গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৬

সতীশ বিশ্বাস

আলোচনা

অনুগল্প নিয়ে দু-এক কথা
                                              
অনুগল্পের নির্দিষ্ট কোন সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা আছে কিনা আমার জানা নেই। ১৯৭০ সালের আগেও কেউ কখনো কোথাও অনুগল্প লিখেছেন কিনা তেমন কোন তথ্যও আমার কাছে নেই। তবে ৪৫ বছরের বেশি সময় ধরে লেখালেখি হলেওকেন আজ পর্যন্ত অনুগল্পের একটি পাকাপাকি সংজ্ঞা গড়ে উঠল নাসেটা বিস্ময়ের। আবার এও বলা যায়এটা মোটেই বিস্ময়ের নয়। কারণ বিতর্ককে সমাধান না করেজিইয়ে রাখতেই আমরা বেশি ভালবাসি। আর সেটি যদি কোন নতুন বিষয় নিয়ে হয়,তাহলে তো কথাই নেই। কারো অভিমত গ্রহণ করার জন্য আমরা যতটা আগ্রহী, বিরোধিতা করতে তার চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহী। কারণ গ্রহণ একবার করে নিলেআর তো নিজের পান্ডিত্য জাহির করার অবকাশ থাকে না। অতএব অন্যের সংজ্ঞা নস্যাৎ করেনিজের একটি সংজ্ঞাকে বাজারে ছেড়ে দাও। কেউ বিরোধিতা করলে তার সঙ্গে তর্ক জুড়ে দাও...এবং এই ভাবেই গড়গড়িয়ে গড়িয়ে চলে বিতর্কের গাড়ি। আমি বলছি বটেকিন্তু যেহেতু অনুগল্পের কোন অভিধান-সমর্থিত সংজ্ঞা নেই, তাই এই সুযোগে, অনুগল্পের একজন অনুরাগী পাঠক হিসাবে আমিও অনুগল্পের সংজ্ঞা সম্পর্কে একটি ভাবনা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমার মনে হয়তেমন গল্পকেই অনুগল্প বলা ভাল ১) যা হবে ছোট আকারের। ২) যা হবে একটি মাত্র অনুভব বা ঘটনা নিয়ে। ৩) এবং এমনভাবে গল্পটা শেষ হবেযে তার পরে আর সেটিকে টেনে বড় করা সম্ভব হবে না। এবার বলিকেন এই ৩টি সর্ত্ত।
আকারে ছোট হবে ঠিকই,তবে কতটা ছোট হবে? কত হবে শব্দসংখ্যা?এর উত্তরে বলা যায়--এ বিষয়ে কোন নির্দিষ্ট শব্দসংখ্যা না থাকাই ভাল। কারণ,গল্পটির আকার বা শব্দসংখ্যা নির্ভরশীল গল্পটির সংশ্লিষ্ট অনুভব বা ঘটনার উপর। তাই গল্প কখনো হবে ছোট,কখনো হবে একটু বড়। গল্পে থাকবে একটিমাত্র বিষয়-বিন্দু। সঙ্গে আর কোন উপ-বিষয় বা অনুভব বা ঘটনা থাকবে না। আর তৃতীয় সর্ত্ত অনুযায়ী গল্পটি যখন শেষ হবে তখন সম্পূর্ণভাবেই শেষ হবে। অর্থাৎ গল্পটি হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি গল্প। অর্থাৎ গল্পের পাঠক পথের শেষ সীমায় পৌঁছে যাবেন। উদাহরণ হিসাবে অনুগল্পকে আমরা এইদিক দিয়ে--'জোনাকির আলো' বলতে পারি। জোনাকির আলো ছোট বলে নয়, জোনাকির আলোকে কোনমতেই আর প্রসারিত করা সম্ভব নয় বলে। তাই, মোমবাতির আলো বা প্রদীপের আলো ছোট হয়েও অনুগল্প হতে পারে না কারণ এদের সহজেই বিস্তৃত করা যায়। গল্পকে যদি বাড়ানোই যাবে তাহলে তাকে অনুগল্প না বলে-- 'ছোট ছোটগল্প' বললেই তো হয়। অর্থাৎ বলতে চাইছি--শুধু আকারে অনু হলেই একটা গল্পের অনুগল্প হয়ে ওঠার অধিকার জন্মায় না। তাকে অবশ্যই হতে হবে সম্প্রসারন-অযোগ্য একটি ক্ষুদ্রায়তন গল্প যা পাঠকের মনে একটা বিশেষ প্রক্ষোভ বা উপলব্ধির সৃষ্ট করবে।
