গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৬

শান্তিময় কর

রম্য গদ্য

অধ্যবসায়

কে বলে ইচ্ছে থাকলে উপায় হয় না ? মানুষের ইচ্ছেটাই বড় কথা । কেউ যদি ভেবে নেয়
কোন একটা কাজ তার পক্ষে করা সম্ভব নয়, তাহলে আমি বলবো সে রকম ভাবাটা ভুল । সে ক্ষেত্রে আমি ভেবে নিতে পারি তার মনের ইচ্ছে বা আত্মবিশ্বাসের অভাব আছে । মনের জোর আর আত্মবিশ্বাসে ভর করে মানুষ অনেক অসাধ্য সাধন করতে পারে । আমি তো এমন অনেক কে দেখেছি যারা অতি সাধারণ, নুন আনতে পান্তা ফুরনোর মত যাদের আর্থিক অবস্থা, কোন রকমে দিন গুজরান হয়, তারাই পরবর্তী জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত, উচ্চ শিক্ষিত এবং সমাজ জীবনে গুণী মানীদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ।
আমার চাকুরি জীবনে আট নয় বছর আমি অফিসের মেসে থাকতাম । ঐ মেসে আমার সাথে আরও নজন সদস্য থাকত । আমাদের এই দশ জনের রান্না করার জন্য একটি ছেলে ছিল । তার নাম অনিল (নাম পরিবর্তিত ) । তার হাতের তৈরি করা খাবারের কথা উল্লেখ না করলেও চলে, কারণ আজকের প্রসঙ্গ টা অন্য, কিন্তু না বলেও থাকতে পারছি না । তার হাতের গুনে বা বলা উচিৎ তার হাতের রান্নার স্বাদে ভাবাই মুস্কিল ছিল যে বাড়ী ছেড়ে অনেক দূরে পড়ে আছি । আসল কাহিনী অন্য জায়গায় । আমি ঐ মেসে আসার আগে থেকেই অনিল ওখানে কাজ করতো । প্রথম প্রথম ভাবতাম, অজ গ্রাম থেকে আসা একটা ছেলে এত ভাল, এত সুন্দর রান্না শিখল কি করে । ওকে জিজ্ঞেস করলাম একদিন। ও বলল 'আপনাদের আশীর্বাদে শিখে নিয়েছি' । পরে জানতে পারি, মেসের সদস্যেরা যে যখন বিয়ে করে অন্যত্র বাড়ী ভাড়া নিয়ে চলে যায়, অনিল তখন অবসর সময়ে, তাদের স্ত্রীদের কাছে গিয়ে নিত্য নতুন রান্না শিখে এসে আমাদের রসনা তৃপ্ত করে । শুধু কী তাই? ও তাদের কাছে লেখা পড়া বা আরও অনেক কিছু সম্পর্কে জানতে চাইত ।
একবার আমাদের মেসের এক বন্ধুর ভাই রাউরকেলা থেকে তার দাদার কাছে তিন চার দিনের জন্য বেড়াতে এসেছিল । সে ওখানে ব্যাঙ্কে চাকরি করতো । অনিলের রান্না, আদর যত্ন এবং তার ব্যবহারে সে খুব খুশী হয়েছিল । সে অনিল কে জিজ্ঞেস করলো , "তা তোমার লেখাপড়া কতদূর" ? অনিল বলল, "অষ্টম শ্রেণীতে পাশ করার পর টাকা পয়সার অভাবে আর পড়তে পারিনি আর তা ছাড়া কিছু রোজগার করে বাবা মাকে সাহায্য করার খুবই দরকার ছিল । সেই সুবাদেই এই মেসে কাজ করা" । সে তখন অনিল কে বলল, "আমাদের ব্যাঙ্কে অস্থায়ী পিওনের পোস্ট খালি আছে । তুমি যদি করতে চাও, ওখানে চলে এসো । এখন অস্থায়ী হলেও দু বছরের মধ্যে স্থায়ী হয়ে যাবে । আমি তো আরও কয়েকদিন আছি, ভেবে বোলো" । পরের দিন অনিল আমাকে জিজ্ঞেস করলো, "আপনি তো কাল সব শুনলেন, ব্যাঙ্কের কাজে যোগদান করার ব্যাপারে আপনি কি বলেন ? আসলে ভালো মন্দ একটু যদি বুঝিয়ে বলেন"। ওকে বললাম, "মন্দের