ট্রেন থেকে নেমে
পাক্কা তিন মাইল পথ হেঁটে তবে কাচিঝুরি গ্রাম। সারারাত আধোঘুমে জেগে বসে কেটেছে ওদের। কোমরের খতিতে এতগুলো
টাকা ! একজন ঘুমে ঢলে পড়লে অন্যজন কনুই গুঁতিয়ে জাগিয়ে দিয়েছে । ঘুমঘোরে দুজন
দুজনের দিকে লালচোখে তাকিয়ে আবার ঢুলতে থাকে।ঢুলতে ঢুলতে কাচিঝুরি স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে আড়মোড়া ভাঙ্গে সালামত
আর লক্ষ্মণ মাঝি। ভোরের ঠান্ডা বাতাস শরীরে কামড় বসাচ্ছে।চনমন করে উঠে লক্ষ্মণ গরম
চায়ের সুবাস পেয়ে।আঠারো বছর আগে বিয়েতে পাওয়া জীর্ণ রংচটা ডিজাইন ঝাপসা হয়ে
যাওয়া চাদরটা গায়ে ফেলে সে আবদার ধরে, সালামতভাই আজকে কিন্তুক চা নাস্তা খায়েই
বাড়িত যামু কলাম।
সালামত হাসে।
ষ্টেশনের সব চেয়ে সুন্দর পরিষ্কার, টিভি লাগানো হোটেলে সকালে তেহারী নেহারি বানায় বিহারী বাবুর্চি
জানে আলম। প্রত্যেকবার কাজে যাওয়ার সময় লক্ষ্মণ নাকের ফুটো বড় করে ঘ্রাণ নিতে নিতে
প্রতিজ্ঞা করে এইবার কাজ শেষে আসার সময় অই তেহারি নেহারি খাবেই খাবে। কিন্তু সালাম
পাত্তাই দেয় না। মুখটাকে গম্ভীর করে ধমক দেয়,
পা চালা জব্বর ঘুম ধরিছে। অসন্তুষ্ট মুখে লক্ষ্মণ সালামের সাথে হাঁটে আর গজর গজর করে নাও চলেক। সেই ত জলদেওয়া
একগাদা মোটাচালের ভাত সান্ধাতি হবেনে এহন। বাতাস বাঁচিয়ে বিড়ি ধরাতে ধরাতে সালাম বলে, মিথ্যে বলিস না লাকু। এই সক্কালে তোর
ছেলে গরম ভাত খায়ে ইশকুলে যায়। কি ছেলে তোর একবার ভাবি দিখিছিস!”
লক্ষ্মণের মুখে খুশির ছ্যাকা লাগে যেন।
পড়াশুনায় ছেলে তার গ্রামের গর্ব। লাজুক হেসে বলে, তবু জানে আলমের তেহারি নেহারি সালামতভাই!
বড় সোয়াদের মাইরি!” আজকে স্টেশনে নেমেই চা
বিস্কুট খেয়ে বিড়ি কেনে দুজনে। লক্ষ্মণ ত্যারছা চোখে সালামকে দেখে সাদা টুপি পরানো
সিগারেটের প্যাকেটে একবার হাত বুলিয়ে নাকের কাছে নিয়ে রেখে দেয়, শালার কি গন্ধ
ছুইটছে রে! সালাম কড়া করে তাকায়। আমাগো
বিড়িই ভালা। ঘরের মাইয়া মানুষের লাহান চেনাগুনা। ল হাটেক । আরে ইদিকে আয়---।
রবারের স্যান্ডেল পরা
কালো থ্যাবড়ানো হাজামাজা পা ফেলে ওরা হেঁটে চলে। প্লাস্টিকের ছোট প্যাকেট খুলে মাঝে মাঝেই
মিষ্টি মশলা বের করে খাচ্ছে লক্ষ্মণ। তোমার মনে এই আছিল সালামতভাই হিহিহি--- জানে আলমের হোটেলের তেহারি নেহারি খেয়ে ফুরফুর
করছে লক্ষ্মণ। সালামকে হোটেলের দিকে যেতে দেখে প্রথমে অবাক হলেও খুব খুশী হয়েছিল সে। দশদিন গ্রাম
ছাড়া। মাছ ধরতে চলে গেছিল সেই কতদূর।
সিলেটের জল বড় ঠান্ডা। হিম মাখানো । সাথে সাথে শরীরে ঠান্ডা লাগে না। আস্তে আস্তে
