গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৬

নীহার চক্রবর্তী

অমৃতার সংসার 

সুকান্ত রোজ ভাবে,এ আমার সংসার । কিন্তু ওর বৌ কাবেরী প্রতিদিন হেসে-হেসে বুঝিয়ে দেয় ওকে,’’না গো,এ আমারই সংসার । তুমি আছো তাই । আর থাকতেই হবে । একজন কত আর সংসার সাজায় ।‘’ সব বোঝার পর সুকান্ত হাসে । বলে,’’বেশ,তাই হোক । এ তোমারই সংসার । তবে আমার দিক থেকে আবার চোখ ঘুরিয়ে নিও না । সময় তো ভালো না ।‘’

একথা শুনে কাবেরী খুব রেগে যায় । রেগে বলে,’’সে তোমাদের অভ্যাস । আমরা ঠিকই থাকি । এমন কথা আর বল না । শুনতে ভালো লাগে না একদম ।‘’ শুনে সুকান্ত মৃদু-মৃদু হাসে । বৌয়ের ওইটুকু রাগ ওর খুব ভালো লাগে । বন্ধুদের বলে,’’বৌয়ের একটু রাগ না দেখলে সংসারে আমেজ আসে না ।‘’ ওর বন্ধুরা ওর কথা শুনে খুব মজা পায় । নিকুঞ্জ শুধু বলে,’’তবে এমন যেন না রাগে যাতে বাপের বাড়ি গিয়ে চোখের জল ফেলে । এখন সবকিছুই মেয়েদের পক্ষে । সাবধান ।‘’ সে ভালোই বোঝে সুকান্ত । উত্তর দেয় ,’’আরে,না । অতটা রাগানো যায় ?‘’ কিন্তু রেগে-রেগে যে আগ্নেয়গিরি হয়,সে কথা বুঝি সুকান্তর জানা ছিল না ।

সেদিন সকালে কাবেরী বলল সুকান্তকে,’’এক্ষুনি তোমাকে বাজারে যেতে হবে । ঘরে একফোঁটা সরষে তেল নেই ।‘’ শুনে মেজাজ গরম হয়ে গেলো সুকান্তর । তখন অফিসে যাওয়ার তাড়া । তাই বেশ মেজাজ দেখিয়ে বলে বসলো কাবেরীকে,’’এই বুঝি তোমার সংসার ? কাল রাতেও বাজারে গেলাম । তখন বলতে মনে ছিল না ? আমার পক্ষে এখন আর যাওয়া সম্ভব না । তেল ছাড়াই চালিয়ে নাও ।‘’ সুকান্তর কথা শুনে কাবেরীর মেজাজ চড়ে গেলো সাথে-সাথে । হাতে ছিল কাপ । সেই কাপ সুকান্তর দিকে ছুঁড়ে মারল । একটুর জন্য রক্ষা পেলো ও । সুকান্ত ভয় পেয়ে পাশের ঘরে ঢুকে গিয়েও রক্ষা পেলো না । ওর জামার কলার চেপে ধরে কাবেরী রাগে দিশেহারা হয়ে বলে উঠলো,’’সংসারের খোঁটা দেওয়া হচ্ছে ? বেশ,আজ থেকে একেবারেই তোমার সংসার । আমি বুবুকে নিয়ে একেবারেই বাপের বাড়ি চললাম ।‘’ সেইসাথে সুকান্তর হাতে কামড়ও বসিয়ে দিলো কাবেরী ।

হাত দিয়ে তখন সুকান্তর অল্প-অল্প রক্ত বার হচ্ছে । যন্ত্রণাও হচ্ছে খুব । তবে ও যন্ত্রণা ভুলে পরিবেশ শান্ত করার চেষ্টা করতে চেষ্টা করলো । রান্নাঘর থেকে তেলের শিশি নিয়ে বাজারের দিকে রওনা দিলো । যাবার সময় বলে গেলো শুধু কাবেরীকে,’’আর মাথা গরম কর না । এ তোমারই সংসার । তেল আনতে চললাম । এসে অফিসে যাবো ।‘’ কাবেরী তখন বারান্দায় বসে রাগে ফোঁসফোঁস করছে । কোন উত্তর দিলো না ।

