আমি আদপে ধার্মিক নই, ধর্ম
ব্যাপারটা ঠিক কি, সেটা আজও ভালো করে বুঝে উঠতে পারি নি। ধর্ম ব্যাপারটা আমার কাছে
কিরকম পোষাক বলে মনে হয়। কেউ লাল জামা পরেন, কেউ বা নীল, সাদা অথবা সবুজ। কেউ
ধুতি-পাঞ্জাবি পরেন, কেউ প্যান্ট-জামা, কেউ আবার ইয়োরোপীয় ঘরানায় বিশ্বাসী,
সুট-বুট, টাই পরে থাকতেই ভালোবাসেন। এঁরা সবাই মানুষ, অন্তত মানুষের মতোই আকার। সবার
রক্তের রঙ লাল। রক্তের প্রয়োজনে এক গ্রুপের রক্ত অন্য গ্রুপের মানুষকে দিলে মৃত্যু
হয়, কিন্তু এক ধর্মের মানুষের রক্ত অপর ধর্মের মানুষকে গ্রুপ মিলিয়ে দিলে মৃত্যুর
পরিবর্তে জীবন ফিরে পায়।
বিভিন্ন ধর্মস্থানে বেড়াতে গিয়ে
দেখেছি, মন্দির, মসজিদ, গির্জা, গুরুদ্বোয়ারা, বৌদ্ধ বা জৈনদের তীর্থস্থলে বিভিন্ন
ধর্মাবলম্বী মানুষের ভিড়। সেই মুহুর্তে কে কোন ধর্মাবলম্বী, আপাতদৃষ্টিতে বোঝার উপায়
পর্যন্ত থাকে না। মনে হতেই পারে, যে এই ধর্মের প্রতি উপস্থিত সকল মানুষের শ্রদ্ধা,
ভক্তি, আস্থা, বিশ্বাস, ভালোবাসার কোন খামতি নেই। দর্শন, পূজা বা প্রার্থনা সেরে,
যে যার মনস্কামনা ব্যক্ত করে পরম শান্তিতে ফিরে আসেন। অমরনাথ, আজমীর শরীফ, শিলং এর
চার্চ, বিভিন্ন গুরুদ্বোয়ারা, রাজগীরের বৌদ্ধ মঠ, পাওয়াপুরি(জলমহল), সর্বত্র,
সর্বত্র একই দৃশ্য অবলোকন করার সুযোগ হয়েছে।
কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়,
আমরা সত্যই কি প্রকৃত শ্রদ্ধা, ভক্তি, আস্থা, বিশ্বাস নিয়ে ঐসব জায়গায় যাই? বোধহয়
না। চিরটা কাল শুনে আসছি, পড়ে আসছি, যে সকল ধর্মেই শান্তির কথা, মানব সেবার কথা,
ধর্মের প্রবর্তকেরা বলে গেছেন, এবং তার সঠিক পথও বাতলে গেছেন। কিন্তু ঐসব মহাপুরুষেরা তো অনেক কাল আগেই পথ বাতলে দিয়ে
অমরলোকে পাড়ি দিয়েছেন। নিজেরা সেই পথ অনুসরণ না করে, শুধুমাত্র পূজা পাঠ ও তাঁদের
স্মরণ করে ফুল ও চাদর চড়িয়ে কতটা উপকার তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে, সন্দেহ থেকেই
যায়। আমরা প্রকৃত শ্রদ্বা বা বিশ্বাস নিয়ে নয়, বোধহয় নিছক মজা ও আনন্দ পেতে,
কিছুক্ষণ সময় কাটাতেই পুণ্যস্থানে যাই। তাঁদের মুখনিঃসৃত বাণী অনুসরণ করা তো দুরের
কথা, শোনাতেই আমাদের আগ্রহের যথেষ্ট অভাব। ধর্মে ভক্তি ও বিশ্বাস নিয়ে অনেক কথা
বলা হ’ল, এবার বরং ধর্মপ্রাণ কিছু মানুষের একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করা যাক।
সত্তর দশকের মাঝামাঝি আমরা তিন
বন্ধু একবার গয়া, বুদ্ধ গয়া, রাজগীর, পাওয়াপুরি, ইত্যাদি জায়গায় গিয়েছিলাম। সঙ্গে