ঠান্ডাভাব শরীরটাকে সাপের মত পেঁচিয়ে ফেলে। নিঃশ্বাস ছাড়লে মনে হয় নাকে ব্যাথা
দিয়ে ভারি হিম পাথর বেরুচ্ছে। হাত পায়ের আঙ্গুল যখন বরফজমা জমে উঠছে। দুজনেই মনে
মনে হাল ছেড়ে দেবে বলে ভাবছে তখুনি জালে মাছটা ঢুকে পড়ে। লক্ষ্মণ জালের দড়ি দাঁতে কামড়ে ফিসফিস করে বলে, সাত পীরের নাম লও সালামত
দাদা। মনে লয় বড় একখান কিছু – সালাম তেমনি দাঁত কিটকিট করে, জাল ঢিলা দিস না মাঝির
পুত। আগে ত মাছ পাই তাপ্পর তোর সাত পীরের গুষ্টির নাম!
লক্ষ্মণের চেয়ে
গোটা দুই বছরের বড় সালামত। তায় আবার ঘর পালিয়ে কাদের সাথে যেন ছিল প্রায় পাঁচ বছর।
তারা আবার কোন্ বিদেশি সাহেবের নামে জোকার তুলে গ্রামের অবস্থাপন্ন ধনী ঘরে ঘরে ডাকাতি করত।
সহজে ডাকাতি করতে না পারলে গুলি করে মেরে ফেলে সেই সাহেবের নামে জিন্দাবাদ বলে
পালিয়ে আসত।পনের বছর বয়েসে সালাম বাপের জন্যে খাবার নিয়ে ঘাটে যাচ্ছিল। সর্ষে বাটা
দিয়ে কচু পোড়া ভর্তা, তারা বাইনের চচ্চড়ি
আর কুমড়ো শাকের পাশে কাঁচা পেয়াজ মরিচ দেওয়া মেলামাইনের গামলা গামছায় বেঁধে গলা
খুলে “এক যে ছিল সোনার কইন্যা মেঘবরণ কেইশ” গাইতে গাইতে সেই যে গ্রাম ছাড়ল তারপর আর ফিরে
আসেনি।
কালাম মাঝি বছরের
অর্ধেক সময় নৌকা বায় তো বাকী অর্ধেকে মাছ ধরে। ছেলের খোঁজে অনেক গ্রামেই গেছে
কিন্তু কেউ কোন দিশা দিতে পারেনি। কেউ কেউ বলেছিল, শহরে গেছে গ্যা। কালাম চেনাজানা
কয়েক জনের কাছে খোঁজ তাল্লাস করেছিল।কিন্তু কেউ সালামের কোন হদিস জানাতে পারেনি। গরীবের
ঘরে দুঃখ কষ্টের বিলাসিতা স্থায়ী হতে পারেনা। ভুলতে না চাইলেও পেটের টানে ভুলে যেতে হয়। কালাম মাঝিও ভুলে গেছিল। কেবল সালামতের
মা বিনবিনিয়ে নিয়ম করে কেঁদে যেত । আস্তে ধীরে এই কান্না সংসারের নিত্যতার সাথে
জুড়ে যায়। অমাবস্যা পূর্ণিমার আলো আঁধারের
মত সেই কান্নাকে কালাম মাঝি মান্য করত। শীতকাল
হলে মোটা কাঁথায় কান ঢেকে আর গরম কাল হলে
বাড়ির উঠোনের আমলকি গাছের নীচে বাঁধা টঙ্গে শুয়ে দূর থেকে সে কান্নার সুর শুনত। বউ
যেদিন সুর তুলে কাঁদতে বসত না সেদিন মাঝির চিন্তা হত, মাঝিনির কোন অসুখ করে নাই
তো! সেইসব রাতে সালামকে মনে করে সারারাত জেগে থাকত কালাম মাঝি।
সদ্য জোয়ান হয়ে
উঠা ছেলের হাতের টানে নৌকা টলমল করে উঠত।
আর কি সুখে কালাম মাঝি স্বপ্ন দেখত। এই
নদি , জলের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা মাছ এবার কত দূর পালাবে এই নওজোয়ানের কব্জির জোর
থেকে! কালাম মাঝির সুখের দিন আগত প্রায়!