একটি বৃষ্টির ফোঁটাকেও অনুগল্প বলা যেতে পারে কারণ বৃষ্টির ফোঁটা অসম্প্রসারনযোগ্য। এবং সেটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাকে কোনমতেই টেনে হিঁচড়ে লম্বা করে নদী বা সাগর বানানো সম্ভব নয়। অথচ একটি বৃষ্টির ফোঁটা  অনিন্দ্যসুন্দর একটি শিল্পও বটে। তাছাড়া যা স্বয়ংসম্পূর্ণ তার প্রসারন অনাবশ্যক। তাই আমার মনে হয়, স্বয়ংসম্পূর্ণতাই অনুগল্পের সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য। তারপরের বৈশিষ্ট্য ব্যঞ্জনাময়তা। এই দুটি গদ্যগুণের প্রভাবেই অনুগল্পের পক্ষে বাংলাসাহিত্যে এক স্বতন্ত্র ও সম্ভ্রান্ত আঙ্গিক হয়ে ওঠা সম্ভব। এবার দু-একটি গল্পের সাহায্যে উপরের আলোচনাটিকে আর একটু স্পষ্ট করে তোলা যাক।
কৃষ্ণেন্দু বণিকের একটি নামহীন গল্পঃ প্লাটফর্মে পয়সা চাইল। বললাম,সঙ্গের সুটকেসটা ট্রেনে তুলে দিলে পয়সা দেব। ভিখিরি তাই করল। কিন্তু যেই পয়সা দিতে যাব,অমনি বলে উঠলভিক্ষে করি ঠিকই,তাই বলে এই সামান্য কাজের বিনিময়ে পয়সা? ছিঃছিঃ।
গল্প শেষ। অনুগল্পে যেমনটি হওয়া উচিৎ--এ গল্পের প্রতিটি শব্দই functional.একটি শব্দও বাদ দেবার উপায় নেই। প্রথম বাক্যটি দেখা যাক—‘প্লাটফর্মে পয়সা চাইল।কে চাইল? কেন চাইল?-নেই। উত্তর রয়েছে তৃতীয় বাক্যে। প্রথম বাক্যে ভিখিরি পয়সা চাইলথাকলে ভিখিরি শব্দটা পরে repeat হয়ে যেত।বলতে চাইছি--অনুগল্প লেখার সময় লেখকের মধ্যে এই শব্দ-সচেতনাটুকু অবশ্যই থাকা প্রয়োজন। এইবার, সুটকেস তুলে দেবার পর বাবুটি পয়সা দিতে গেলে সে নিল না। কিন্তু কেন? সে বলেছে, ‘ভিক্ষে করি ঠিকই,তাই বলে এই সামান্য কাজের বিনিময়ে পয়সা? ছিঃ ছিঃ।যদি না-ই নেবে, তাহলে প্রথমে পয়সা চাইলে কেন?... তখন পয়সা দিলে কিন্তু ও নিত। তাহলে এখন নিচ্ছে না কেন? নিচ্ছে না,কারণকাজের বিনিময়ে পয়সানিতে চায় না। খুবই সেয়ানা সে। সে ভেবে দেখলোএকবার যদি আমি কাজের বিনিময়ে পয়সা নিতে শুরু করি, তাহলে আমার মধ্যে একটা সম্মানবোধ জন্মে যেতে পারে (কারণ, কোন কাজই ছোট নয়)। তাহলে এরপরে আমি আর ভিক্ষে করায় ফিরে যেতে পারবো না। আমাকে কাজ করেই বেঁচে থাকতে হবে। সেটা সেই অলস ভিখিরিটা একেবারেই চাইছিল না। ভিক্ষে করার মধ্যেও একটা অসম্মান আছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে একটা অলসতার সুখ আছে। তাছাড়া সেটা তো তার গা-সওয়া হয়ে গেছে।   
এগল্পে সম্মান তার কাছে দু-রকমের। একটা সামাজিক আর একটাprofessional। এই চতুর ভিখিরিটা সামাজিক নয়,পেশাগত সম্মানটাকেই বেছে নিয়েছে কারণতাতে তাকে পরিশ্রম করতে হবে না।
গল্পের শেষ বাক্য‘আমি থ।’ আমি কে?-না সুটকেসওয়ালা। কেন থ? কারণ সে খুব আশা করেছিলপসা দেবার পর জমিয়ে একটু উপদেশ দেবে—‘এবার থেকে ভিক্ষে না করে, এইভাবে কাজ করে খাবার চেষ্টা করো, বুঝলে।কিন্তু তার সে আশার বেলুনে পিন ফুটিয়ে ভিখিরিব্যাটা চুপসে দিল।তাই সে থ।
একই লেখকের আর একটি গল্পঃ ফুটপাথে দাঁড়িয়ে খাচ্ছিলাম। একটা ভিখিরি মেয়ে এসে হাত পাতলো। আমি খাবারটা দিতে যেতেই মেয়েটি দু-হাত পিছিয়ে বলল, ছিঃছিঃ করছেন কী? পুরোটা দিলে আপনি খাবেন কী?’
