গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১৯

সুদীপ ঘোষাল

অনিবার্য অন্তর্জলির আগে
(শেষ অংশ)

আমার বন্ধু আমার সঙ্গেই আসা যাওয়া করতেন। তিনি থাকলে আমার একাকিত্ব দূর হতো। দুজনে গল্প করতে করতে সময় কখন যে পার হয়ে যেতো বুঝতেই পারতাম না।আর এক বন্ধুর নাম সুকুমার। সুকুমার বললেন, দেখুন ট্রেন চলাকালীন বাইরের দৃশ্য মনোরম। দুর্গাপূজা হয়ে গেছে। কাশফুলগুলো মন খারাপ করে মাথা দোলানো বন্ধ করেছে। বৃষ্টি হয়ে গেলো। একটা ভ্যাপসা গরম মন আরও বিষন্ন করে তুলেছে।
আমি বললাম,আপনি তো বেশ কবির মতো কথা বলছেন। ঠিক বলেছেন।ট্রেনের ভিতরটা একবার দেখুন। কেউ বাদাম খেতে ব্যস্ত। কমবয়সীএকটা ছেলে একদৃষ্টে কলেজ ছুটির পরে বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে আছে। তার তাকানো দেখে পাশের মেয়েটি মাথা ঘুরিয়ে দাঁড়ালো।  একটা সমগ্র দোকান বয়ে বেড়াচ্ছে বুকে হরেক মাল সাঁটানো ফেরিওয়ালা। ফ্রি তে হজমি গুলি খেতে ব্যস্ত যাত্রী পাঁচজন। কিন্তু কেনার লোকের অভাব। একজন  যাত্রী ভাবুক মনে সব কেনা কাটা দেখছেএক মনে। কেউ হিন্দীভাষী, কেউ ওড়িয়াভাষী, কেউ সাঁওতাল। সকলের সমান অধিকার। ট্রেনের একটা কামরা যেনো দেশ। আত্মীয় পরিজন নিয়ে উঠে খাওয়া দাওয়ায় ব্যস্ত। সোমড়া বাজারের মোহন ভোগ মানুষের রসনা মোহিত করে রেখেছে।
বন্ধু আর আমি কথা বলতেই ব্যস্ত। বড়ো ভালো লাগে ট্রেনের এগিয়ে যাওয়ার গতি। তারপর স্বস্থানে ফিরতে হবে সবাইকে।
আমার চোখে ট্রেনর কামরাটা গোটা পৃথিবী হয়ে উঠেছে। লন্ডন থেকে আসা লাল রঙের লোকটা নবদ্বীপে নেমে গেলো হরে রাম, হরে রাম ধ্বনি দিতে দিতে। তারপরই বিষ্ঞুপ্রিয়া হল্ট। আর সেখান থেকেই আধঝুড়ি আপেল নিয়ে এক বিক্রেতা উঠলেন।
তিনি হেঁকে চলেছেন,আপেল,কাশ্মীরী আপেল। এক কেজি সত্তর,পাঁচশো চল্লিশ টাকা। দেবো নাকি? ডিলিশাস, খেয়ে দেখুন।
এদিকে  শসাওয়ালা বলছেন, দেবো নাকি ছাল ছাড়িয়ে,নুন মাখিয়ে...
