সুকান্ত রোজ ভাবে,এ আমার সংসার ।
কিন্তু ওর বৌ কাবেরী প্রতিদিন হেসে-হেসে বুঝিয়ে দেয় ওকে,’’না গো,এ আমারই সংসার । তুমি আছো তাই । আর
থাকতেই হবে । একজন কত আর সংসার সাজায় ।‘’ সব বোঝার পর
সুকান্ত হাসে । বলে,’’বেশ,তাই
হোক । এ তোমারই সংসার । তবে আমার দিক থেকে আবার চোখ ঘুরিয়ে নিও না । সময় তো ভালো
না ।‘’
একথা শুনে কাবেরী খুব রেগে যায় ।
রেগে বলে,’’সে তোমাদের অভ্যাস । আমরা ঠিকই থাকি । এমন কথা আর বল না । শুনতে ভালো
লাগে না একদম ।‘’ শুনে সুকান্ত মৃদু-মৃদু হাসে । বৌয়ের
ওইটুকু রাগ ওর খুব ভালো লাগে । বন্ধুদের বলে,’’বৌয়ের একটু
রাগ না দেখলে সংসারে আমেজ আসে না ।‘’ ওর বন্ধুরা ওর কথা
শুনে খুব মজা পায় । নিকুঞ্জ শুধু বলে,’’তবে এমন যেন না
রাগে যাতে বাপের বাড়ি গিয়ে চোখের জল ফেলে । এখন সবকিছুই মেয়েদের পক্ষে । সাবধান ।‘’
সে ভালোই বোঝে সুকান্ত । উত্তর দেয় ,’’আরে,না । অতটা রাগানো যায় ?‘’ কিন্তু রেগে-রেগে যে
আগ্নেয়গিরি হয়,সে কথা বুঝি সুকান্তর জানা ছিল না ।
সেদিন সকালে কাবেরী বলল সুকান্তকে,’’এক্ষুনি
তোমাকে বাজারে যেতে হবে । ঘরে একফোঁটা সরষে তেল নেই ।‘’ শুনে
মেজাজ গরম হয়ে গেলো সুকান্তর । তখন অফিসে যাওয়ার তাড়া । তাই বেশ মেজাজ দেখিয়ে বলে
বসলো কাবেরীকে,’’এই বুঝি তোমার সংসার ? কাল রাতেও বাজারে গেলাম । তখন বলতে মনে ছিল না ? আমার পক্ষে এখন আর যাওয়া সম্ভব না । তেল ছাড়াই চালিয়ে নাও ।‘’ সুকান্তর কথা শুনে কাবেরীর মেজাজ চড়ে গেলো সাথে-সাথে । হাতে ছিল কাপ ।
সেই কাপ সুকান্তর দিকে ছুঁড়ে মারল । একটুর জন্য রক্ষা পেলো ও । সুকান্ত ভয় পেয়ে
পাশের ঘরে ঢুকে গিয়েও রক্ষা পেলো না । ওর জামার কলার চেপে ধরে কাবেরী রাগে
দিশেহারা হয়ে বলে উঠলো,’’সংসারের খোঁটা দেওয়া হচ্ছে ?