বছরের চার মাস আর শাক পাতা শামুক গুগলি খেয়ে থাকতে হবে না। কিন্তু ছেলে নিরুদ্দেশের
পরে কেমন ন্যাতা মেরে গেছিল মাঝি। ঘুমুলেই সালামের শক্ত কব্জি স্বপ্নে ভাসত। রাতে ঘুমুতে চাইত না সে। মাঝরাত
অব্দি সুকুমারের আখড়ায় গানবাজনা শুনে ঘরে ফিরে ছেঁড়া জাল বুনতে বসত নইলে বারান্দায়
ঘাপ্টি মেরে একের পর এক বিড়ি টানত।
বাদুড়ের মত রাত জাগা অভ্যাস হয়ে গেছিল তার। বউয়ের ঘুনঘুনে কান্না শুনতে শুনতে ভাবত
কাঁদুক। কাঁদুক। পৃথিবীতে জলের বড় অভাব হচ্ছে। নৌকা চলে না। মাছ ভাসে না। মায়েরা
কাঁদলে তবু পৃথিবী জল পাবে। মায়ের চোখের জল ছাড়া যে পৃথিবীর পরমায়ু বাড়ে না। তবু
মাঝে মধ্যে ঘোর লাগত! দিনে দুপুরে ছেলেটা গেল কোথায় ? যে বয়েস তাতে তো ছেলেধরা ধরবে
না। বাড়িতেও অশান্তি হয়নি কো কোন। রাগ অভিমান কিচ্ছুটি না। তবে সালামতের এই হঠাত
নিরুদ্দেশের কারণ কি?
সালাম মাঝি খেলাতে খেলাতে হাওড়ের তীরে নিয়ে আসে
ভারি জাল ।ওদের সাথে সাথে হাত লাগায় আরো দুজন মাঝি।তীরে জাল তুল্লে ভিড় জমে যায়। লেজের বাড়ি দেখেই বোঝা যাচ্ছে বড় পাকা কোন মাছ
হবে। ঠিক তাই। দশাসই কালো হলুদ ডোরা কাটা একটি বাঘাইড় মাছ জালের ভেতর আছাড়
পাছাড় করছে। ছুটে আসে আশেপাশের মাঝিরা।
কেউ একজন মহাজনরে খবর দেয়। মহাজনের খুশী দেখে কে! শুনেছে বটে এই হাওড়ের নরম কাদামাটির
খাঁজখোচরে অনেক কাল আগের মাছ আছে। তারা
বর্ষাকালে লেজে ভর দিয়ে নাকে শব্দ তুলে জলের উপর দিয়ে হেঁটে যায়। অমাবস্যা
পূর্ণিমায় জলে ঘূর্ণি তুলে খলবল খলবল খেলা করে। সকাল হলে অনেকেই দেখেছে হাওরের জলে গেরুয়া ফেনা ভাসছে। অনেকে আবার ভয় পায়।তারা মনের রঙ মিশিয়ে গল্প বানায়। আসলে
মাছ নয়। এগুলো হলো জ্বিন পরির কারসাজি। সেই
গল্প বাতাসে ভাসে।গাঁও গেরামের আকাশ বাতাস গাছপালা খালবিল পুকুর বাগান ফসলের খেত
বিরান মাঠে ভাসতে ভাসতে সেই গল্পের হাত পা মুখ লেজ গজায়। ঢুকে পড়ে গ্রাম্য
সংস্কৃতির সরল জীবনযাত্রায়। এই সব বিল হাওড় বাওড় দীঘি পুকুরে তাই একেকটি গল্পের
রাজ্যপাট লুকিয়ে আছে।
দর কষাকষি করে নব্বুই
হাজারে রাক্ষুসি বাঘাইড় মাছটি কিনে নেয় মহাজন।খুব খুশী সে। অনেকেই ছবি তুলছে।
ভিডিও করছে। বাজারে এই মাছের দাম উঠবে দ্বিগুণেরও বেশি। আস্ত বিক্রি করলেও লাভ
ভাগা বিক্রিতেও তার কোন লস্ নাই। থ্রি
স্টার হোটেলের মালিকরা দরদামে যায় না বেশি। তারা দুস্প্রাপ্য মাছের দাম দেয়
অকাতরে। সালাম লক্ষ্মণও খুশি।কিছু টাকা খাই খর্চা করে সমান ভাগ নিয়ে দুজনে রওনা হয়
বাড়ির দিকে। একই গ্রামে পাশাপাশি পাড়ায় দুজনের ঘর। সালামের ঘর আগে পড়ে। বাঁশের গেট
খুলে লক্ষ্মণ হাঁকে, ভাবিজান চা করেন আমরা আসি গিছি। আরিব্বাস এ কারা!