বিশুদ্ধ মানবিকতার গল্প। দারিদ্রের নিচে চাপা পড়েওখানিকটা বিবেক এখনও মেয়েটির মধ্যে বেঁচে রয়েছে। বিবেক নিয়ে যারা জন্মায়যত প্রতিকুল অবস্থাই হোক, তাদের বিবেক মরে না।
গল্পের গঠন নিয়ে কিচ্ছু বলার নেই। শুধু একটা কথামেয়েটা যেহেতু বলেছে পুরোটা দিলে’, তাই মনে হয়--শুরুর বাক্যটা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে খাচ্ছিলাম’(তার মানে--খানিকটা খাওয়া হয়ে গেছে)-এর পরিবর্তে কোন কেক-জাতীয় খাবারের সবেমাত্র মোড়ক খোলার সঙ্গে সঙ্গেই যদি মেয়েটি হাত পাততোতাহলে পুরোকথাটা আরো তাৎপর্যপূর্ণ হতো বলে মনে হয়।
এবার কৃষ্ণা চৌধুরীর খুনীগল্পটির উল্লেখ করে এ নিবন্ধ শেষ করব। গল্পটি এরকমঃ যৌথ দেওয়ালে পেরেক ঠোকা নিয়ে দুই ভাইয়ে বচসা,হাতাহাতি। সাক্ষী পড়শিরাও। পরদিন সকালে মোদো মাতাল ভায়ের রক্তাক্ত নিথর দেহ বেরোল ঘর থেকে। ব্যাস্‌,দুই আর দুইয়ে চার। হাতে হাতকড়া নিয়ে থানায় গেল গরিব গুর্বো গোবেচারা নারান। পিছনে পড়ে রইল কপাল ঠুকে ঠুকে রক্তাক্ত স্ত্রী রূপা,মেয়ে টুসু। দয়াবৎসল বিচারবাবুরা ফাঁসি নয়,দিলেন যাবজ্জীবন। নারানদের তো উকিল থাকে না। দীর্ঘ বারো বছর পর বিচারবাবুরা বিস্তর খাতাপত্তর ঘেঁটে দেখলেন বেজায় ভুল হয়ে গেছে। নারান নির্দোষ। যৌবনের সোনালি বারোটা বছর নির্মমভাবে হরণের পর নারানের মুক্তি। লোহার গেটের বাইরে এসে শুনলবিনা চিকিৎসায় রূপার মৃত্যু,রাতের অন্ধকারে টুসুর হায়নাদের ভোগ্য ও হত হওয়ার খবর। খানিক গুম হয়ে রইল নারান। তারপর,আচমকা এক ঐশ্বরিক শিক্তিতে বলীয়ান হয়ে তড়িৎগতিতে ক্ষিপ্রতায় সেপাই-এর বন্দুকটা ছিনিয়ে তার মাথায় সজোরে আছাড় মেরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সে—‘লে,ইবার সঁচেই খুন কইরলম। ভর ক্যানে তুদের জেলখানায়।
গল্পে--দুই ভাইয়ের বাচসার কারণটি লক্ষনীয়। যৌথ দেওয়াল। যৌথকথাটির সঙ্গে বচসার চিরকালীন সম্পর্ক। তাই পেরেক ঠোকার মতো সামান্য ব্যাপার নিয়েও—‘হাতাহাতিগরিব গুর্বোর পর গোবেচারাশব্দটা বাড়তি মনে হতে পারেকিন্তু তা নয়। সব গরিব গুর্বোগোবেচারা হয় না,কেউ কেউ ঝাঁঝালোও হয়। পিছনে পড়ে রইল কপাল ঠুকে ঠুকে রক্তাক্ত স্ত্রী রূপা,মেয়ে টুসু।’-বাক্যটির বাঁধুনী চমৎকার। পরের বাক্যের দয়াবৎসলশব্দটি ব্যাঙ্গাত্মক। অধিক নিষ্ঠুরতা বোঝাতেই এই শব্দটির প্রয়োগ। যেমন পকেটমারনা বলে light-fingered gentlemanবলা। একজন বিচারকের কাছে নিরপেক্ষ বিচারই কাম্য; দয়া নয়। তাই,ফাঁসি না দিয়ে যাবজ্জীবন-দেওয়ার মধ্যে কোন দয়া নেই। এবং তাই, তাঁরা বিচারক নয়, ‘বিচারবাবু। গল্পের সব থেকে ব্যঞ্জনাময় বাক্যটি হল নারানদের তো উকিল থাকে না।অবশ্য গল্পটা পড়ে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে--বারো বছর পর-বিচারবাবুরা হঠাৎ আবার খুনের খাতাপত্তর ঘাঁটতে গেলেন কেন? গল্পে সে কারণটি নেই। থাকলে ভাল হত। যেমন ভাল হত-- তড়িৎগতিতের পর ক্ষিপ্রতায়শব্দটি না থাকলে। আর যে শক্তিতে বলীয়ান হয়ে নারান খুন করল-সেই শক্তি কি কোনভাবে ঐশ্বরিকহতে পারে? যাইহোক, এসবকিছু ছাপিয়ে গিয়ে গল্পটি আমাদের কাছে উজ্জ্বল হয়ে থাকেএর শেষ বাক্যটির জন্য। লে,ইবার সঁচেই খুন কইরলম।নারানের বক্তব্যঃ আমাদের আইনব্যবস্থাই নির্দোষ মানুষকে খুনী করে তোলে। আর ভর ক্যানে তুদের জেলখানায়।’-বাক্যটিতে তুদেরশব্দটায় ঝলসে উঠেছে শ্রেণী। নারান যেন বলতে চেয়েছে-havesদের জেলখানাতো নির্দোষ  have-notsদের ভরার জন্যই।