গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৯ জানুয়ারী, ২০১৯

আফরোজা অদিতি


একটি দিন ও ছিনতাইয়ের গল্প



   দুপুরের খরতাপ। ঝাঁঝাঁ রোদ্দুর চারদিক। রাস্তার চলমান গাড়িগুলো থেকে গরম ভাপ এসে লাগছে চোখে-মুখে। মাথা থেকে ঘাম তিরতির করে নামছে পিঠ বেয়ে। অস্বস্তি লাগছে ইমলির। তাছাড়াও রিকশাওয়ালার শরীর থেকে ঘামে ভেজা গন্ধ এসে লাগেছে নাকে। বিশ্রি অবস্থা।

   ধীর গতি রিকশার। এই গরমেও রিকশাওয়ালার অবস্থাও তথৈবচ। বারবার কপালের ঘাম মুছছে সে। রিকশাতে উঠতেই ভয় পায় ইমলি। আজ সঙ্গে আছে ওর মেয়ে অনুশ্রী। খুব আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসে আসে মেয়েকে এক হাতে ধরে। ইমলি সব সময় সিএনজিতে যাওয়া-আসা করে আজ সিএনজি না পাওয়াতেঅগত্যা মধুসুধনএই রিকশা।  ইমলির রাস্তার দিকে মন নেই, শুধু মনে হচ্ছে একটু রিলাক্স হলেই পড়ে যাবে রিকশা থেকে। ওর আড়ষ্টভঙ্গি দেখে অনুশ্রী বলে, ‘মা, তুমি কি ভয় পাচ্ছ? ভয় পেয়ো না ভালো হয়ে বসো।মেয়ের কথাতে একটু লজ্জা পায় ইমলি। একটু সোজা হয়ে বসে তরপর বলে, ‘নারে, ভয় পাবো কেন; এই তো, তুমি ধরে বসো না হলে পড়ে যাবে।ইমলি মেয়েকে কথাগুলো বললেও মন থেকে ভয় যায় না।

   ওরা খিলগাঁও উড়াল সেতুর কাছে এসে আটকে যায় যানজটে। রিকশা এই যানজটে দাঁড়াতে একটু স্বস্তি পায় ইমলি। উড়াল সেতুর বীমেনানা রকম পোস্টার সাঁটা। সিনেমা, সিডি,অডিও,ভিডিও, চাকরি, পেইংগেস্ট থাকতে চাই। আরও আছে মেস মেম্বার আবশ্যক। বাড়ি গিয়ে পড়াই.. এরকম নানান পোস্টার কখনও ঠিকঠাক কখনও বা ভুল বানানে যার যার প্রয়োজন মাফিক লাগিয়ে বা ঝুলিয়ে দিয়ে যায় । ইমলি রাস্তার এই সব পোস্টার, চলন্ত বাসের গায়ে লেখা নাম বা ছবি, রিকশার গায়ে আঁকা ছবি দেখতে দেখতে যায়; এগুলো দেখতে সবসময় ভালো লাগে ইমলির। কিন্তু এখন ভালো লাগছে না। অভ্যেসবশত তাকিয়ে আছে কিন্তু মনোযোগ নেই। রিকশা থেকে কখন নামতে পারবে এই চিন্তাতেই অধীর হয়ে আছে; শুধু ভয় রিকশা থেকে ও বা ওর মেয়ে পড়ে না যায়!

   ইমলি একহাতে মেয়েকে ধরে আছে আর এক হাতে ধরে আছে কোলের ওপর রাখা ব্যাগ; ব্যাগটি চামড়ার; সুন্দর। গত সপ্তাহে আড়ং থেকে কিনে দিয়েছে ওর বড় মেয়ে, সুবর্ণলতা। ইমলি চামড়ার ব্যাগ ব্যবহার করে না। সব সময় কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করে। ব্যাগটি নিতে চায়নি; কিন্তু মেয়ের কথাসবসময় একইরকমের ব্যাগ ব্যবহার করো, এবার না হয় একটু অন্যরকম হলো। স্বাদ বদল আরকি!  ইমলি ব্যাগটা বেশ শক্ত করেই ধরেছে কিন্তু বারবার পিছলে যাচ্ছে। ঐ ব্যাগটির সঙ্গে ধরে আছে একটা কাগজের ঠোঙা; ভাইয়ের বউ কিছু আপেল আর কমলা দিয়েছে সেই ঠোঙাতে ভরে। 

