গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৯ জানুয়ারী, ২০১৯

কেকা সেন


স্মৃতি-রেখা


পৃথা উর্ধশ্বাসে দৌড়ে কোনমতে ট্রেনটা ধরল। ওদিকে ব্যাগের মোবাইলটা অনবরত বেজেই চলেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে ব্যাগ থেকে ফোনটাকে বের করতে না করতেইকেঁটে গেল সেটা। দেখল পাঁচটা মিস কল রঙ্গনের। রিং ব্যাক করে সে। "হ্যালো! হ্যা উঠে গেছি ট্রেনে, তুমি তাহলে তিন্নিকে স্কুল থেকে নিয়ে চলে এস।" রাখলাম। " ফোন রেখে গলায় 'ফোঁটা জল ঢেলে নেয় পৃথা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাওয়াটা বেশ ভালই লাগছে তার। আজ একটু মেঘলা আকাশ। বৃষ্টি হবে কি আজ? কে জানে! মনে মনে ভাবে পৃথা। যাক, বাবাকে শেষমেশ রাজি করানো গেল তাহলে, বাড়ির প্রোমোটিং এর জন্য। নয়তো কাকুরা তো সেই কবে থেকেই রাজি। শুধু বাবার জন্যই এতদিন কাজটা আটকে ছিল। তবে ব্যাপারে রঙ্গনকে হ্যাটস অফ! যেভাবে লেগে থেকে বোঝাল বাবাকে! " বাবা, দেখুন এই এত বড় বাড়ি কে মেইনটেন করবে বলুন পরবর্তীকালে? কাকুরাও সেই কবেই চলে গেছে বিদেশে তাদের ছেলের কাছে! তাদেরও আর দায় নেই বলুন। " এইভাবে কম বুঝিয়েছে বাবাকে! এতদিন তাও জেদ করে বসেছিল। ইদানিং শরীর ভেঙ্গে পড়ায় সায় দিয়েছে এতদিনে। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ট্রেনটা পাতিপুকুর স্টেশনে এসে পড়ে। ট্রেন থেকে নেমেই জোরে হাঁটা লাগায় পৃথা। পাঁচ মিনিটের পথের মাঝে হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টিটা এসে সম্পূর্ন ভিজিয়ে দেয় পৃথাকে।

            মায়ের ঘরে পৃথা আজ প্রায় দেড় বছর পরে ঢোকে। মা, মারা যাওয়ার পর বাবা ঘরটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেয়। তাঁর শুধু মনে হত কেউ ওই ঘরে ঢুকে মায়ের যত্নের জিনিসগুলো নষ্ট করে দেবে। কাল, পরশুর মধ্যে পৃথাদের বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে।  তাই ঘরে ঢোকার পারমিশন পায় সে। ঘরে ঢুকে অবাক হয় সে। সবকিছু সুন্দর করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নভাবে রাখা। তার মানে বাবা নিয়মিত এই ঘরে ঢুকত! দেওয়াল আলমারি টা খুলে দেখতে থাকে পৃথা। তারমধ্যে তার ছোটবেলার সবকিছু যত্ন করে রাখা এখনও, ড্রিইং খাতা,তুলি, নাচের ঘুঙুর আরও অনেক টুকিটাকি জিনিস। এইগুলোর মধ্যে থেকে পৃথা গীতবিতানটা তুলে নেয়।অন্যমনস্কভাবে হাত বোলাতে থাকে পাতাগুলোয় -- " মায়ের খুব আদরের ছিল, এই গীতবিতান।" অস্ফুটে মুখ থেকে শব্দ 'টা বেরিয়ে আসে তার। "হ্যা, তোমার মায়ের কাছে ওইখানে রাখা সবকিছুই খুব যত্নের ছিল। তাই আমিও সেগুলোকে যত্নেই রাখার চেষ্টা করেছি। এবার কি হবে জানা নেই। তবে গীতবিতানটা ভালো করে রেখো তোমার কাছে। এটাই অনুরোধ।" পৃথার বাবা তার অজান্তেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। " একি বলছ বাবা! মায়ের স্মৃতি ঠিক করে রাখব না?" পৃথার গলায় অভিমানী সুর। " কি জানি!  শেষ সময়ে সেতো তোমায় আর কাছে পায়নি!"  পৃথার বুকে তার বাবার কথাগুলো শেলের মত বিঁধতে থাকে। চোখের ঝাপসা দৃষ্টি শুধু নির্বাক হয়ে বাবার যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে।      

                      " বাবাকে চা দিয়ে এসেছ? " রঙ্গন সপ্রশ্ন চাউনি মেলে পৃথার উপর। " না, এইবার যাব। বাবা কোথায়? বাগানে কি?"
" আরে না! সেখানে তাঁকে দেখতে পেলাম না। ওঠেননি কি তবে!" 
" কি যে বল! সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি তাকে সকাল সকাল উঠে পড়তে" -- কথাটা বলতে বলতেই পৃথার বুকের ভিতরটা ছ্যাঁক করে ওঠে। দুদিন হল সে আর রঙ্গন অফিস ছুটি নিয়ে এখানে রয়ে গেছে। সবকিছু গোছগাছ করার জন্য। পৃথা দেখেছে, তার বাবা কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। তাদের সংগে বিশেষ কথাও বলছে না। মুখে রাজি হলেও মন থেকে ঠিক মানতে পারছে না বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া। অনেক স্মৃতির ধুলো জমে আছে তাঁর বাড়ির আনাচে কানাচে। অনুভব করে সেটা পৃথা। কিন্তু তারও হাত পা বাঁধা। তাড়াতাড়ি চা নিয়ে বাবার ঘরে চলে যায় পৃথা। " বাবা, বাবা!" পৃথা অনবরত ডাকতে থাকে। ধবধবে সাদা, টানটান করে পাতা চাদরে শোয়া দীর্ঘ শরীরটা কোনরকম কোন সাড়া দেয় না। ধপ করে বসে পড়ে পৃথা সামনের চেয়ারটাতে। কিছুটা চা চলকে গিয়ে পড়ে টেবিলে রাখা গীতবিতানের পাতায়। গীতবিতানটা পৃথার থেকে কাল রাতেই চেয়ে নিয়ে আসে তার বাবা। জানালার শিক ছোঁয়া আলোর রেখারা গীতবিতানের খোলা পাতার শব্দগুলোয় আলতো আদর মাখিয়ে দিয়ে যায়। জলভরা দৃষ্টিতে পৃথা সেখানে চেয়ে থাকে ---
     "আমারে করো জীবনদান,
প্রেরণ করো অন্তরে তব আহ্বান।।
আসিছে কত যায় কত, পাই শত হারাই শত--
তোমারি পায়ে রাখো অচল মোর প্রাণ।।"