সবিতা দেবীর বয়স নব্বই ছুঁই ছুঁই। শরীরের নানারকমের অসুখ
বাসা বেঁধেছে ডাক্তারবাবু বলেছেন কিডনি,হার্টের যা অবস্থা, বড়জোর
আর কয়েকদিন বাঁচবেন। ছেলে একটা প্লাসটিকের গামলা কিনে দিয়েছে। বাথরুম শোবার ঘরের থেকে
অনেক দূরে। ওই গামলায় পেচ্ছাপ করা যাবে। কিন্তু পায়খানা যেতেই হবে দূরে। ফলে রাতে দরজার
তালা খুলে উঠোন পেরিয়ে বাথরুম যেতে হয়। তখন স্বামী বারবার বলেছিলেন,তোমার ঠাকুর ঘরের পাশেই বাথরুমটা হলে বুড়ো,বুড়ি
আমাদের দুজনেরই সুবিধা হবে। কিন্তু সবিতারাণী রাজী হন নি। তিনি বলেছেন,ম্লেচ্ছ,নোংরা লোকের মতো কথা বলো না। ঠাকুর ঘরের
পাশে আবার বাথরুম হয় নাকি? স্বামী বলেছিলেন,তাহলে মানুষের শরীরটাতো বাথরুমের থেকেও নোংরা। সবিতাদেবী তর্ক করেন নি আর।
শুধু বলেছিলেন, দূরেই করো। সব মনে পরছে তার। স্বামী বারো বছরের
বড় ছিলেন। আগেই চলে গেলেন মহাসিন্ধুর ওপারে।
তাঁর স্বামী বড়ো অভিনেতা ছিলেন।সবিতাদেবীকে বলতেন,তিরস্কারের থেকে জীবনে পুরস্কারই বেশি
পেয়েছি। অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা। এর থেকে বড় পুরস্কার আমার অভিধানে নেই। আমার যোগ্যতার
বেশি, তার পরিমাণ। ঈশ্বর সময় হলেই প্রত্যেকের যোগ্য পাওনাটুকু
দিতে ভোলেন না। শুধু প্রয়োজন ধৈর্য আর সহনশীলতা। সময় কিন্তু কারও কথায় এগিয়ে আসবে না
বা পিছিয়ে যাবে না। অভিজ্ঞ লোকেরা প্রথমে ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। অন্য মানুষকে
সহ্য করা, সম্মান করা ধর্মেরই নামান্তর। মানুষের জন্যই মানুষ।
শুধু শুকনো লোক দেখানো ধর্ম যা মানুষকে ছোটো করে সেটা কখনই ধর্ম হতে পারে না। ধর্ম
হচ্ছে অণুবিক্ষণের মতো। ছোটো জিনিসকে বড়ো করে দেখে।
সবিতাদেবীর মা ছিলেন গ্রামের লক্ষীদেবী। তার দান,ধ্যানের জন্য সকলেই খুব ভালোবাসতো। মনে পরে সবিতাদেবীর মায়ের
কথা। তিনি বলতেন,কথিত আছে কোজাগরি লক্ষীপুজোয় পুজো করার পরে যে গৃহস্থ রাত্রি জাগরণ করে
রাত কাটাবে তার ঘরে লক্ষী স্বয়ং বিরাজ করেন। কোনো অভাব, অনটন
তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। স্বার্থ নিয়েই মানুষ পুজো করে। কারণ সে সংসারী। ছেলে, মেয়ে, বাবা,মা,
ঠাকুমা, দাদু সকলকে নিয়ে এই সংসার। তাদের
মঙ্গল কামনা করেই মানুষের এই পুজো পার্বণ।
মায়ের মূল লক্ষ্য থাকতো মানুষের সেবা করা হয়তো তিনি আশ্রম করে যেতে পারেন নি।
কিন্তু প্রত্যেক পুজোতে গরীব মানুষকে পেট ভরে প্রসাদ খাওয়াতেন। বাজারে দরদাম করে ঠাকুর কেনার পরে পুজোর ফলমূল, দশকর্মার জিনিসপত্র কিনে বাড়িতে আলপনা