   প্রায় পনেরো মিনিট! যানজট ছেড়েছে। রিকশা চলতে শুরু করেছে। রিকশা-গাড়ি দুমদাম চলছে, হঠাৎ ইমলির খেয়াল হয় রাস্তা বেশ ফাঁকা হয়ে গেছে। হঠাৎ আঙুলে একটা টান অনুভব করে। ব্যাগটি যে খোয়া গেছে প্রথমে বুঝতে পারেনি ইমলি; বুঝতে কিছুক্ষণ সময় লাগলো! বুঝতে পেরে তো হতবাক। যখন বুঝলো তখন আর করার কিছুই নেই। ছেলেটি হুন্ডাতে; অনেকটা দূর চলে গেছে। ওর চেহারা দেখতে পেলো না; শুধু দেখতে পেলো ব্যান্ড বাঁধা লম্বা চুলওয়ালা একটি ছেলের হাত ওর ব্যাগটি দুই পায়ের ফাঁকে রাখছে। ব্যাগটি রাখতে দেখেই ওর মনে পড়লো ব্যাগে মোবাইল আছে। মোবাইলটি দিয়েছে ওর আরেক মেয়ে, কনকলতা। এই নিয়ে তিনবার ছিনতাই হলো। প্রথমবার ছিনতাই হয় ধানমন্ডিতে। অসুস্থ বাবা ছিলেন ভাইয়ের বাসাতে। বাবাকে দেখে ফেরার পথে হলো ছিনতাইয়ের কেলেঙ্কারী। কেলেঙ্কারী এই জন্য যে ব্যাগটিতে ছিল অফিসের চাবি। ঐ ব্যাগটি ছিল নতুন; চমড়ার নয় কাপড়ের। গ্রামীন চেকের ওপর সুই-সুতার কাজ করা। পছন্দের ব্যাগ ছিল। ইমলি একটি বেসরকারি ফার্মে চাকরি করে। এমনিতে অফিসের চাবি বহন করতে হয় না কিন্তু ঐ অফিসার ছুটিতে থাকার জন্য কয়েকদিন অফিসের চাবি বহনের ভার পড়েছিল ওর ওপর। অফিসের চাবি হারিয়েছে তাই থানাতে জিডি করতে হয়েছিল। এই ছিনতাইয়ের জন্য ওকেই দায়ী করেছিল অফিস। অফিস বলেছিল, বাবাকে দেখতে যাওয়ার কি এতোই দরকার ছিল। ওয়ানিং লেটার দেয়নি শুধু মুখে বলেই ছেড়ে দিয়েছিল। 

   দ্বিতীয়বারের ছিনতাইয়ের গল্প মর্মান্তিক হলেও হাস্যকর! সকাল পৌনে নয়টাতে বাসা থেকে বের হয়েছে। মেইন রোডে যেতে গলি পার হতে হয়। শরীর খারাপ থাকায় একটু অন্যমনস্ক ছিল। হঠাৎ সামনে একটা হুন্ডা দেখে থমকে দাঁড়ালো। হুন্ডায় একটি ছেলে বসে আছে আর একজন পাশে দাঁড়িয়ে; দাঁড়ানো ছেলেটি বলল, ‘খালাম্মা, আপনার চুড়ি খুলে দ্যান।কথা বলেই চকচকে একহাত লম্বা একটি ছুরি বের করে ধরে রাখলো সামনে। গলিটা সে সময় সুনসান। ইমলি না পারলো চিৎকার করতে না পারলো কাউকে ডাকতে। ওরা চুড়ি খুলে নিয়ে চলে গেল। এই ছিনতাই নিয়ে অনেক ভেবেছে কয়েকদিন। ও কেন প্রতিবাদ করতে পারেনি, পারেনি নিজের জিনিষগুলো রক্ষা করতে। প্রতিবাদ করলে যদি ছুরি মেরে বসে এই ভয়ে প্রতিবাদ করেনি। মৃত্যুভয় নিয়ে ভেবেছে কয়েকদিন!

   ইমলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অক্ষমদের যেমন মনের অবস্থা হয় তেমনি মনের অবস্থা ওর! আর সকলের মতো ভাবে ইমলি, ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। যাকগে বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইমলি; মোবাইলে প্রয়োজন মিটছিল ঠিকই কিন্তু অন্যদিকে অসুবিধাও হচ্ছিল। কিছুদিন ধরে কেউ থ্রেট করছিল, কেউ গালাগালি, কেউ আবার প্রেম নিবেদন করছিল। আবার মিসকল দিচ্ছিল কেউ। এইসব কারণে মোবাইলের ওপর তো বটেই মানুষের ওপর থেকেই ওর বিশ্বাস উঠে যাচ্ছিল। মানুষকে খারাপ ভাবতে শুরু করছিল কিন্তু সব মানুষ তো আর খারাপ নয়। মন্দ ভালো মিশিয়েই এগিয়ে চলছে পৃথিবী।

   বাসায় ফিরে এলো ইমলি। বাসা থেকে বের হতে চায়নি তবুও বের হয়েছে। চাচাতো ভাইয়ের একটি ছেলে হয়েছে। তিন মাস বয়েস কিন্তু দেখতে যেতে পারেনি; না গেলে খারাপ দেখায় তাই যাওয়া। দরোজায় কলিংবেল চাপতেই দরোজা খোলে সুবর্ণলতা। ওকে দেখেই মেয়ে বলে, ‘কী হয়েছে তোমার আম্মু? তোমাকে  কেমন যেন দেখাচ্ছে।ওর কথা শুনেই কান্না শুরু করে অনুশ্রী। বড় বোন আদর করে; আদর পেয়ে কাঁদতে কাঁদতেই বলে, ‘ ব্যাগ ছিনতাই হয়েছে!’ ‘কেমন করে?’ হুন্ডাতে ছিল ছেলেটি। যাওয়ার সময় পাশ থেকে টান দিয়ে নিয়ে চলে গেছে।’ ‘ব্যাগে কিছু ছিল না।’ ‘ছিল তো। মোবাইল ছিল, ছোট মামা যে চশমাটা দিয়েছিল ঐ টা ছিল। আরও ক্রেডিট কার্ড ছিল।এবারে কথা বলে ইমলি।ঝামেলার ওপর ঝামেলা! এখন আবার ক্রেডিট কার্ড ক্যানসেল করতে হবে।