আপেল দেখলাম। খুব ভালো। দুজনেই নিলাম।  আর ফুল ফ্যামিলি নিয়ে যে ধনী লোকটি এতক্ষণ সব কিছু দরদাম করে কানের পোকা মারছেন,তিনি এবার ডাকলেন,এই  আপেল, এদিকে আয়।
-
যাই বাবু, আপেল...- কই রে, কত করে
-
দিলাম সত্তর করে। 
- না না ষাট টাকার বেশি দেবো না।
তারপর অনেক কথা ক্ষয় করে বাবুটি পাঁচশো আপেল নিলেন। তারপর আমরা দুজনেই দেখলাম পঞ্চাশ টাকা তার হাতে দিলেন।
স্টেশনে এবার নামতে হবে। তাড়াতাড়ির মাথায় আপেলওয়ালা একশো টাকা মনে করে পঁয়ষট্টি টাকা ফেরত দিলেন বাবুটিকে।বাবু অম্লান বদনে  নিয়ে নিলেন টাকা। আমরা দুজনেই প্রতিবাদ করলাম। আমি বললাম, আপনি তো পঞ্চাশ টাকা দিলেন। তাহলে কোন আক্কেলে আবার এতগুলো টাকা নিলেন।
বাবু বললেন, আমি একশো টাকা দিয়েছি।মুখ সামলে কথা বলবেন।
আপেলওয়ালা বললেন, আমার ভুল হয়েছে। দেখুন আপনি ভালো করে। আপনি পঞ্চাশ টাকা দিয়েছেন।
বাবুটি সমানে তর্ক করে চলেছেন।
আপেলওয়ালা বললেন, বেশ আপনাকে আমি ভিক্ষা দিলাম।  এই বলে তিনি নেমে গেলেন।
তারপর দেখলাম বাবু বিজয় গর্বে বলছেন, এই সুযোগ কেউ ছাড়ে মশাই। একদম ফ্রিতে আপেল।  তারপর আপেলে কামড় দিয়ে বললেন, আপনাদের দেখে নেবো।পরের স্টেশনে আমি নামবো। তারপর দেখছি।
আমার বন্ধুটি বললেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভিখারি আপনি। আপনার ক্ষমতা কই?আপনি তো নিঃস্ব রিক্ত। আপনাকে দেখে আমাদের দয়া হচ্ছে।
বাবুটি ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলেন। ওনার স্ত্রী চোখের ঈশারায় চুপ করতে বললেন স্বামীকে। পরের স্টেশনে ওনারা নেমে গেলেন।
বন্ধু বললেন, ভিখারি এরেই বলে...
আমার গল্প এখানেই শেষ। এই বলে রবি সকলকে নমস্কার জানিয়ে বসে পড়লো।
 করতালি দিতে ভুলে গেলো অনেকেই...
ট্রেন থেকে নেমে আমরা চলে গেলাম বাড়ি।
ছোটোবেলার মজার কথা বলতে, ভাবতে খুব ভালো লাগে।সারা রাত পুজো দেখতে গিয়ে বন্ধুদের দলের একজনের খুব টয়লেট যাবার প্রয়োজন হলো। বন্ধু পড়লে লজ্জা পাবে। নামটা নকল বলি। হেগো, হাগুর জন্য ছটফট করছে। সামনে কোনো ব্যবস্থা নেই। হেগো কাপড়ে চোপড়ে হবার আগে প্যান্টের বোতাম খুলে ফেলেছে। একটা ড্রেনে বসতে যাবে এমন সময়ে বাড়ির মালিক বলছেন, একি আমার বাড়ির সামনে,খোলা স্থানে,আরে ছি, ছি,...
হেগো বলছে, মেসোমশাই একটুখানি, এক সেকেন্ড...
-
আরে, আরে,বেয়ারা..
মেসো ততক্ষণে নাক চেপে ধরেছেন।
হেগো তখন মরিয়া। কাজ সাবাড়। মার ছুট। মেসো আমাদের বললেন, তোমরা চেনো।
আমরা বললাম, না না। ব্যাটাকে ধরতে পারলেন না।
- কি করে ধরবো। জল নেই। তবু, শালার ঘেন্না নেই।
বন্ধু বিপদমুক্ত হলে আমাদের আনন্দ হয়েছিলো। 
