ধারাবাহিক হ্যান্টেড কাহিনী - ৩৭
বাঁকুড়ার মির্জাপুর হাইস্কুলের অলৌকিক ঘটনা
মেয়েটির
নাম মিলি কুণ্ডু। সে বাঁকুড়ার মির্জাপুরের এক গ্রামে বাসকরে। মির্জাপুরের হাইস্কুলের ক্লাস
এইটের ছাত্রী সে। এই বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন জায়গায় ভৌতিক ঘটনার অনেক নজির আছে। কিন্তু
মির্জাপুর হাই স্কুলে এই ধরনের অলৌকিক ঘটনার কোন রকম আভাস এতদিন পর্যন্ত পাওয়া
যায়নি।
মিলি
ক্লাস এইটের ভালো ছাত্রী। প্রতি বছর সে ক্লাসে ফার্স্ট কিংবা
সেকেন্ড হয়ে থাকে। সে দিন সে স্কুলের অফ পিরিয়ডে বই খুলে কিছু পড়াশোনা করছিল।
হঠাৎ তার অনুভব হল, তাকে এক বার টয়লেট যেতে হবে। সে ক্লাস থেকে বেরিয়ে তিন-চারটে ক্লাস রুম পার হয়ে স্কুল বিল্ডিঙের প্রায় শেষ প্রান্তে থাকা টয়লেটে গিয়ে প্রবেশ করল। এত দিন সব কিছু স্বাভাবিক ছিল কিন্তু সে দিন, মিলির কেন যেন একটু অন্যরকম বলে
মনে হতে লাগল। টয়লেটে লাইট জ্বলে আছে, তবু ঘোলাটে অন্ধকার চারদিক ঘিরে
আছে! এমনটা তো কোন দিন হয়নি! সে এগিয়ে গেল, এমনি সময়
তার কানে এলো, খট খট শব্দ। সে তাকিয়ে
দেখল, দরজা বন্ধ আছে। তবে কি কেউ টয়লেটে আসবে বলে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে? সে ভাবল এখন টয়লেটের দরজা খোলা যাবে না। মুহূর্ত পরেই সে অনুভব করলো, একটা হওয়ার স্রোত, কিছুটা ঘূর্ণি হওয়ার মতই মনে হল, টয়লেটের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে।
হাওয়ার বেগের সামান্য শব্দ হচ্ছিল। তারপরেই ঘটে গেল ঘটনাটা। মিলি চোখের সামনে এ কি দেখছে ? সে দেখছে একটা ছায়া--সেই ছায়া
ক্রমশ একটা মানুষের আকৃতি নিচ্ছে। তারপর সেই ছায়াটা ক্রমশ তারই দিকে এগিয়ে আসছে! মিলি ভীষণ ভয়
পেয়ে গেল, সে চিৎকার দিয়ে ওঠার চেষ্টা করল কিন্তু তার গলা খুলল না, কিছুতেই সে কাউকে ডেকে উঠতে পারল না। সে তার চোখের চারদিকে অন্ধকার দেখতে লাগল।
মুহূর্ত পরে সে জ্ঞান হারিয়ে টয়লেটের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।
এ দিকে ঘণ্টা দুই হয়ে গেছে, মিলির কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে
না। তবে ধারণা করা যাচ্ছিল যে টয়লেটের ভেতরে মিলি আছে। কিন্তু এত সময় ধরে তো
থাকার কথা না। শেষ পর্যন্ত আরও ঘন্টাখানেক পরে মিলির জ্ঞান ফিরলে সে কোন মত দরজার
ছিটকিনি খুলে টয়লেট থেকে বেরিয়ে এলো। তাকে দেখে উদভ্রান্তের মত মনে হচ্ছিল। সে
যেন নিজের মধ্যে নেই। সে হেঁটে চলেছে তার ক্লাসের দিকে। তার বন্ধুরা বারবার তাকে
ডেকে নানা প্রশ্ন করছে কিন্তু মিলির মুখে কোন শব্দ নেই, সে
নিশ্চুপ। শেষে স্কুলের দারোয়ান তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে
এলো।
এমনি
আরেকটি মেয়ে ঊষা সরকার। মিলির সঙ্গে টয়লেটে ঘটে যাবার পর দিনের কথা। ঊষা টয়লেটের দিকে এগোল। ভেতর গিয়ে
