সাক্ষী
চুঁচুঁড়া স্টেশন থেকে পশ্চিম দিকে একটু এগোলেই ফার্ম
সাইড রোড। ধাণ্য গবেষণাগার। ভিতরটা খুবই নিরিবিলি । আপ ব্যান্ডেল লোকালে চুঁচুড়ায়
নেমে সেদিকেই হাঁটতে থাকেন অভিকবাবু। প্রতি শনিবার কলকাতা থেকে চলে আসেন এখানে ।
বিগত দশ বছরের অভ্যাস । তবে ইদানিং বয়স হচ্ছে আর ক্ষমতা কমছে। তবে মনের তাগিদটা এখনো আগের মতই ।
ফার্মের ঈশান কোনে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে গিয়ে বসেন অভিক বাবু।
একটু জল বের করে খান বোতল থেকে। ব্যাগে বোতল রাখতে রাখতেই দেখেন রামুয়া সাইকেল
নিয়ে এদিকেই আসছে। একমুখ হাসি নিয়ে চা আনার জন্য পয়সা চায়। অভিকবাবু একটা পঞ্চাশের
নোট দেন ওকে,সঙ্গে
বিস্কুট আর ছোলা ভাজাও আনতে বলেন।
গাছটা লাল হয়ে আছে ফুলে ফুলে । ভীষন ভালোবেসে ফেলেছেন
এই গাছটাকে । অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এর সাথে । আজও মনে মনে বিশ্বাস করেন , অতীত নাবালক হয়। তাইতো , সেই সময় অভিকবাবু কলেজে পড়তেন । রোজই সাইকেল নিয়ে বাড়ির গলিতে ঢুকতে
গেলেই মেয়েটা লাল সাদা ইউনিফর্ম পরে সাইকেল নিয়ে ওভারটেক করতো । তারপর পিছন ঘুরে
মুচকি হেসে এগিয়ে যেত, যেন বিশ্বজয় করে ফেলেছে । অথচ
তখনকার অভিক বুঝতেই পারতো না কেন রোজ এমন করে মেয়েটা ।
সেবার অভিকের পাড়ার সবাই ঠিক করে পল্লী তে একটা দুর্গা
পূজা করতে হবে । যাতে সংহতি আরও বাড়ে। অভিক জেনে থেকেই কেমন করে যে স্বপ্ন দেখতে লাগলো
, তা আজও বুঝে
উঠতে পারেনি । মন্ডপে মেয়েটা আসবে । বেশ করে কিছু কথা
শুনিয়ে দেবে । মেয়েটার জন্যে একদিন টাল রাখতে না পেরে কাঁচা নর্দমায় পর্যন্ত পড়েছে
। কি বিচ্ছু মেয়ে । কোন ক্লাস কে জানে। তবে মেয়েটির হাসিটা ইদানিং ভালোই লাগে
অভিকের । আচ্ছা ও কি আমায় ভালোবাসে । এইসব মাথায় ঘুরতে থাকে অভিকের আর ধীরে ধীরে
আবেশ ঘিরে ধরে ওকে।
পুজোর ষষ্ঠী , সপ্তমী মায়ের সাথে বাড়ির লোকের সাথেই সময় কাটায়
মেয়েটি । মন্ডপে এসে অবধি একবারও ফিরে চায়না অভিকের দিকে । যেন চিনতেই পারছে না।
তবুও অষ্টমীর দিন ধুতি পরে মন্ডপে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে ওঠে অভিক। আজ পুরো ফুলবাবু
। মন্ডপে গিয়ে সকাল থেকেই অপেক্ষায় কখন অঞ্জলী হবে । দুঘন্টা অপেক্ষা করে যখন রাগ
হতে শুরু করলো , তখন দেখে আকাশী শাড়ি পড়ে মেয়েটি আসছে ।
অভিকের রাগ গলে জল । হটাৎ মেঘপরী মনে হয় মেয়েটাকে । অঞ্জলী শুরু হতে অভিক গিয়ে
দাঁড়ায় সকলের সাথে । মনেপ্রাণে ভগবান কে ডাকতে থাকে । আজ কথা বলবেই । হটাৎ ফিসফিস
করে কে যেন কানের কাছে বলে -- এই ভবা পাগলা , দাড়ি কেটেছ কেন ? আজ মায়ের সামনে ফাইনাল বলে
দিচ্ছি , ওই দাঁড়িতেই আমি ঝুলেছি । ফের যদি কাটবে তো আমি
ভো কাট্টা হয়ে যাবো ।
এরপর পরমা আর অভিক বহুবার সাইকেল রেস করেছে বাড়ি ফেরার
সময় । পরের বছর পরমা তখন একই কলেজে । সে বছর রথের আগের দিন , কলেজ ক্যান্টিনে বললো আজ একটা কাজ
আছে । ফেরার সময় ফার্মের এক নম্বর গেটে যেন অভিক অপেক্ষা করে। সেদিন কলেজ থেকে
ফিরে ফার্মের ঈশান কোণে একটা কৃষ্ণচূড়া চারা লাগিয়েছিল দুজনে । সঙ্গে কিছু
ভালোবাসার অঙ্গীকার করেছিল। দুজনে দুজনকে ভালোবাসার , এই 'গাছতলার ভালোবাসা' কে বাঁচিয়ে রাখার । ওদের
ভালোবাসার সাক্ষী থাকবে এই কৃষ্ণচূড়া , ডালপালা মেলে
বাড়বে ওদের ভালোবাসার মতো। আর ফুল ঝরিয়ে রঙিন রাখবে ওদের জীবন।
-- দাদাবাবু চা এনেছি ।
চা খেতে খেতে অভিকবাবু ভাবতে থাকেন , পনেরো বছর হয়ে গেছে প্রায় পরমা নেই
। পরমা মারা যাওয়ার পর একাই ছেলেকে মানুষ করেছেন , বড় করেছেন
। পরমার ইচ্ছে অনুযায়ী ছেলে ডাক্তারও হয়েছে । আজ সে কলকাতায় থাকে , অভিক বাবুকেও সেখানে যেতে হয়েছে । এখানকার বাড়িটা রামুয়া আর ওর পরিবার দেখাশুনা করে। এত কিছু ঘটে যাওয়ার
পরও কখনো মনে হয়নি একা । কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে মৃদু হাওয়ায় ফুল ঝরছে । যেন পরমা
কৃষ্ণচূড়া হয়ে খুনসুটি করছে। চোখবন্ধ করে সে আবেশ উপভোগ করতে থাকেন অভিকবাবু।