আবার সাঁতার শিখতে গিয়ে,ছোটোবেলার রায়পুকুরের রাধা চূড়ার ডালটা আজও আমায়  আহ্বান করে হাত বাড়িয়ে এই ডাল ধরেই এলোপাথারি হাত পা ছুড়তে ছুড়তে সাঁতার শিখেছি আদরের পরশে ডুবন্ত জলে যখন জল খেয়ে ফেলতাম আনাড়ি চুমুকে, দম শেষ হয়ে আসতো তখন এই ডাল তার শক্তি দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে ধরতো অক্লেশে হয়তো পূর্ব জন্মে আমার দিদি হয়ে যত্ন আদর করতো এই ডালটা কোনোদিন তাকে গাছ মনে করিনি আমি এখনও জল ছুঁয়ে আদরের ডাক শুনতে পাই পুকুরের ধারে গেলে রাধা নামের মায়াচাদর জড়ানো তার সবুজ অঙ্গে ভালো থেকো বাল্য অনুভব চিরন্তন প্রকৃতির শিক্ষা অঙ্গনে নাম লিখে যাক নব নবীন  শিক্ষার্থী প্রবাহ আমি এইসব ভাবছি। এমন সময় পিছন দিক থেকে একটা বড় পাঁঠা আমাকে গুঁতিয়ে জলে ফেলে দিলো। খুব রাগ হলো কিন্তু পাঁঠার সঙ্গে লড়াই করতে লজ্জা হলো। যদি কেউ দেখে ফেলে। তারপর গাজনের রাতে স্বাধীন আমরা। সারা রাত বোলান গান শুনতাম। সারা রাত নাচতাম বাজনার তালে তালে। সবাই মনে করতো, ব্যাটারা গাঁজার ভক্ত নাকি। গাজনে একজন হনুমান সেজেছিলো। আমরা তার লেজে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলাম। পরে দেখলাম লোকটা রাগ করে নি। বলছে,লঙ্কা পুড়িয়ে ছারখার করে দেবো।
আর হনুমান লাফিয়ে শেষে জলে ঝাঁপ দিলো।
চারদিকে প্রচুর লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে।
বন্ধু রবি বলছ,ঠিক বলেছিস। তোর কথা শুনলাম। রবি আর আমি বসে গল্প করছি। 
এবার শোন আমার দাদুর কথা। আমার হৃদয়ের কথা। তোকে শোনাতে পারলে ভালো লাগবে।
রাগ,হিংসা,ক্রোধের সংমিশ্রণে সংসার স্রোতে ভাসতে ভাসতে জীবন প্রবাহ এগিয়ে চলে। হয়তো এর ফলেই দাদুর শেষজীবনে সেবার সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা। আমি নিয়ম করে দাদুকে গীতাপাঠ করে শোনাতাম। দাদু কত গল্প বলতেন। কোনোদিন হা পিত্যেশ করতে দেখিনি। আমার সময় কাটতো দাদুর কাছেই বেশি। পড়াশোনার ফাঁকে চলতো গীতাপাঠ। আমি জিজ্ঞেস করতাম,দাদু মরণের পরে আমরা কোথায় যাই? দাদু বলতেন,জানি না ভাই। তবে।।মরণের পরে যদি যোগাযোগ করা যায়,তাহলে আমি তোকে নিশ্চয় জানাবো। দাদু বলতেন, আমি যখন শেষ বিছানায় শোবো,তখন আমি ঈশারা করবো হাত নেড়ে। তখন তুই গীতার কর্মযোগ অধ্যায় পড়ে শোনাবি। তোর মঙ্গল হবে। আমিও শান্তিতে যেতে পারবো। হয়েছিলো তাই। কর্মযোগ পাঠ করা শেষ হতেই দাদুর হাত মাটিতে ধপাস করে পরে গেলো। দাদু ওপাড়ে চলে গেলেন হেলতে দুলতে চারজনের কাঁধে চেপে। মাথাটা দুই বাঁশের ফাঁক গলে বেরিয়ে ঝুলছিলো। আমি বলে উঠলাম, ওগো দাঁড়াও দাদুর লাগবে। মাথাটা ঠিক কর  বালিশে দি। কেঁধো বললেন,মরে গেয়েচে। ছেড়ে দে। আমি বললাম, না ঠিক করো। তারপর ঠিক করলো দাদাভাই,দাদুর মাথাটা বালিশে দিয়ে।  
অনেক বছর অপেক্ষা করেছি,দাদুর কথা শুনবো ওপাড় থেকে। যোগাযোগের উপায় থাকলে নিশ্চয় করতেন। কিন্তু কোনোদিন স্বপ্ন পর্যন্ত দেখিনি। কথা শোনা তো দূর অস্ত।  ট্রেন কাটোয়া ঢুকে পরেছে। যে যার নিজের রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলো। আমি বাড়ি এসেই খাওয়া দাওয়া করে বেরিয়ে পরলাম ফাঁকা মাঠে হাওয়া খেতে। বন্ধুরা সবাই বেড়াতে আসে মাঠে। গল্প গুজব করতে করতেই সবাই বাড়ি ফিরলাম। তারপর কিছু ছেলেমেয়ে পড়তে আসে। তারা চলে গেলে সপরিবারে রাতের আহার সারি।
