সুখ দুঃখের মানসিকতা বোধহয়
প্রত্যেক মানুষের কম বেশী একই রকমের। রমাকান্ত ভাবেন, সময়ের অবসরে ভাবতেই থাকেন।
কয়েকদিন যাবত তিনি ফুটপাতের
এক পরিবারের প্রতি নজর রেখেছেন। এক ছেলে নিয়ে বাপ মা ওরা তিনজনে বেশ কিছু দিন ধরে ফুটপাথে
থাকে। এমনিতে ওরা যে সহায়-সম্বলহীন একথা কাউকে আলাদা ভাবে বুঝিয়ে দেবার নয়। টিনের জংধরা
একটা থালা,
মাটির হাঁড়ি, পাতিল, আর ছেড়া ময়লা কাঁথা কাপড়
নিয়ে ওদের সংসার। ওদের দুঃখ তা হলে কত দূর, কতটা বড় হতে পারে? আর সুখ, ওদের কি আদৌ সুখ বলে কিছু
আছে ? একমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে
ওরা বেঁচে আছে।
পেটের তাগিদে দিন ভর ওরা
ঘুরে বেড়ায়। ছেলেটাকে দেখেন রমাকান্ত। এর ওর সামনে হাত পাতে, দু দিন কিছু খায়নি, বলে
পয়সা চায়। কেউ দেয়, কেউ দেয় না। ওর বাবা যখন যা পায় টুকটাক কাজ করে। কুলি-মজুরি করে, অনিয়মের ফাঁকে কখনো ভিক্ষার
হাত পেতে দেয়। আর কিছু না পেলে ফেলে দেওয়া খাবারের পোটলা খুঁজে দেখে অবশিষ্ট কিছু আছে
কি না। এঁটোকাঁটার বালাই ছেড়েছে ওরা। ও সব মানসিকতা থাকলে ওরা পেটে বাঁচবে কেন ? কি ভাবে জীবনকে শেষ পর্যন্ত
বয়ে নিয়ে যাবে
?
ছেলেটার মা কি করে ? ওই একই কাজ, ভিক্ষা চাওয়া, পোটলা কুড়িয়ে ফেরা, কিম্বা সপ্তাহে এক আধ দিন
কাঠকুটো কুড়িয়ে এনে তিন ইটের পাতা উনানে ফুঁ দিয়ে দিয়ে আধ ফোটান ভাত রান্না করা। বলে
না পাপী পেট
! সত্যি তো তাই--ফুটপাতের এই জীবন যাত্রা
যে কতখানি দুর্বিষহ রমাকান্ত তা ভেবে পান না।
রমাকান্ত ছেলেটিকে একবার
ডেকে ছিলেন। ছেলেটি প্রায় দৌড়ে তাঁর কাছে এসে গিয়ে ছিল। ওর কতই বা বয়েস হবে, বার
চোদ্দর বেশী না। ও জানে কিছু না কিছু ও পাবে, খাবার কিম্বা পয়সা।
--কি নাম তোর ? রমাকান্ত প্রশ্ন করেছিলেন।
ছেলেটা চুপ করে ছিল।
রমাকান্ত আবার জিজ্ঞেস করলেন, তোর নাম কি ?
- অংছ
- কি ? অংশ ?
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে ছিল অংশ।
-অংশ মানে কি জানিস ? প্রশ্ন করতে গিয়েও করেননি
রমাকান্ত,
জিজ্ঞেস করেছিলেন,
তোরা তো ফুটপাতে থাকিস ?
- হ।
- কি খাস ?
- যা পাই--
- রাত্রে ফুটপাতেই থাকিস ?
- হ
- অসুবিধা হয় না?
- না
- জানি তোদের খুব দুঃখ--
অংশ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল।
রমাকান্ত ভেবেছিলেন, দুঃখে বোধহয় সে চুপ হয়ে
ছিল।
তুই পড়তে জানিস ?
- হ
- বই পড়তে পারিস ?
- কিছু কিছু--
- স্কুলে পড়েছিস ?
- চাইর ক্লাস তক
-তোর বাবা পড়া লেখা জানে ?
-বাবা পাঁচ ক্লাস পাস। উসখুস করছিল অংশ। আর যেন দাঁড়াতে পারছিল
না ও।
রমাকান্ত তবু প্রশ্ন করেছিলেন, তোরা ফুটপাতে থাকিস কেন ?
- কি করমু--কাকা জ্যাঠারা আমাগো ঘর ছাড়া
করছে--আমি যাই--
রমাকান্ত পকেট থেকে একটা
দশ টাকার নোট বের করেছিলেন, অংশর হাতে তুলে দেবার আগেই অংশ হাত বাড়িয়ে সেটা খপ করে
ধরে নিয়েছিল। মনে হয়েছিল দেরী হলে টাকাটা কেউ তার হাত থেকে বুঝি ছিনিয়ে নেবে ! রমাকান্ত
লক্ষ্য করছিলেন অংশকে। টাকা পেয়ে ওর মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল
যেন একটা আনন্দ-উচ্ছ্বাসের ভাব ওর মধ্যে থেমে আছে। আর না দাঁড়িয়ে নির্বাক সে ছুটে গিয়েছিল
ওদের ফুটপাতের দিকে।
রমাকান্ত দূর থেকেই
দেখতে পাচ্ছিলেন, অংশ তার মার হাতে তুলে দিয়েছিল টাকা। ওর বাবা তখন সেখানে ছিল না।
ছেলেটা হাসছিল,
ওর মায়ের মুখেও
হাসি ফুটেছে বলে মনে হয়েছিল রমাকান্তর। তার মানে ওরাও হাসতে জানে ! ওরাও বাঁচতে জানে ?
রাতের জীবন ওদের কেমন দেখা
হয়নি রমাকান্তর। বড় ইচ্ছে হল ফুটপাতে গিয়ে ওদের রাতের কথা জানতে। রাতের খাওয়া সেরে
তিনি বেরিয়ে পড়লেন ফুটপাতের দিকে। অংশদের গুটানো গাঁটরি পোঁটলার জাগা ঘিরে এখন ছেঁড়া
কাঁথা-কাপড় টাঙানো। কোন মত একটু আবডাল করার চেষ্টা আর কি--ওদের রাতের ডেরা এটা। বোঝা গেল, ওরা
শুয়ে পড়েছে। তবে ওরা তখনও ঘুমায় নি। রমাকান্তর দেখলেন, ডেরার বাইরে চার পা বেরিয়ে আছে, আর,
আর পায়ে পায়ে কেমন জড়াজড়ি চলছিল ! রমাকান্ত ভাবলেন, তা হলে এ সুখটাও ওরা নিতে পারে ! এ মানসিকতাও ওরা খুঁজে পায় ? তিনি বুঝতে পারলেন অংশ
ডেরায় নেই। ও তবে কোথায় ? আরও কয়েক পা এগিয়েই অংশকে দেখতে পেলেন রমাকান্ত। ও দেওয়ালের
গায়ে হেলান দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। লাইট পোস্টের আলোয় অংশকে দেখা যাচ্ছিল। রমাকান্ত এগিয়ে
গেলেন, ডেকে উঠলেন, অংশ !
অংশ চমকে উঠলো। তাকাল রমাকান্তর দিকে, বলে উঠলো, বাবু ?
- তুই কি করছিস এখানে ?
উত্তর দেওয়ার আগে অংশ একটু সময় চুপ
করে দাঁড়ালো, তারপর ঈষৎ সঙ্কোচ নিয়ে বলল, চাঁদ দেখছিলাম।
রমাকান্ত ভীষণ আশ্চর্য হলেন, চাঁদ !
মাথা নাড়ল অংশ, ধীরে ধীরে বলল, আমার
বন্ধু জামাল কইছে, কবিরা নাকি চাঁদ দেইখা কবিতা লেখে, তাই দেখছিলাম--
রমাকান্ত এবার যেন হতবাক। এই ফুটপাতের
ছেলে আকাশের চাঁদ দেখে ? তার মধ্যে কবিতার ভাবনা ঢুকে পড়তে পারে !
রমাকান্ত বুঝলেন, অর্থ-কড়ি, যশ, নামডাক এ
সব কিছুই মানুষের সুখের আধার নয়। এ সবের মধ্যেও মানুষের মনে নিরন্তর ভাবনার টানাপড়েন
থেকেই যায়। আরও ,আরও পাবার লক্ষ্য তাদের দুঃখাতুর করে তোলে। ভগবানের নিক্তি মাপের সুখ
দুঃখ তা হলে কি প্রত্যেক মানুষই সমান ভাবে উপভোগ করে ? হ্যাঁ, সবটা না হলেও অনেকটাই তাই।