে না।
ফ্লাইট চলে এলো নির্দিষ্ট সময়েই।জিনির সাথে একজন কোরিয়ান ভদ্রলোকও এলেন। কোরিয়ান মানুষগুলো খুব ভাল, ভদ্রতাবোধ খুব স্ট্রং।নিজেদের মধ্যে ওরা মাথা নুইয়ে বিদায় সম্ভাষন জানায়।জিনি থাকবে কোম্পানীর ফ্ল্যাটেই।

 ফ্ল্যাটে ফিরে এলে পিটার দরজা খোলে দিল।কিন্তু সে একটা কথাও জানতে চাইল না।তবে কি সত্যি সে অন্যদের তার দাস ভাবে?ঐ ক্লায়েন্ট সম্পর্কেও কিছু জানতে চাইল না।কাপড় বদলে নিয়ে দীপ ফোন করল এডমিন ম্যানেজার সুধাকরকে। জানাল আজকের এয়ারপোর্টে যাওয়ার কথাটা এবং মানিকের বক্তব্য।
 সুধাকর বলল,এইটা গোপন খবর।পিটার অনেক কিছুই করে , অনেক মেইল ই হেড অফিসে পাঠায় , কিন্তু সে সেটা মানিককে জানায় না। আবার মানিক মনে করে কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে তার সবকিছু জানা উচিত।
পিটার না মানিক,কে বেশি সঠিক,ঠিক করছিল।
সুধাকর বলল,ব্যাপার কি জানো,আমরা কেউ তো মানিক স্যারের ব্যাপারে হেড অফিসে কিছু লিখব না।সে সাহস আমাদের নেই।কিন্তু পিটার লিখলে লিখতেও পারে। তাই মানিক স্যারের ভয়। এদিকে পিটার মানিকের অধীনে কাজ করতে চায় না।
 এসব ব্যাপার কিছুটা দীপ জানে।
এগুলোতো তাদের ব্যাপার।দীপ বলল। তাদের দড়ি টানাটানির মধ্যে আমাদেরকে জড়িত করার কি দরকার?
সুধাকর বলল,আমি যে কিভাবে সামাল দিয়ে দিয়ে আছি আমি জানি।
দীপ জানে সুধাকর মহারানা কিভাবে সামাল দেয়।ওর পলিসি হল, নো কমেন্টস।বোবার কোন শত্রু নেই , আর যে প্রতিরোধ করে না তাকে মেরে কি লাভ?
 ফোনটা রাখার পরও কথা ও প্রশ্ন শেষ হল না। এয়ারপোর্টে যাওয়ার ব্যাপারটা মানিককে কে বলল?আর ফোনে বলা কথাগুলো সুধাকর আবার মানিককে পাস করে দেবে না তো?

ছয়

আর ইউ স্লিপিং,দীপ?রাত সোয়া দশটায় দরজায় পিটারের এই প্রশ্ন এবং পরবর্তী প্রস্তাব কিছুই অবাক করে না। লেটস হ্যাভ সাম ফুড ইন এ রেস্ট্যুরেন্ট।
 পিটার পুনের অফিসে এসেছে প্রায় ছয় মাস। দীপের পক্ষে এতটুকু সময় যথেষ্ট বুঝে নিতে যে যদিও পিটারের সাথে মাঝে মধ্যেই বনিবনা হয় না,কিন্তু তাকে ছাড়া চাকরি চলবে না। বা যতদিন দীপ কোম্পানীতে আছে, তাকে ছাড়া পিটারেরও। পিটার যেহেতু কোম্পানীর ব্রাঞ্চ ম্যানেজার তাই দীপকে তার কাছেই রিপোর্ট করতে হয়।
 রাত হলেও সমস্যার সমাধান হয়ে যায়, যেহেতু কুককে দেওয়া স্কুটি সে রেখে গিয়েছে।স্কুটিতে করে দীপ ও পিটার রওয়ানা দিল।যেতে যেতে দীপ বুঝে নিতে পারে সিচুয়েশনটা যা পিটারকে চিন্তিত করছে।চোরের উপর বাটপার থাকতেই পারে। হায়দ্রাবাদের অফিস বন্ধ করে দিয়ে কিছু স্টাফ ছাটাই করা হলে সেখানের স্টাফ নীতিন এল পুনেতে।নীতিন অনেক পুরাতন স্টাফ ও ঘাগু মাল।সে পিটারের বসগিরি সহ্য করতে পারে না।পিটারের দেওয়া কাজ ফেলে রেখে দেয়,এদিকে পিটারকে হেড অফিসে রিপোর্ট করতে হয়।এমন অবস্থায় পিটার দীপকে নিয়ে দল ভারী করতে চায়।
রেস্ট্যুরেন্টে পিটার তার দুঃখের কথা বলে।ওর বাবা মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে সে যখন হাইস্কুলে থাকত।যদিও এখন সে বাবা ও মা দুজনের সাথেই যোগাযোগ রাখে।
পিটার বলে , সে এখনই বিয়ের কথা ভাবছে না।সাউথ কোরিয়ায় নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা এখন কেরিয়ারের পেছনে ছুটতে গিয়ে বিয়ের ঝামেলায় জড়াতে চাইছে না।
প্রত্যেক মানুষের মত হিটলারের জীবনেও হয়ত কিছু দুঃখ আছে।কিছু দারিদ্রতা আর কিছু দুঃখ না থাকলে জীবন পূর্ন হয়ে উঠে না।পিটার বলল, আমি বাবা হতে চাই , কিন্তু কারো স্বামী হতে চাই না।
 দীপ ওর নিজের অভিমতটাকে খুজতে থাকে। একটু ভাল লাগে যে ওর বিবাহিত জীবন নিয়ে আরো কেউ ভাবে।নিজের বাবা মা।কিন্তু তারা যখন এসব ব্যাপারে নিয়ে কথা বলতে চান মনে হয় , ওরা ঘ্যানর ঘ্যানর শুরু করে দিয়েছেন।
  পিটার দীপের কথা জানতে চাইলে সে নিরাপদ উত্তর দিয়ে পাশ কাটিয়ে যায়।
পিটার বলল, আচ্ছা,তুমি বলেছো,তোমার কোন গার্লফ্রেন্ড নেই।তাহলে বিয়ে করবে না?
না না , গার্লফ্রেন্ড আছে।দীপ বলল। আমার চাকরিটাই আমার গার্লফ্রেন্ড হয়ে গেছে।
দুজনে হেসে উঠল। কিছু বিদেশী স্বাদের খাবারের সাথে বিদেশী পানীয়ও হয়ে যায়।বিলতো পিটারই পেশ করবে তবু সুযোগ বুঝে কিছু মেকি ভদ্রতা করে ফেলে দীপ।
রাতের বেলা দীপ বিষয়টা নিয়ে আবার ভাবে।ভাবে যে বিয়ের আগে যদি কোন মেয়ের প্রেমে পড়া যায় ও মেয়েটিও তার প্রেমে পড়ে তবেই তাকে বিয়ে করা যায়।ঘুমানোর আগে আরেকটা বিষয় বেশ নিশ্চিন্ত করল দীপকে,পিটারের সাথে দূরত্ব কিছুটা হলেও কমেছে। কোরিয়াতে যাওয়ার জন্য ওর কাছ থেকে সবুজ সংকেত খুবই দরকার। একটা নিশ্চিতবোধ আসে , কিংবা এলকোহলের প্রভাবে জীবনের অনিশ্চয়তা ও দুঃখগুলো ভুলে যায়।