সালামের বাড়ি থই থই
করছে লোকে। লক্ষ্মণের বউ ছেলেমেয়ে গাঁয়ের আরো অনেক মানুষ । লক্ষণের ছেলে খুশী ,
বাবা আমরা টিভিতে দিখিছি। আমি ভিডিও করি রাখিছি। দেখ বাবা। অনেকেই হুমড়ি খেয়ে ছবি
দেখে। কত বড় মাছ। কেমন তড়পাচ্ছে দেখিছিস। সালামের মেয়ে কলেজে পড়ে। সেও ছুটে আসে,
আব্বা একজন সাংবাদিক তোমার সাথে কথা বলবে বলে বসে আছে সকাল থে । আসো আব্বা।
মিনহাজভাইকে দেখেই চিনেছিল সালাম।
কেমন আছ কমরেড?কাল টিভিতে
দেখে তোমাকে ঠিক চিনে ফেলেছি। মোটা মোটা
ঠোঁটে ঝোলটানা হাসি ঝুলিয়ে পুরানো খাতির দেখায় মিনহাজ , তোমার মেয়েটি বড় চমতকার
হয়েছে দোস্ত। সালাম স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। মনে মনে বলে তুমি কাল চিনলা আমারে কমরেড!
আমি তো তোমাগো চিনছি সেই তিরিশ বছর আগে। বিপ্লবের ফুট্টানি মাইরা আমার জীবনের পাঁচটা বছর গাপ কইরা
দিছিলা মনে নাই? জাউলার পোলারে এহন কমরেড কতিছ! আমি কি কমরেড আছিলাম নাকি তোমাগো
ভোগের বস্তু ছিলাম। ঘেন্নায় কিরকির করে উঠে সালামের শরীর। আরএফএলের চেয়ারটায়
জাঁকিয়ে বসা মিনহাজ মোল্লার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সালাম। কতবার যে তার কিশোর
শরীরটাকে ভোগ করেছে এই মিনহাজ, যন্ত্রণায় কেঁদেছে, পা ধরেছে কিছুতেই থামেনি।
হারামজাদা শূয়োরেরবাচ্চা এখন এসেছে কমরেড মারাতে।এসেই বন্ধুর মেয়ের দিকে ছুঁচোর মত
চেয়ে দেখছে! হাতলভাঙ্গা অন্য চেয়ারটি সশব্দে ছেঁচড়ে টেনে মিনহাজের সামনা সামনি বসে
সালাম। কঠিন গলায় কেটে কেটে উচ্চারণ করে,
বিপ্লব আমিও শিখে গেছি কমরেড। পরের ট্রেন একঘন্টা বাদে। চলে যান নইলে লাশ হয়ে যাবেন
কিন্তু।
মেয়ে রুবিনা মিনহাজের জন্যে তৃতীয়বারের মত চা বিস্কুট
নিয়ে এদিকে আসছিল চোখের ইশারায় না করে দেয় সালাম।