বেশ,আজ থেকে একেবারেই তোমার সংসার । আমি
বুবুকে নিয়ে একেবারেই বাপের বাড়ি চললাম ।‘’ সেইসাথে
সুকান্তর হাতে কামড়ও বসিয়ে দিলো কাবেরী ।
হাত দিয়ে তখন সুকান্তর অল্প-অল্প
রক্ত বার হচ্ছে । যন্ত্রণাও হচ্ছে খুব । তবে ও যন্ত্রণা ভুলে পরিবেশ শান্ত করার
চেষ্টা করতে চেষ্টা করলো । রান্নাঘর থেকে তেলের শিশি নিয়ে বাজারের দিকে রওনা দিলো
। যাবার সময় বলে গেলো শুধু কাবেরীকে,’’আর মাথা গরম কর না । এ তোমারই সংসার । তেল
আনতে চললাম । এসে অফিসে যাবো ।‘’ কাবেরী তখন বারান্দায়
বসে রাগে ফোঁসফোঁস করছে । কোন উত্তর দিলো না ।
সুকান্তর বাজার থেকে ফিরতে লাগলো
মিনিট পনেরো । কিন্তু এসে দেখল বাড়ি ফাঁকা । কাবেরী ছেলে বুবুকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে
। পাশের বাড়ির রানীবৌদি সে কথা জানালো সুকান্তকে । সাথে-সাথে সুকান্ত তেলের শিশি
ফেলে স্টেশনের দিকে দৌড় দিলো । তখনো ট্রেন আসতে কুড়ি মিনিট দেরী । প্রায় ছুটতে
থাকলো স্টেশনের দিকে ।
স্টেশনে গিয়ে একটু খোঁজার পর
সুকান্ত কাবেরীর সন্ধান পেলো । ছেলে বুবুকে নিয়ে বসে আছে একটা সিমেন্টের চেয়ারে ।
ছুটে গেলো সেদিকে সুকান্ত । ওকে দেখে কাবেরী মুখ নামিয়ে নিলো সাথে-সাথে । বাবাকে
দেখে বুবুর মুখে হাসি । সুকান্তকে চেপে ধরল । আধো-আধো গলায় বলল,’’মামা বালি যাব
। তুমিও যাবা আমাদেল সাথে ।‘’ সুকান্ত হাসতে হাসতে বলে উঠলো,’’যাওয়াচ্ছি তোদের । বাড়ি একেবারে ফাঁকা পড়ে আছে । ভূতের সংসার চলছে এখন
।‘’ একথা বলে সুকান্ত চারদিক তাকিয়ে নিয়ে কাবেরীর হাত ধরে
সহাস্যে বলল,’’অনেক দেখিয়েছ রাগ । আমি শালা ভয়ে মরি ।
এবার গিয়ে নিজের সংসার একেবারে বুঝে নাও । আমি তোমার দাসানুদাস আজ থেকে । অমন কেউ
করে ?’’
কাবেরী এবার মুখ তুলে চাইলো । আগের
রাগের ঝাঁঝ তখন অনেকটা কমে এসেছে । তবে গালে চোখের জলের শুকনো দাগ তখনো স্পষ্ট ।
কিছুক্ষণ অপলকে সুকান্তর দিকে তাকানোর পর অস্ফুট-স্বরে বলতে থাকলো,’’একটা ধাক্কা
তোমার জন্য খুব জরুরী ছিল । সেটাই দেখলে আজ । আর একদিন এমন হলে আর ফিরবোই না । পরে
বুঝবে মজা ।‘’ তারপর কাবেরী উঠে বুবুকে কোলে নিতে চাইলো ।
কিন্তু বুবু বাবার সঙ্গ ছাড়বে না । বাবার কোলে উঠে বসে থাকলো ।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে কাবেরী সুকান্তর
কাছে জানতে চাইলো,’’হাতে ওষুধ কিছু দিয়েছ ? রক্ত পড়ছিল খুব ।
মানুষের দাঁত বিষ । চল,একেবারে ডাক্তার দেখিয়ে যাই ।‘’
শুনে বেশ অবাক হল সুকান্ত । মজাও পেলো খুব । সারা-মুখে খুশীর
হাসি ছড়িয়ে কাবেরিীকে বলল,’’সে দেখা যাবে । তবে ও বিষ-টিস
কিছু না । অমৃতার কৃপায় সব ঠিক হয়ে যাবে ।‘’ অমৃতা শুনে
চমকে উঠলো কাবেরী । চোখ বড় বড় করে বলে উঠলো,’’সে আবার কে ?
কাকে জুটালে আবার এইটুকু সময়ের মধ্যে ?’’
শুনে হা-হা করে হেসে উঠলো সুকান্ত
। তারপর উত্তর দিলো,’’আরে,এ তো তোমারই নাম । মনে নেই ফুলশয্যার রাতে
নামটা তোমাকে দিয়েছিলাম ? তুমি অবশ্য নাকচ করেছিলে
সাথে-সাথে । কেন জানি না । আজ আবার মনে পড়ে গেলো ।‘’ একথা
শোনার পর কাবেরীর আরক্ত ঠোঁটে সেই প্রথম রাতের সলাজ হাসি তরঙ্গের মতো খেলে গেলো ।
কিছুক্ষণ পর দুজন পরম তৃপ্তিতে ছেলে বুবুকে নিয়ে শূন্য-বাড়ি পূর্ণ করতে বাড়িতে
ফিরে এলো । রানীবৌদি তখনো উঠোনে ঠায় ব’সে পাহারা দিচ্ছে
কাবেরীর সংসার ।