ব্যাথা
প্রথম যখন ওরা পাড়ায় এসেছিল, ওরা বলেছিল 'ব্যাথা' এখানে থাকবে না, প্রকাণ্ড কিছু একটা
হবে আর ব্যাথাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। পাড়ার সবাই অবাক দেখেছিল সেই প্রকাণ্ড
ব্যাপার। সেদিন কার সেই হই রই ব্যাপারের পর ব্যাথাকে আর দেখা যায়নি। সবাই ভেবেছিল
ওদের কথাই হয়তো সত্যি, যে ব্যাথার সলিল সমাধি ঘটেছে, ব্যাথাকে আর পাওয়া যাবে না।
তারপর একদিন ওরাও চলে গেল। তারপর অনেকদিন হল, সবই ঠিক চলছিল, হঠাৎ একদিন লিপি
বউদির চিল চিৎকারে সবার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তার পাঁচ বছরের তুবুন রাতের বেলা বাড়ি
ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েছিল । পরে অবশ্য পুকুর পাড়ে তুবুন কে কাদায় আটকে থাকতে দেখা
গিয়েছিল । ওর কান্নার আওয়াজ শুনে সবাই পুকুর পাড়ে ছুটে গেছিল । ঠিক সেই দিনই আবার
ব্যাথাকে দেখা গেছিল। যারা প্রথমে এসিছিল তারা বলে পুকুর পাড়ে তুবুনের পাশে লাল
ফ্রক পড়ে বসেছিল ব্যাথা আর তুবুন কে বলছিল, "কাঁদিস না, লবেঞ্জুস খাবি?" ভয়ে সেদিকে কেউই
এগোয়নি। আবার কেউ বলে লিপি
যখন কাঁদছিল তখন গোমড়া মুখে জানলার বাইরে দাড়িয়ে ছিল ব্যাথা । অবশ্য কেউ সাহস করে
ওকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। এর ফলে পাড়ায় আবার নতুন করে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল, যে আবার ব্যাথাকে
দেখা যাচ্ছে। তবে ওরা যে এত বড় মুখ করে বলেছিল, যে ব্যাথা আর এখানে থাকবেনা।
কিন্তু ওদেরকে তখন কেই বা পাবে। তারপর সবাই
খুব সতর্ক হয়ে গিয়েছিল, কোথায় আবার ব্যাথার উপদ্রব শুরু হয়।
এই ঘটনার কিছুদিন পর থেকে অকৃতদার রমেন বাবুর সাথে ব্যাথার মাঝে মাঝেই দেখা
হচ্ছিল । রোজ বিকেলে নিয়ম করে রমেন বাবু হাটতে বের হতেন, দু তিন চক্কর হাঁটা হলে উনি
ফুটবল মাঠের পাশের বেঞ্চটাতে এসে বসতেন। ফুটবল মাঠের ধারে উনি প্রথমে ব্যাথাকে বসে
থাকতে দেখেছিলেন । প্রথম দুদিন না দেখার ভান করেই ছিলেন। পরের দিন দেখেন যে ব্যাথা
উনার দিকেই তাকিয়ে আছে। রমেনবাবুর ব্যাথার দিকে তাকাতে উনার সুরঞ্জনা কথা মনে পড়ে
গিয়েছিল। উনি আলু কাবলি কিনে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন আর বলেছিলেন, 'নাও'। ব্যাথাও হেসে বলেছিল,' এতদিন কোথায় ছিলে'? রমেন বাবু পালটা
হেসে জানতে চেয়েছিলেন, ‘তোমার কি আমার জন্য
সময় আছে’ ?
‘সময়তো, তুমিই দাওনা, বাইপাস করিয়ে আসার
পর, কেমন অক্লেশে হেসে সবাইকে বল,যমের দক্ষিণ দুয়ার থেকে ঘুরে
এলাম। তাও ভালো সুরঞ্জনা ছিল, তাই তোমার দেখা পাওয়া যাচ্ছে’।
এই সব ঘটনা হয়ে যাওয়ার পরে,পাড়ার সুধাংশু বাবুর হারিয়ে
যাওয়া ছেলে আনন্দ ফিরে আসে। এই প্রসঙ্গে
আনন্দর কথা একটু বলে রাখি। আনন্দর যখন ২২ বছর বয়স,একদিন এরকম বিবাগী হয়ে যায়। সবার উৎকণ্ঠার বিষয়
ছিলে "কোথায় গেল ছেলেটা বাবা মা কে ফেলে? ‘সে প্রায় দুই বছর আগেকার ঘটনা।
তার পর কত নদী,কত জল বয়ে গেছে,কেউ তার খবর পায়নি।
কোথায় আছে সে? থানা পুলিশ সব করা হয়েছিল,তবু কোনও খবর আসেনি । তাই যখন
দু বছর পরে আজ সে যখন ফিরে এলো,তখন সবাই যারপরনাই
অবাক হয়ে যায়। বিস্ময়ের ঘোর কাটার পর সবাই আনন্দকে নিয়ে হই হুল্লোড় করে। কেউ জানতে
চায়নি সে কোথায় ছিল ? কেমন ছিল? সে সমস্ত প্রশ্ন
তুলে রাখা হয়েছিল পরে কোন এক সময়ের জন্য। আনন্দ আসার পর একদিন সে ব্যাথাকে দেখতে
পায়। এবং যথারীতি তার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায়। একদিন পাড়ার সকলকে নিয়ে সে মিটিং করে। বলে ব্যাথাকে চিরকালের মত বিদায় দেবার পালা
এসছে। তার কাছে মুক্তি নামে এমন একটা বস্তু আছে যার দ্বারা সে ব্যাথাকে চিরকালের
মত তাড়তে পারবে। সবাই অবাক হয়ে জানতে চায় সেটি কি? আনন্দ হেসে বলে, ‘আছে,আছে সে ভারি মজার জিনিস। মনে করে দেখ ব্যাথা কখন
এসেছিল,তোমরা এই পাড়ায়
এসেছিলে বলেই ব্যাথা এসেছিল। তোমরা যে এই পাড়ায় এসছ, এটা একটা বিরাট ভুল, এখানে না এলে পারতে,তাহলে ব্যাথাও আসত
না । ব্যাথা তোমাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছে ক্রমশ । তোমরা যে ভাবে ভাবছ ব্যাথাও সে ভাবে ভাবছে।
এবং সঠিক জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে । ফলে তোমরা ব্যাথাকে আর কোনও ভাবে সরাতে পারছ না।
আমার কাছে মুক্তি বলে এক আশ্চর্য জিনিস আছে,যা তোমরা ব্যবহার করলে দেখবে
ব্যাথা তোমাদের থেকে চিরকালের মত সরে গেছে’।
এরপর সবাই আনন্দের পরামর্শ মত মুক্তির ছোট ছোট অংশ নিয়ে যে
যার মত রাত্রে শুয়ে পড়ে; রমেন বাবু, লিপি বউদি,এমনকি আনন্দের মা,বাবাও। পরেরদিন
পুরো পাড়া ফাঁকা হয়ে যায় ভোর হওয়ার সাথে সাথে। কোনও সারা শব্দ ছিল না।
শুধু আনন্দ বেড়িয়ে এসে হাত পা ছড়ায়, সে জানত ব্যাথা আর আসবে না,কেউ আর আসবেনা। পুরো পাড়াটা এখন থেকে ওর। ব্যাথার উপর পুরানো প্রতিশোধ নিতে পেরে আনন্দের আরও নিশ্চিন্ত লাগছিল।