সকাল হলেই বন্ধু আশীষের খোঁজ নিতে গেলাম। ফিরে এসেছে ভেলোর থেকে। 
খবর ভালো নয়। 
আশীষ নামের সীমাহীন আনন্দমাখা ছেলেটা ভেলোরে গিয়ে জানতে পারলো,তার হার্ট বড়জোর আর দুবছর চলবে। এত কথা জেনেও কোনোদিন মুষড়ে পরেনি তার মন। ফুটবল খেলতে ভালোবাসতো ছেলেটা। সারা  বিকেল ছুটে ছুটে সে আনন্দ মাখতো সারা গায়ে। আলো নামের আলো মনের মেয়েটা জেনেশুনে তার সমস্তকিছু দিয়েছিলো দুদিনের আনন্দের দেবদূতকে। পৃথিবীর রঙ,রূপ, রস সে একশো বছরের পরমায়ুর মতো পেয়ে গিয়েছিলো মনের প্রসারতায়। কেউ তাকে সান্ত্বনা দিতে এলেই কথা ঘুরিয়ে তার চোখে এঁকে দিতো স্বপ্ন।
তার সঙ্গে ঘুরতে গেছিলাম মুর্শিদাবাদের রামপাড়া। গঙ্গার ধারে গ্রামটি। ছোটো হলেও আমরা বন্ধুরা প্রত্যেকটি বাড়ি বাড়ি ঘুরেছি। কারো বাড়ি স্নান করা, কারও বাড়িতে খাওয়া দাওয়া।কারওবাড়িতে গান বাজনা করেই দিন চলে যেতো। দুর্গাপুজোর বিসর্জনের দিনে নৌকা করে ঠাকুর বিসর্জন দেখলাম। গঙ্গার ধারের সব গ্রামের ঠাকুর নৌকো করে মাঝ গঙ্গায়এনে বিসর্জন করা হচ্ছে ঢাক,ঢোল বাজিয়ে। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমেএলো। সন্ধ্যা নেমে এলো আশীষের জীবনে। রাত হওয়ার আগেই পাড়ি দিলো ভবসাগরের ওপাড়ে। তার সংসারে বাবা,মা, তিন বোন। আশীষের বাবাকে আমি  জামাইবাবু বলতাম। তিনি কেলকাতা লালবাজারের কমিশনারের দপ্তরে কাজ করতেন। তার দাপ ছিলো ভীষণ। তার নামে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেতো। তিনি ছেলের শোকে মারা গেলেন। দিদি কয়েক মাসের মধ্যেই চলে গেলেন। বড্ড প্রাণপ্রিয় ছিলো তার আশীষ। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। রামপাড়ার বাড়িতে আর কেউ নেই। কতকগুলো ঘুঘু মনখারাপের ডাক ডেকে চলে নিশিদিন। ওই নিরীহ পাখি মানুষকে সত্য, সুন্দরের বাণী শোনায় আজীবন। বড্ড প্রিয় আমার এই ঘুঘু পাখি। ভিটেতে ঘুঘু চড়ে না,সে মনে রাখে এই ভিটের মালিক একদিন আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলো,আজও দিয়েছে। তাই কৃতজ্ঞ সুরে তার শোকপ্রকাশ মালিকের অবর্তমানে। আমার তাই মনে হয়। সত্য ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার নাম ধর্ম। জীবন একটা ছোটো নাটক। জলে একমুঠো দেহছাই  ছড়িয়ে গেলেই সব শেষ। রবি বলে চলেছে তার আবেগ,তার ভাবনার কথা।
কি করে একটা সাজানো বাগান তছনছ হয়ে যায়। বন্ধু রবি বললো,তবু কিছু মানুষের এত অহংকার। তারা মনে করে মৃত্যু বোধহয় তাদের ভুলে গেছে। সে ভোলে না। হঠাৎ চলে আসে। সময় থাকতে বাড়ির কাছের মানুষের সেবা করাই ভালো। পৃথিবী সুন্দর হয়ে উঠবে,পরস্পরের সেবা, ভালোবাসার মাধ্যমে। অন্তর্জলির আগে একবার মানুষকে ভালোবেসে তাদের সুখে দুখে আমাদের হৃদয়কে ভরিয়ে তুলি ভালোবাসায়। আয় আমরা মানুষ হবার শপথ নিই... 


প্রথম অংশ আগের সংখ্যায় এই লিঙ্কে 
লি https://galpogucchho.blogspot.com/2019/01/blog-post_62.html#more