দুই বন্ধুর মা’ও গিয়েছিলেন। এর আগেও রাজগীর গিয়ে থাকলেও এবার চারদিন রাজগীরে ছিলাম।
প্রথম দিন থেকেই রাজগীরে একটা সাজ সাজ রব লক্ষ করেছিলাম। এখন যেমন ছোট কোন স্থানে
রাষ্ট্রপতি বা প্রধান মন্ত্রী আগমনের আগে লক্ষ করা যায়। দামি গাড়ির ছোটাছুটি, ব্যস্ততা
ও রাস্তাঘাটের চেহারা বলে দিচ্ছিল, একটা বিশেষ কিছু ঘটছে, বা ঘটতে চলেছে। খোঁজ
নিয়ে জানা গেল জাপান থেকে ওদেশের সব থেকে বড় ও সম্মানীয় বৌদ্ধ পুরোহিত নাকি রাজগীরে
এসেছেন, তাই এই আয়োজন।
দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যার সময় আমরা
পাঁচজন পদব্রজে ঘুরতে ঘুরতে বৌদ্ধ মঠটির সামনে এসে উপস্থিত হ’লাম। আমি ভিতরে
যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতেই, আমার এক বন্ধু কোন কারণ না দর্শিয়ে, ভিতরে না যাওয়ার জন্য কাকুতি মিনতি শুরু করে
দিল। ওর পরিবার অত্যন্ত ধার্মিক। পূজাপাঠ, ঠিকুজি-কোষ্ঠী নির্ণয়, ইত্যাদি তাদের
পারিবারিক জীবিকা। শেষে ভিতরে না যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করায়, সে শুধু বললো— ভিতরে
ঢুকলে গোটা সন্ধ্যেটা নষ্ট হয়ে যাবে। ভিতরে না যাওয়ার এটা কোন কারণ হতে পারে না,
তাছাড়া ভিতরে কতক্ষণ সময় কাটাবো, সেটা যখন আমাদের ইচ্ছা ও ভালো লাগার উপর নির্ভর
করে, তখন না যাওয়ার তো কোন কারণ থাকতেই পারে না। আর ঘুরে ঘুরে সবকিছু খুঁটিয়ে
দেখার জন্যই তো এখানে আসা। তাই ওর কথায় কর্ণপাত না করে, ভিতরে যাওয়ার জন্য অগ্রসর
হ’লাম।
কোন চওড়া মুল দরজা ছিল কী না,
এতদিন পরে আর মনে করতে পারি না। থাকলেও হয়তো বন্ধ ছিল। আমরা পাশের একটি সরু ভেজান
দরজা ঠেলে খোলা মাত্র একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী আমাদের প্রায় জড়িয়ে ধরে আপ্যায়ণ করে, লাইন
দিয়ে ভিতরে নিয়ে গেলেন। বাঁপাশে বেশ বড় বুদ্ধ মুর্তির সামনে দু’-তিনজন লামা
সন্ন্যাসী, তাঁদের সামনে দুটি ঢাক জাতীয় কিছু। তবে সাধারণ ঢাকের তুলনায় এগুলি অনেক
বড়, চওড়া ও উচ্চ। ডানপাশে মাটিতে কার্পেট পাতা, তাতে গোলাকার বেত বা কাঠের ফ্রেমের
মাঝখানে চামড়া লাগানো ছোট ছোট হাতপাখার মতো দেখতে একপ্রকার বস্তু ও সঙ্গে একটি করে সরু লাঠি হাতে
জনা কুড়ি-পঁচিশ পুরুষ ও মহিলা বসে। একে একে আমাদের সবাইকে এগিয়ে গিয়ে বুদ্ধ
মুর্তির সামনে মাথা নীচু করে নমস্কার করে, একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর হাত থেকে
দু’-চারটি নকুল দানা বা এলাচ দানা, একটি চামড়ার হাতপাখা, ও একটি লাঠি নিয়ে