সে তার দরজা বন্ধ করে দিল আর ঠিক সেই মুহূর্তে সে বুঝতে পারলো টয়লেটের ভেন্টিলেটরটা
আপনি আপনি খুলছে, বন্ধ হচ্ছে। আর সেখান
থেকে একটা হাওয়ার তোড় শব্দ করে টয়লেটের ভেতরে এসে ঢুকছে। ঊষা হঠাৎই কিছু অন্ধকার
জমা হয়ে যেতে দেখল, আর তারপরই একটা ছায়া তার সামনে তৈরী হতে লাগল। ছায়া ক্রমশ মানুষের আকৃতি নিতে
লাগল। ঊষা প্রথমটা বুঝতেই পারলো না যে তার সামনে এ কি হচ্ছে ! সে কি বাস্তবেই সবকিছু দেখছে, নাকি এটা
কোন দুঃস্বপ্ন ? ছায়ামূর্তি ক্রমশ তার দিকেই এগিয়ে আসছে। সে আর থাকতে পারলো না, ভয়ে চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করল, তারপর মিলির মতই সেও জ্ঞান হারাল।
এ দিকে
স্কুলের টয়লেট তিন ঘণ্টা ধরে বন্ধ। টয়লেটের দরজায় অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে। ওরা কেউ
কেউ জানতে পেরেছে ঊষা তিন ঘণ্টা ধরে এই
টয়লেটের ভেতরে আছে। কালকের মিলির সেই ঘটনা তারা সবাই জানে। ছাত্রছাত্রীরা এবার
শিক্ষকদের খবর দিল। শিক্ষকরা এসে টয়লেটের দরজা অনেক ধাক্কালেন। ভেতর থেকে কোন
প্রকার সাড়া শব্দ এলো না। কোন ভাবেই যখন কিছুই হল না শেষে সে দরজা ভাঙতেই হল। টয়লেটে ঢুকে দেখা গেলো, মেঝেতে ঊষা লুটিয়ে পড়ে আছে। সে জ্ঞান হারিয়েছে। ডাক্তার ডেকে আনা হল। তিনি পরীক্ষা করে রায় দিলেন, মেয়েটি
শারীরিক-মানসিক দুর্বল আর সে কারণেই এমনি ঘটনা ঘটেছে, তার বিশ্রামের প্রয়োজন।
এমনি ঘটনা
তখন স্কুলে বারবার ঘটতে লাগলো। ছেলেমেয়েরা জ্ঞান হারাচ্ছে, টয়লেটে গেলেই কেউ কেউ আবার তাদের মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা অনুভব করছে। ভালোভাবে
তারা কথা পর্যন্ত বলতে পারছে না। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মশাইয়ের কাছে এটা একটা বিরাট সমস্যা হয়ে
দাঁড়ালো। টয়লেটে কিছু একটা ঘটছে যার কারণে এমনি সব অলৌকিক ব্যাপারগুলো লক্ষ্য
করা যাচ্ছে। কি হতে পারে সেটা ? কোন একজন বা দু’জন ছাত্র ছাত্রী যদি মানসিক ও শারীরিক ভাবে দুর্বল হত তাহলে
কিছুই বলার ছিল না কিন্তু গত দশ পনেরো দিন ধরে প্রতিদিন এমনি সব ঘটনা ঘটে চলছে।
এ ধরণের ঘটনার কারণে কিছু কিছু ছাত্র-ছাত্রীদের হসপিটালেও ভর্তি করতে হয়েছে। তাদের বেশির ভাগেরই সিমটম
মাথাব্যথা ও মানসিক বিকার। স্কুলের টয়লেটে কি দেখেছে ওরা ? কি অনুভব করেছে ? কেন ভয় পাচ্ছে? ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তরে ছাত্রছাত্রীরা জানিয়েছে--টয়লেটে লাইট জ্বালা থাকা সত্ত্বেও একটা জমাট অন্ধকার
সেখানে তৈরি হচ্ছে, টয়লেটের ভেন্টিলেটর খুলছে, বন্ধ হচ্ছে। স্পষ্ট অনুভব করা যাচ্ছে যে সেখানে কিছু হাওয়া ঢুকে গিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে।
