বেইমান
ডুমুর গাছের পাতায় তৈরি আপন বাসায়
টুনটুনি পাখির আসাযাওয়া দেখতে দেখতে ছোট্ট রিমির মন ভরে যাচ্ছিল। সেই ছোট্ট
টুনটুনিটি যেন তার মায়ের মতো । মাঝে মাঝে কোথায় উড়ে যাচ্ছে, আবার কিছুক্ষণ
পর মুখে করে খাবারএনে তার ছোট্ট বাচ্চা দুটিকে খাওয়াচ্ছে। তার মা যেমন সংসারের
কাজে হারিয়ে গিয়েও হঠাত্ এসে তাকে খাওয়ায়।কখনো বা সেই পাখিরা খেলায় মত্ত। রিমিদের
ভাড়া ঘরের বাইরে দেয়ালের পাশে ঝোপঝাড়টাই তাদের আনন্দের হাট।বিরাট শহরের ঘিঞ্জিতে
এটাই যেন তাদের সবুজ পৃথিবী। রিমিও পড়া ভুলে সেই হাটে আনন্দ কুড়িয়ে নিচ্ছিল।
পড়তে বসতে রিমির ভালো লাগে না। এর
জন্য মা-বাবা বকাঝকাও করে। শহরের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টির পাঠ্যসূচীসাতবছরের রিমির
মাথায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। এই টুনটুনির সঙ্গে স্বচক্ষে ও মানসচক্ষে পরিচয়ের পর
থেকে এখনসে বিছানায় বই নিয়ে বসতে আগ্রহী হয়। আসলে পড়ার নেপথ্যে জানালা দিয়ে
পাখিগুলিকে দেখার কৌতুহল।
বইয়ের পাতা খুলে তখন সে বাইরে
তাকিয়েছিল। টুনটুনি পাখিটিকে দেখে ঠাকুমার কাছে শোনা ছড়াটা মনে পড়ছিল'টুনটুনিতে
টুনটুনাল...' । পাখিটার মতো সেও যদি ঐরকম একটি বাসা পেত,
যদি সে উড়ে বেড়াতে পারত। তার তোডানা নেই, তবে? সে ছড়াটি শোনাতে চাইল সেই পাখিগুলিকে।
কিন্তু মনে পড়ছে না সবটা। রিমি মনে মনে ভাবে ঠাকুমাযদি থাকত, তাহলে ধরিয়ে দিত। ঠাকুমাও তো সেই কবে আকাশে নক্ষত্র ধরে আনতে গেছে।
এখনো ফেরেনি। ঠাকুমাটা বড্ড দুষ্টু। মিছে কথা বলে।
এতকিছু ভাবনার মাঝে বুকের মধ্যে
একটা চাপা ভয়ও কাজ করছিল। গতকাল বাবার মুখে শুনেছিল বাড়ির পাশে এইঝোপঝাড়গুলিকে
পরিষ্কার করার কথা। ওদের পাশের বাড়ির দীপককাকু কথাটি বলছিল। এই কথা শোনার পর
থেকেরিমি কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। তার বাবা তাকে আশ্বস্ত করেছিল। মাথায় হাত
বুলিয়ে দিয়ে বলেছিল,
'বেশ কাটব না!'
বাবার কথায় আশ্বস্ত হলেও একটা ভয়
চোরাপথে মনকে ভরিয়ে তুলছিল। দীপককাকু যদি কেটে ফেলে! তাহলে?পাখিগুলি যাবে
কোথায়? বিদ্যালয়ে প্রতুল স্যারের কথাগুলি মনে পড়ছিল।
পৃথিবীতে সকলের বাঁচবার সমান অধিকারআছে। বিশেষ করে গাছ-পালা, পশুপাখির। কারণ পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির ইতিহাসে এরাই আদি, তারপর মানুষ। অথচমানুষ নিজেদের মতো পৃথিবীকে সাজাচ্ছে। রিমির মনে
হচ্ছিল মানুষগুলি বড্ড দুষ্টু! তার বাবাও। কেন ঐরকম ঝোপকাটার কথা বলেছিল!
দুপুরে ঘুমাতে যাওয়ার আগেও রিমি
টুনটুনিকে হাত নেড়ে শুয়েছিল। কথা দিয়েছিল বিকালে আবার তারা মিলিত হবে।বাবা
জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে তাকে নিয়ে শুয়েছিল। রবিবার। বাবা ঘরে থাকলে রিমির এটাই
খারাপ লাগে। ঘরেরজানালা খুলে ঘুমাতে পারে না, টুনটুনিদের দেখতে দেখতে ঘুমকে ছোঁয়া হয় না!
বিকালে ঘুম থেকে উঠে রিমি বাবাকে
দেখতে পায় না। কোথায় গেল?
মা তো শুয়ে আছে... বাবার প্রতি রাগ হলেওবাবাকে সে ভীষণ ভালোবাসে।
তাই সে 'বাবা!
বাবা!' বলে ডাকতে শুরু করে দিল। বাবা তাকে কত ভালোবাসে,
যা চায়তাই এনে দেয় মা 'না' বললেও। বাবা ঘরে থাকলে বাবাকে ছাড়া একমূহূর্ত ভালো লাগে না তার।
বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে তার মনে পড়ে
যায় টুনটুনির কথা। হাত বাড়িয়ে জানালার পাল্লাটা খোলে। জানালা বন্ধ থাকাঅন্ধকার ঘরে
আলোর প্রবেশ চোখে সয় না। চোখ রগড়াতে রগড়াতে বাইরে তাকিয়ে দেখে সব ঝোপঝাড় কাটা
হয়েগেছে। বাবা আর দীপককাকু সেই কাটা ঝোপঝাড়গুলি দূরে ফেলে দিয়ে আসছে। রিমি চিত্কার
করে কেঁদে ওঠে, 'বাবা!বাবা! এ কী করলে? তুমি যে কথা দিয়েছিলে?'
রিমির মন খারাপ হয় যায়, অভিমানে চোখে
জল আসে। তার বাবা তার কথা শুনল না। কাল কেন তবে বলেছিল? তারবাবাই
তো পাখি পুষতে ভালোবাসত। অথচ... তবে কি বাবা খাঁচায় পাখিদের বন্দী করতেই ভালোবাসে?
পাখিদেরউড়তে দিতে নয়? এই খাঁচাই কি
পাখিদের প্রতি ভালোবাসার উপহার? টুনটুনিদের সুখকে নষ্ট করার
জন্য বাবার প্রতিতার গভীর ভালোবাসা ফিকে হয়ে গেল। বাবাও আর সব দুষ্টু মানুষের মতো।
বেইমান! পৃথিবীকে, উদ্ভিদকে,পাখিদেরকে
নিজেদের মতো স্বাধীন থাকতে দেয় না। অভিমানে সশব্দে জানালা বন্ধ করে সে বালিশে মুখ
গুঁজে দেয়।