   ইমলির মনটা খারাপ। অনুশ্রী সব বলেছে বিষুবকে। কিন্তু ওর সঙ্গে কথা বলেনি বিষুব। অনুশ্রীর কাছে শুনেছে। ওরা গেছে দেখে খুব রাগ হয়েছে। যাওয়ার আগে যখন ওকে বলেছে তখন বলেছে, ‘তোমার ঘরে থাকতে মন চায় না। শুধু বাইরে বাইরে ঘোরা।বিষুবের কথায় খুব কষ্ট পেয়েছিল এখন আরও পেলো। খুব আশা করেছিল কথা বলবে বিষুব। কিন্তু করেনি! মানুষ কি চায় মানুষ চায় বিপদ-আপদে কাছের জনদের কাছ থেকে সহানুভূতি। কিন্তু হয়েছে উল্টো। সহানুভ'তি পাওয়া তো দূরের কথা উল্টো রাগ। ইমলির খুব কষ্ট হয়। নিজের ভেতরে নিজে খুব একলা হয়ে যায়!

   ছিনতাইয়ের কষ্ট থেকে একাকীত্বের কষ খুব ম্রিয়মান করে ফেলে ওকে। এটা কি ঠিক করেছে বিষুব? নিজেকেই প্রশ্ন করে ইমলি। প্রয়োজনে বাইরে যেতে হবে না! আর ও তো বেড়াতে যায়নি, এটা তো দায়িত্ব। বিয়ে-শাদী, মুসলমনি, মুখে ভাত, অসুখ-বিসুখে দেখতে যাওয়া সামাজিক দায়িত্ব। মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক রীতিনীতি মেনে চলতে হয় ইমলিকে; ইমলি তো মানুষ ছাগল নয়।

   ইমলির মন খারাপ। খেতে ইচ্ছা করে না। হারিয়ে যাওয়া জিনিষগুলো দুঃখ হাঁটাহাঁটি করতে থাকে মনে। না খেয়ে শুয়ে থাকে। জানালার বাইরে আকাশ। অনেক উপরে ঠিক যেন আকাশে গায়ে উড়ছে একলা একটি চিল। ইমলির দুঃখটা ঐ চিলের ডানার সঙ্গে মিশে যায়। মন থেকে সব দুঃখ বের করে দেয় ইমলি। ল্যান্ড ফোন বেজে ওঠে।

   ওপাশে একটি নারী কন্ঠ।এইটা কি ইমলি ম্যাডামের বাসা।ইমলি হ্যাঁ বা না কিছু না বলে বলে, ‘কে বলছেন।’ ‘আমাকে চিনবেন না। আমার বাসা উত্তর বাসাবো। একটি ব্যাগ পেয়েছি। ওটার ভেতরে একটি  ফোন নম্বর পেয়ে ফোন করছি।এবারে একটু নড়েচড়ে বসে ইমলি। বলে, ‘ওটার মধ্যে আর কি আছে?’ ‘ধার কিছুই নেই শুধু কাগজপত্র ছাড়া; আপনার ঠিকানাটা বলেন আমি কাউকে দিয়ে আপনার ব্যাগ পাঠিয়ে দিবো। নাকি আপনি নিজেই আসবেন।ইমলির যেতে ইচ্ছা করলো না। বলল, ‘আপনি ইচ্ছা করলে পাঠিয়ে দিন। কষ্ট করেছেন, এসে না হয় একটু  চা খেয়ে যাবেন।’ ‘ঠিক আছে।  

   বিকেলে মহিলাটি এলেন সঙ্গে একটি ছেলে। ছেলেটির লম্বা চুলে ব্যান্ড বাঁধা। ইমলির সকালের ছেলেটির কথা মনে পড়ে গেল। কথাটা বলতে গিয়েও বাধা পেলো, মনে হলো কতো ছেলেই তো এখন লম্বা চুল রাখে ব্যান্ড বাঁধে। ছেলেটির দিকে তাকাতেই মনে হলো ছেলেটি মাদকাসক্ত, জীবনের প্রতি কোন আগ্রহ নেই ছেলেটির। ছেলেটিকে কিছু না বললেও মনের মধ্যে খচখচে একটা কাঁটা খুঁচিয়িই চললো। ওরা চলে গেল। কিন্তু ইমলির মন বেদনার্ত হলো। স্বাধীন দেশের তরুণ সমাজের বিক্ষিপ্ততা, জীবনের প্রতি বিরূপতা ওকে মূহ্যমান করে রাখলো।