টয়লেটের মধ্যে বয়ে যাওয়া হাওয়ার বেগের শব্দ শোনা যাচ্ছে। অনেকে বলছে, সেই ঘন অন্ধকার দিয়ে ধীরে ধীরে একটা ছায়া তৈরি হচ্ছে। সেই ছায়া ক্রমশ
মানুষের আকৃতি নিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। যে মনুষ্য আকৃতি ওদের দিকে এগিয়ে আসে
তাকে দেখলে একটা অল্প বয়সের ছেলের মত মনে হয়। সে ছায়া ওদের সবাইকে ভয় দেখায়।
যারা একটু অপেক্ষাকৃত সাহসী ছাত্র-ছাত্রী তারা বলে, ছায়াটা যেন কিছু একটা বলতে চায়। ব্যাস, এই
পর্যন্ত। এ সব ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে কিছু তো একটা অলৌকিক অস্তিত্ব স্কুলের
টয়লেটে প্রবেশ করে আছে।
এ সব
ঘটনার কথা স্কুলের হেড মাস্টামশাই সরকারি কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট করেন। এ দিকে
স্কুল প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়। ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি অনেক কমে এসেছে। এমনি এক সমস্যা মোকাবিলা কি ভাবে করা সম্ভব ? সেটাই ছিল স্কুল কর্তৃপক্ষের
সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা।
শেষে
সরকারি কর্তৃপক্ষ এক মানসিক ডাক্তারকে এ ব্যাপারে অনুসন্ধানের জন্য পাঠালেন।
ডাক্তার, সত্যরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় দু’জন ছাত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে
তাঁর সীমিত জ্ঞানের আওতা থেকে যতটুকু
বুঝতে পারলেন তার ভিত্তিতে জানালেন, অসুস্থ ছাত্রীর শারীরিক ও মানসিক
অবস্থা ঠিক ছিল না। আমি দু’জনকে পরীক্ষা করে যেটুকু বুঝেছি
ওদের জ্ঞান হারান বা প্রচণ্ড মাথা ব্যথার কারণ হল ওদের
মানসিক ও শারীরিক দুর্বলতা। তবে আমি জানলাম,
বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীর এ ধরনের ঘটনা ঘটে গেছে। আমার মনে হয় যে তাদের সবাইকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার
প্রয়োজন রয়েছে। এ জন্য চাই মাস কাউন্সেলিং, তারপরেই এখানকার অলৌকিক ঘটনার মূলসূত্র ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকবে বলে আমি মনে
করি।
বাঁকুড়া
জেলার এই স্কুলে তারপর অনেক ওঝা, বৈদ্য
তান্ত্রিকদের ডাকা হয়েছিল। তাদের তন্ত্রমন্ত্র, ঝাড়ফুঁক
সমস্ত কিছুর পরেও এ ধরনের অলৌকিক ভুতুড়ে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বিশেষ একটা পরিবর্তন ঘটেনি। তবে বর্তমানে স্কুলের সে
টয়লেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্কুলের জন্যে অন্যত্র টয়লেট তৈরি করিয়ে দেওয়া
হয়েছে। এখন সেই ভৌতিক টয়লেটের ধারে কাছে কোন ছাত্র-ছাত্রী বা শিক্ষক-শিক্ষিকারা
জান না। এমনি ভাবেই আগের মতই এখানকার স্কুল চলছে। তবে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মন থেকে
সে সব পুরনো ভয়ের ঘটনার কথা মুছে যায়নি, কারণ সে টয়লেট আজও যে স্কুলের
সঙ্গেই যুক্ত আছে।