কোন ব্যাপার নাই । খুবই ভালো । তাছাড়া কারও বাড়ীতে সারা জীবন রান্না করেই কাটাবে নাকি ? ভবিষ্যৎ কি আছে এই কাজে" ? ও আর দ্বিধা করে নি । আমাদের জন্য অন্য একজন রান্নার লোক ব্যবস্থা করে দিয়ে কয়েক দিনের মধ্যেই ও রাউরকেলা রওনা হয়ে যায় । এক মাসের মধ্যে ও চাকুরিতে নিযুক্ত হয়ে যায় । তারপর থেকে মাঝে মাঝে অনিল আসতো আমাদের সাথে দেখা করতে । পরে আর ওর সাথে আমাদের কোন যোগাযোগ ছিল না । তার প্রধান কারণ যার ভাইয়ের মাধ্যমে ওর চাকরি, সে কলকাতা চলে যায় বদলি নিয়ে আর আর আমরাও বৃহত্তর জগতের দৈনন্দিন জীবন যাত্রায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি । 
প্রায় কুড়ি বছর পর এক ছুটির দিন বিকেলে চা সহযোগে ছেলে মেয়েকে নিয়ে আমার স্ত্রী আর আমি গল্প করছি, এমন সময় কল বেলের শব্দে আমার ছেলে দরজা খুলে দিতে শুনতে পেলাম, "এটা কি শান্তি বাবুর বাড়ী ? ছেলে বলল, "হ্যাঁ, ভিতরে আসুন" । দেখলাম সফরি স্যুট পড়া এক সুদেহী ভদ্রলোক ঘরে ঢুকেই আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, "আমাকে চিনতে পারেন বাবু ? আমি অনিল, আমি আপনাদের মেসে রান্না করতাম" । ওর কথা শুনে আমি অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে তাকিয়ে থেকেছি আর পুরনো দিনের সব স্মৃতি মনের পর্দায় ভেসে উঠেছে । কিন্তু কিছুতেই হারিয়ে যাওয়া দিনের লুঙ্গি পরা সেই অনিলের সাথে এই অনিল কে মেলাতে পারছিলাম না । বিস্ময়ের ঘোর কেটে যেতে ওকে জড়িয়ে ধরেছিলাম আমার বুকে । ওর চোখে জল আর আমারও একই অবস্থা । কত যে আনন্দ হচ্ছিলো আমার মনে, বলে বোঝাতে পারবো না । প্রসন্ন হয়ে গেল মনটা আমার । কথায় কথায় জানতে পারলাম ঐ কুড়ি বছরে চাকরির সাথে সাথে ও পড়াশুনো করে গ্রাজুয়েশন করেছে এবং চাকুরিতে প্রোমোশন পেয়ে আজ সে ওদের ব্যাঙ্কের একটি ছোট শাখার ইনচার্জ । ওর উন্নতিতে দারুন খুশী হলাম । ওর আরও আরও উন্নতি কামনা করলাম । সে আরও বলল যে অফিসের এল-টি-সি তে ও স্ত্রী, ছেলে মেয়ে এবং মা, বাবা সবাইকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছে দক্ষিণ ভারত । ওর এই উন্নতি আর ওর মনের পরিতৃপ্তি আমার হৃদয় মন ছুঁয়ে গেলো । আমরা প্রকৃত অর্থে ওর জন্য কিছুই করিনি । তবু সে বারবার বলতে লাগলো " আপনাদের কাছে আমি ঋণী, চির কৃতজ্ঞ । আপনাদের জন্যই ত আমার এই উন্নতি, এই প্রতিষ্ঠা "। যতই বলার চেষ্টা করি, সে বলতেই দিল না । সেদিন ওকে আর যেতে দিই নি । পরদিন অফিস যাবার পথে বাস স্ট্যান্ডে ওকে বাসে তুলে দিয়ে শুভ কামনা জানিয়ে অফিস চলে গেলাম ।
একেই বলে অধ্যবসায় । মানুষ নিজের ভাগ্য এবং ভবিষ্যৎ নিজেই রচনা করে । শুধু যা দরকার, তা হল ইচ্ছে, মনের জোর, সংকল্প, একাগ্রতা, আত্ম প্রত্যয় এবং নিবেদিত প্রাণ । অনিল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ।