--না রে, আমি তোকে ছেড়ে, দাদুভাইকে ছেড়ে, কোথাও যেতে পারব না, ছেলের কথার জবাবে সেদিন
মার জবাব এমনটাই ছিল। সংসারে এত অশান্তি, এত ঝগড়া, মন কষাকষির এমনি হাজার ব্যাপার থাকলেও
মা’র মন কাঁদে ছেলে নাতনীদের ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে উঠতে।
যখন নতুন বৌমা এসে ছিল তখন শাশুড়িও
এটা না, ওটা না, এটা এমনি ভাবে, ওটা অমনি ভাবে করো--এমনি
অনেক কিছু ছেলে বউকে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিতে গিয়ে কিছু কিছু কথাও বউমাকে শাশুড়ির
কাছ থেকে শুনতে হয়েছে বৈ কি ! তারপর একদিন বৌমা তার নিজের স্থান পোক্ত করে নিয়েছে।
এখন শাশুড়ির ওপর চলল তার খবরদারি।
ছেলে অনিমেষ শুরুতে যথাযথ ভাবে কখনও মায়ের, কখনও বৌয়ের
সমর্থন করে গেছে। তারপর সে অনেকটা বউ ঝোঁকা হয়ে পড়েছে। আর তা ছাড়া যে ভাবে হোক সংসারে
তার শান্তি চাই। তবে বউ যে আজকাল মার ওপর হাবি হয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে পারলেও নানা কারণে
বৌয়ের পক্ষ তার নিতেই হয়। মাকে মাঝে মাঝে কিছু কথা তাকে শোনাতেই হয়। মাকে নিয়ে অনিমেষ
আর লিলির মাঝে ঝগড়া হলে মাঝখানে মা এসেই পড়েন আর তারপরই শুরু হয় কোমর
কষা ঝগড়া। আর এমনি ভাবে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার দিনের পর দিন চলতেই থাকে। এমনি পরিস্থিতিতে সব
ছেলেদের মত অনিমেষও মাঝখানে থেকে কিছুটা পিষতে থাকে।
বৌমার সঙ্গে বেশী লাগলে শাশুড়ি অতিষ্ঠ
হয়ে বলেই ফেলেন , না, আমায় আশ্রমেই চলে যেতে হবে দেখছি, তবে যদি তোমাদের শান্তি হয়--
--ঠাম্মা, ঠাম্মা, তুমি কানছ কেন ? পাঁচ বছরের নাতনী ঠাকুমাকে
ধরে করুণ মুখে বলে ওঠে।
ঠাকুমা তাড়াতাড়ি চোখ মোছেন, না দাদু ভাই, কাঁদছি না তো !
--দেখলাম তুমি কানছ !
--তোমাদের জন্যে মন খারাপ হয় তো দাদু
ভাই !
এমনি এক দাদু ভাইকে ছেড়ে কি করে ঠাকুমা
বৃদ্ধাশ্রমে যাবেন ? কিছুতেই ভাবতে পারেন না ঠাকুমা।
বউ রেগে বলে, আমায় বাপের বাড়ি পাঠিয়ে
দাও, আর মা বলেন, বৃদ্ধাশ্রমে
পাঠিয়ে দে আমাকে--সংসার বাঁচাতে কি যে করবে অনিমেষ ভেবে পায় না।
নাতি অতশত বোঝে না। ঠাকুমার ন্যাওটা
বলে মার-ধোর খেতে হয় তাকে।
শাশুড়ি দেখে হয় তো বলেন, ওকে এত মারো কেন বউ মা ?
বৌমা ফস করে ওঠে, আপনি ওকে মাথায় তুলবেন না
বলে দিচ্ছি, সামলাতে হয় তো শেষে আমাকেই !
--ও তো আমার কাছেই বেশীটা সময় থাকে--
ঠিক আছে কালকে থেকে আর থাকবে না। ব্যাস,
পরদিন থেকে ঠাকুমার কাছে নাতীর আসা বন্ধ হয়ে যায়।
নিত্য দিনের এমনি পাঁচালি শেষে মহাভারত
পর্যন্ত গড়ায়। এক দিকে নাতী কাঁদতে থাকে, অন্য দিকে ছেলে, বৌমা আর শাশুড়ির ভয়ঙ্কর বাক যুদ্ধ চলতে থাকে।
একদিন বউ অনিমেষকে বলে, আর আমি পারছি না, তুমি
মাকে আশ্রমে পাঠিয়ে দাও, মা নিজেই তো বারবার বলেন, আমি আশ্রমে চলে যাব!
--মন থেকে অমনটা বলে মা !
--তোমায় না বললেও, আমায় তো রোজই বলছেন !
অনিমেষ ধৈর্য হারা হল, একদিন তাই সে মার কাছে প্রস্তাবটা
পেশ করেই দিল--মা তুমি আশ্রমেই চলে যাও
!
ছেলে এমনি কথা মাকে বলতে পারে, এ
যেন মার ভাবনার বাইরে ছিল। অভিমান ভরে মা’র তখন মনে হয়ে ছিল যে এখনই তিনি আশ্রমের
দিকে পা বাড়ান। তৎক্ষণাৎ মা ছেলের ওপরে রাগ করলেও নাতীর কথা ভেবে শেষমেশ ছেলের এমনি প্রস্তাবে তিনি সায় দিতে পারেননি।
কিন্তু বউমা তাঁর পেছনে পড়ে ছিল, মাঝে মাঝে শাশুড়িকে শোনাতে
ছাড়ত না, কি হল মা, আপনিই তো বলেন আপনি নাকি
আমাদের শান্তির জন্যে আশ্রমে চলে যাবেন ! এখন কি হল ?
রাগে দুঃখে মা শেষে ঠিকই করে নিলেন,
তিনি সত্যি বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাবেন।
যাবার দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেল। তারপর
থেকে ঘরে শান্তি চলছিল। বৌমার মুখে সুখের আভা ফুটে উঠেছিল। শাশুড়ি মা কেঁদে চলেছিলেন, স্বামী ছেলে পরিবৃত সংসারের
পুরানো স্মৃতি, ছেলে আর নাতীর ভাবনা তাঁকে মর্মে মর্মে মেরে চলে ছিল। তবু, তবু তিনি ঠিক করলেন, চলে যেতে হবে--তাকে চলে
যেতেই হবে--অন্তত ছেলে আর নাতনীর সুখের
দিকে তাকিয়ে।
গল্প এখানেই কি শেষ হয়ে গেল ?
প্রায় প্রত্যেক সংসারে এমনি ঘটনা প্রবাহ
ঘটে চলেছে। বৌমা, শাশুড়ির কোন্দল কোথাও সংসার ভাঙছে আবার কোথাও অশান্তির আকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
পুরুষের দোষের অভাব নেই জানি, তবু এ কাহিনীর
বিন্দু টেনে নিয়ে বলব, নারীর দোষ-ত্রুটিগুলি সংসারের অন্তঃস্থল ঘুণ পোকার মতই কাটতে থাকে।