কার্পেটের ওপর বসতে হচ্ছে। আমি সবার পরে ঢুকে বুদ্ধ মুর্তির সামনে দাঁড়িয়ে নকুল
দানার জন্য হাত পাতলে, বৌদ্ধ সন্ন্যাসী আমার মাথাটা তাঁর হাত দিয়ে চেপে নীচু করে,
কয়েকটি নকুল দানা, একটি হাতপাখা ও একটি লাঠি হাতে দিয়ে বসতে বললেন। আমরা কার্পেটের
বেশ পিছন দিকে গিয়ে বসলাম। সন্ন্যাসীরা বোধহয় নতুন ভক্তদের আশায় আরও কিছুক্ষণ
অপেক্ষা করলেন। নকুল দানা ভক্ষণ হয়ে গেছে, তাই উঠে চলে আসতেও পারছি না।
একটু পরেই শুরু হ’ল প্রার্থনা—“
না-মে-মিও-হো-রেন-গে-কিও”। টেনে টেনে একটা অদ্ভুত সুর করে এই সাতটি শব্দ উচ্চারিত
হতে শুরু করলো, সঙ্গে অপেক্ষাকৃত বড় বড় লাঠি দিয়ে মন্ত্রের তালে তালে বড় বড় ঢাক
পেটানো। উপস্থিত সকলেই বড় ঢাকের সাথে তাল মিলিয়ে নিজ নিজ হাতপাখায় লাঠিপেটা করে, ঐ
সুরে মন্ত্র পাঠ শুরু করে দিল।
কি করা উচিৎ বুঝতে পারছি না।
এইভাবে কতক্ষণ অনুষ্ঠাণ চলবে তাও জানা নেই। ঐ বন্ধুকে কী করা উচিৎ জিজ্ঞাসা করে
মুখঝামটা খেতে হ’ল। সত্যি কথা, ও এই ব্যাপারে আগেই সাবধান বাণী শুনিয়েছিল। নকুল
দানা ফেরৎ দিয়ে দিলে কিছু সুবিধা হ’ত কী না জানি না, কিন্তু এখন তো আর সে সুযোগ ও
নেই, তাই অসহায়ের মতো ঢাকের তালে তালে চামড়ার হাতপাখায় লাঠি পেঠা করছি, সঙ্গে সুর
করে করে মন্ত্রপাঠ।
ঠিক এই সময় হঠাৎ লোড-শেডিং হয়ে
গেল। মোমবাতির স্বল্প আলোয় প্রায়ান্ধকার ঘরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের আরও কিছু মোমবাতি জ্বালাবার সুযোগ
না দিয়ে, ঘরে, বাসে, বা অন্য কোন স্থানে হঠাৎ আগুন লেগে গেলে যেভাবে হুড়োহুড়ি করে
প্রতিটি মানুষ সর্বাগ্রে নিজেকে বাঁচাতে চায়, ঠিক সেইভাবে কে আগে ঐ সরু দরজা দিয়ে
ঘরের বাইরে যাবে, তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। তখন ঘরের ভিতর উপস্থিত সকল আপাত
ধার্মিক পুরুষ-মহিলার ভিতর একটা ভবিষ্যৎ মিলখা সিং-এর ছায়া লক্ষ করা গেল। বন্ধুটির
চেষ্টায়, হয়তোবা বুদ্ধেরও ইচ্ছায়, শেষপর্যন্ত নিরাপদে অক্ষত দেহে ঘরের বাইরে এসে,
ভক্তদের চটি-জুতার যা হাল দেখলাম, বড় কোন জঙ্গি বোমা বিষ্ফোরণের পরেও মৃত, আহত, ও
দিগভ্রান্ত মানুষদের চটি বা জুতো ঐভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে না। অনেকেই উদ্বিগ্ন হয়ে
একপায়ে জুতো গলিয়ে অপর পায়ের সাথিকে তখনও ভিড়ের মাঝে হাত ছেড়ে হারিয়ে যাওয়া শিশু
সন্তানকে খুঁজে বার করার মতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা রাস্তায় এসে নিশ্চিন্ত
মনে চায়ের দোকানের সন্ধানে লেগে পড়লাম।