সাত
পরদিন অফিসে পৌছার পাঁচ মিনিট পরই পিটার দীপকে তার টেবিলে ডাকল।কোরিয়ার সময় ইন্ডিয়া থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা এগিয়ে।হেড অফিসের প্রথম কাজ ইন্ডিয়ান অফিসে মেইল পাঠানো কাজের রিমাইন্ডার দিয়ে।যদিও কান্ট্রি ম্যানেজার মানিকলাল মুম্বাইতে,কিন্তু হেড অফিসের স্টাফ জিনির উপস্থিতি অলিখিত ঘোষনা দিল ভাল পারফরম্যান্সের।
তুমি দেখি মেইল পাঠাওনি?পিটারের প্রথম প্রশ্নতেই বিপদের বার্তা।
কোন মেইলটা, পিটার?
ইউ ইভেন ফরগট দ্যাট?টু উইক্স লাক্সারী লিভিং ইন কেরালা-গডস অউন কান্ট্রী। মনে পড়েছে, মিস্টার দীপজ্যোতি?
ওহ হ্যাঁ।
তাহলে ?
আসলে গত কয়েকদিন এত ঝামেলার মধ্যে ছিলাম।দীপ বলল।
হোয়াটপিটারের রুপ অবশ্যই ভিন্ন।হ্যায়,এভরিওয়ান গেটস টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স ইন এ ডে।সো ডোন্ট মেইক এক্সকিউজেস।
 এবারে দীপ আঁচ করতে পারে কিছু বিপদ আসছে।অফিসের অন্যান্যরা যে ল্যাপটপে ডুবে আছে বাহানা নিয়ে ওদের কথাগুলো শুনতে চাইছে তা পেছন ফেরে না দেখলেও বুঝতে পারে।
তুমি কি ভাবো নিজেকে? আর আমাকে তুমি ভাবো? আই এম ইওর ফ্রেন্ড? পিটার তিনটি প্রশ্ন একসাথে করল।
ইটস নট লাইক দ্যাট।
তাহলে ? তাহলে? ফেসবুকে ফ্রেন্ডশিপ রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছ কেন?
একচুয়ালী স্যারএকটা মিনমিন আওয়াজ দীপকে দখল করে ফেলে
ইউ আর ভেরী গুড ইন ওয়ান থিং অনলি।এন্ড দ্যাট ইজ বিগ টক।
দীপ চুপ থাকে, কিন্তু তার ভেতরে কথা বলে অন্য কেউ।আজকে স্যান্ডুউইচ মিটিং হবে। সিউওলের অফিসে ট্রান্সফারের বিষয় নিয়ে কথা তুলতে হবে মিটিং এ। জিনির মাধ্যমে পুনে অফিসের রিপোর্ট যাবে হেড অফিসে। দীপকে তার লয়েলিটি প্রমান করতে হবে কোম্পানীর প্রতি ও কোরিয়ান স্টাফদের প্রতি।
 নিজের টেবিল এ এসে অসমাপ্ত কাজটা নিয়ে বসে।আসলেই কেরালা ট্রিপের ফাইলটায় অনেক কাজ বাকী রয়ে গেছে।কিছুটা কাজ করে দীপ আবার ফেসবুক খুলে ফেলে। পিটারকে পাঠানো ফ্রেন্ডশিপ রিকোয়েস্ট ডিলিট করতে চাইলেও সংগৃহীত সাহস অনুমতি দেয় না।স্ট্যাটাসের ঘরে কিছু একটা লিখে।তারপর আবার ডিলিট করে দেয়।মনের কথাগুলো যদি আবার অন্যের নজরে পরে!