সুকান্তর বাজার থেকে ফিরতে লাগলো মিনিট পনেরো । কিন্তু এসে দেখল বাড়ি ফাঁকা । কাবেরী ছেলে বুবুকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে । পাশের বাড়ির রানীবৌদি সে কথা জানালো সুকান্তকে । সাথে-সাথে সুকান্ত তেলের শিশি ফেলে স্টেশনের দিকে দৌড় দিলো । তখনো ট্রেন আসতে কুড়ি মিনিট দেরী । প্রায় ছুটতে থাকলো স্টেশনের দিকে ।
স্টেশনে গিয়ে একটু খোঁজার পর সুকান্ত কাবেরীর সন্ধান পেলো । ছেলে বুবুকে নিয়ে বসে আছে একটা সিমেন্টের চেয়ারে । ছুটে গেলো সেদিকে সুকান্ত । ওকে দেখে কাবেরী মুখ নামিয়ে নিলো সাথে-সাথে । বাবাকে দেখে বুবুর মুখে হাসি । সুকান্তকে চেপে ধরল । আধো-আধো গলায় বলল,’’মামা বালি যাব । তুমিও যাবা আমাদেল সাথে ।‘’ সুকান্ত হাসতে হাসতে বলে উঠলো,’’যাওয়াচ্ছি তোদের । বাড়ি একেবারে ফাঁকা পড়ে আছে । ভূতের সংসার চলছে এখন ।‘’ একথা বলে সুকান্ত চারদিক তাকিয়ে নিয়ে কাবেরীর হাত ধরে সহাস্যে বলল,’’অনেক দেখিয়েছ রাগ । আমি শালা ভয়ে মরি । এবার গিয়ে নিজের সংসার একেবারে বুঝে নাও । আমি তোমার দাসানুদাস আজ থেকে । অমন কেউ করে ?’’

কাবেরী এবার মুখ তুলে চাইলো । আগের রাগের ঝাঁঝ তখন অনেকটা কমে এসেছে । তবে গালে চোখের জলের শুকনো দাগ তখনো স্পষ্ট । কিছুক্ষণ অপলকে সুকান্তর দিকে তাকানোর পর অস্ফুট-স্বরে বলতে থাকলো,’’একটা ধাক্কা তোমার জন্য খুব জরুরী ছিল । সেটাই দেখলে আজ । আর একদিন এমন হলে আর ফিরবোই না । পরে বুঝবে মজা ।‘’ তারপর কাবেরী উঠে বুবুকে কোলে নিতে চাইলো । কিন্তু বুবু বাবার সঙ্গ ছাড়বে না । বাবার কোলে উঠে বসে থাকলো ।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে কাবেরী সুকান্তর কাছে জানতে চাইলো,’’হাতে ওষুধ কিছু দিয়েছ ? রক্ত পড়ছিল খুব । মানুষের দাঁত বিষ । চল,একেবারে ডাক্তার দেখিয়ে যাই ।‘’ শুনে বেশ অবাক হল সুকান্ত । মজাও পেলো খুব । সারা-মুখে খুশীর হাসি ছড়িয়ে কাবেরিীকে বলল,’’সে দেখা যাবে । তবে ও বিষ-টিস কিছু না । অমৃতার কৃপায় সব ঠিক হয়ে যাবে ।‘’ অমৃতা শুনে চমকে উঠলো কাবেরী । চোখ বড় বড় করে বলে উঠলো,’’সে আবার কে ? কাকে জুটালে আবার এইটুকু সময়ের মধ্যে ?’’

শুনে হা-হা করে হেসে উঠলো সুকান্ত । তারপর উত্তর দিলো,’’আরে,এ তো তোমারই নাম । মনে নেই ফুলশয্যার রাতে নামটা তোমাকে দিয়েছিলাম ? তুমি অবশ্য নাকচ করেছিলে সাথে-সাথে । কেন জানি না । আজ আবার মনে পড়ে গেলো ।‘’ একথা শোনার পর কাবেরীর আরক্ত ঠোঁটে সেই প্রথম রাতের সলাজ হাসি তরঙ্গের মতো খেলে গেলো । কিছুক্ষণ পর দুজন পরম তৃপ্তিতে ছেলে বুবুকে নিয়ে শূন্য-বাড়ি পূর্ণ করতে বাড়িতে ফিরে এলো । রানীবৌদি তখনো উঠোনে ঠায় বসে পাহারা দিচ্ছে কাবেরীর সংসার ।