মাঠ
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মেঘলা মেঘলা করছে, তাড়াতাড়ি ছাতা ফাতা নিয়ে তৈরি হয়ে নিলাম। বাড়ি ফিরতে হলে মাঠ পেরিয়ে যেতে হবে, অনেকটা বড় মাঠ। বৃষ্টি এলেই কেলেঙ্কারি। মাঠের মধ্যে দিয়ে গেলে এমনি বজ্রপাতের স্মভাবনা থাকে, তার উপর আবার স্মার্ট ফোনের নাকি বিদ্যুৎ টানবার ক্ষমতা অনেক বেশি। এই সব উটকো চিন্তার কারণে মনটা বাড়ি ফেরার জন্য ছটফট করে উঠল। কিন্তু মন যতই বলুক, এই সময় রবীন্দ্র সদন থেকে বাস বা ট্যাক্সি পাওয়া চাপের ব্যাপার। সম্প্রতি সোনারপুরে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছি, প্রপার কলকাতার থেকে দূরে, কিন্তু ওই যে একটু মাঠ ফাট আছে, যাকে বলে বাঙ্গালির গ্রিনারি।
অবশ্য এখন তো আর মাঠ বিশেষ দেখা যায়না কলকাতা শহর, আমরা যারা নব্বই দশকে বড় হয়েছি, আমরা কত না মাঠে খেলেছি ছেলেবেলায়। আমাদের আদি বাড়ি ছিল বেহালার ইউনিক পার্কে। আশেপাশে কত মাঠ ছিল; কবর ডাঙ্গার মাঠ, নেড়ার মাঠ, পেয়ারা বাগানের মাঠ, শান্তি সঙ্ঘের মাঠ। সেই সব মাঠে আমরা কত খেলেছি, ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন। এমন কি আমাদের বাড়ির পাশে যে নেড়ার মাঠ ছিল, সেখানেই সাইকেল চালানো প্রথম শিখি। পাড়ার যত পুজো ছিল সব মাঠেই হত, দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী পুজো হত। সে সব অনেক আগে কার কথা, মধ্যিখানে কলকাতার বাইরে গিয়ে সব যোগসূত্র ছিঁড়ে যায়।
যাকগে বড্ড বেশি নস্টালজিক হয়ে যাচ্ছি, ঝড়ো হাওয়া দিচ্ছে, কলকাতায় আসার পর এই উবের, ওলা, এই এয়াপ গুলো বিশেষ ব্যবহার করা হচ্ছে না, সে যাকগে, লাকিলি একটা হলদে ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম। প্ল্যান ছিল বাড়ির দরজা পর্যন্ত নিয়ে যাব। অল্প অল্প বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, এই বৃষ্টিতে কে নামবে । টালিগঞ্জ মোড়ে যখন এল তখন বেশ ভালো বৃষ্টি হচ্ছে। বাইরেটা অবশ্য সম্পূর্ণ ঝাপ্সা হয়নি। অবশেষে যখন পারায় চলে এলাম তখন বৃষ্টি অনেকটাই ধরে এসছে , তবে একে বারেই বন্ধ হয়ে যায়নি। মাঠের কাছে গাড়ি যখন এল তখন দেখলাম কিছু ছেলে এঁর মধ্যে ফুটবল খেলছে। কি মনে হল ট্যাক্সি থামাতে বললাম, এমনিতেই সে ব্যাটা গজগজ করছিল, তাই ভাবলাম ধুর ছেড়ে দি, খেলাটা দেখে যাই। বৃষ্টিও কমে এসছে, ছাতাও সঙ্গে আছে আর মাঠ থেকে বিশেষ দূর না বাড়ি। ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে, এই দিকের গোলপোস্টের পিছনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। খেলা দেখতে বেশ লাগছে। অনেকদিন পর মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছি। আমার দিকে যারা গোল দেবে তারা বেশ ভালোই খেলছে , অবশ্য জানিনা কত স্কোর। পাঁচ মিনিট যেতে না যেতে হটাৎ বল আমার কাছে এসে পড়ল। বলটা ফেরত দিতে যাব, তার আগেই সবাই সমবেত চিৎকার করে উঠল, " দাদা, বলটা”। বলটা দিতে গিয়ে চমকে গেলাম একটা আওয়াজ শুনে, "কিরে মাকু, বাড়িতে কি খাস? পায়ে জোর নেই। চিপ করতে পারছিস না?” ভীষণ ঘাবড়ে গেলাম বাচ্চা ছেলেদের মধ্যে কার এত সাহস যে বাবার বয়সি লোক কে মাকু বলে ডাকবে, আর এই নামটা ওরা জানবেই বা কি করে, এ তো আমার ছোটবেলার নাম, এই নামেই সব বন্ধুরা ডাকত। গলাটা খুব চেনা চেনা লাগল। "কিরে খেলবি, থাম্বার মত দাঁড়িয়ে না থেকে, ওদের টিমে জয়েন কর। চলে আয়, চলে আয়, তাড়াতাড়ি, সময় নষ্ট হচ্ছে দেরি করিস না। ” আমি অবাক হয়ে দেখলাম, আমাদের ছোটবেলার পাড়ার বন্ধু দেবু দাঁড়িয়ে আছে, কোমরে হাত দিয়ে। একটুও বয়স বাড়েনি একই রকম আছে, কি করে সম্ভব, আমি কি স্বপ্ন দেখছি! " হ্যাঁ করে কি দেখছিস, চলে আয়।” দেবু ডাকতে লাগল।
সন্ধে বেলা বাড়ি ফিরতে, বউ চোখ কপালে তুলে বলল , " একি, তুমি এরকম কাদা মেখে”। আমি জুতো ছেড়ে , বাথরুমে যেতে যেতে বললাম, " ফুটবল খেলছিলাম, একটু চা বসাওনা গো”। ভিতর থেকে হাল্কা করে বউয়ের গলা শোনা গেল, " মানে”?