এঁকে ঠাকুরের প্রতিষ্ঠা হয়। তারপর পুরোহিতের পৌরোহিত্যে গৃহস্থের মঙ্গলসাধন। লৌকিক আচার, আচরণে বিশ্বাস জড়িয়ে থাকে। আর বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। পুজোর প্রতিটি পর্যায়ে
শিল্প ভাবনা বিরাজ করে। তারফলে পুজো আরো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। দুর্গাপুজোয় ঢাক বাজে। প্যান্ডেলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে কোনো কিছুর
আদলে মন্দির বানানো হয়। যেমন, তাজমহল, খাজুরাহো, কোনারক
প্রভৃতি। নানারকম বাদ্যযন্ত্র পুজেকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। প্রত্যেক প্যান্ডেলে যদি নর নারায়ণ সেবা হতো তাহলে আরও ভালো
লাগতো। সবিতাদেবী কথা বলার সঙ্গী পান না। তাই বসে বসে নিরালায় পুরোনো দিনের কথা ভাবেন।
কাটোয়ার কার্তিক লড়াই, চন্দননগরে জগদ্ধাত্রি পুজো, কাগ্রামের জগদ্ধাত্রি পুজো বাংলার পুজোর জগতে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। মা সব পুজোতেই মানুষকে খাইয়ে আনন্দ পেতেন। সঙ্গে সবিতা থাকতেন। মায়ের
এই গুণ তার মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করেছিলো। সবিতা দেবী এক লক্ষীপুজোর কথা মনে
করছেন বসে বসে। অখন্ড অবসর তার।
পুজো এলেই মায়ের লক্ষ্মীর ঝাঁপি উন্মুক্ত
হয়ে যেতো। কোজাগরীর রাতে মা কম করে তিনশো লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। মাজা নীচু করে
আসনে বসা মানুষদের প্রসাদ বিতরণ করতাম আমরা ভাই বোনেরা। পরের দিনও খিচুড়ির ব্যবস্থা
থাকতো। ডোমপাড়ার সকলে এসে নিয়ে যেতো আনন্দে। সর্দার বুড়ি বেসকা দি, মঙ্গলীদি সবাই আসতো। ছোটো পিসি, মানা, বড়পিসী, সন্ধ্যা,রুনু,
শংকরী সকলে আসতো। মায়ের ঘর পূর্ণ হয়ে উঠতো অতিথি সমাগমে। গম্,গম্ করতো বাড়ি। মানুষই যে লক্ষ্মী তা আবার প্রমাণ হয়ে যেতো চিরকালের সত্য
সুরে।
পুজোর বেশ কিছুদিন পরে মেয়েরা সকলে এক হয়ে মাংস, ভাতের ফিষ্টি করতো। মনেআছে আমার,
খেতে এসে বিশাখাদি বলেছিলো, আমি বিধবা মাংস
খবো কি করে? আমার মাসতুতো দিদি বলেছিলো, বিধবা আবার কি কথা? তোর স্বামী মরে গেছে। দুঃখের কথা।
তার সঙ্গে মাংসের কি সম্পর্ক। আচ্ছা কেউ মনে কর মাংস খেলো না। আর মনে মনে স্বামীকে
দোষ দিলো। সমাজপতিরা, সমাজের সেনাপতিরা মনের নাগাল কি করে পাবে? ওদের হাত ওই মাংস অবধি। অতএব, নো চিন্তা, ডু ফুর্তি।
বিশাখাদি আনন্দে মাংস খেয়েছিলো। সমস্ত কিছুতেই চিরকাল কিছু মহিলার সংস্কারমুক্ত মনের জন্য পৃথিবী এত
সুন্দর। উন্মুক্ত সমাজ আমাদের সর্দার পাড়ার। সেখানে সমাজের কোনো সেনাপতি বিধি আরোপ
করে না। যে যারইচ্ছেমতো খেটে খায়। কেউ মুনিষ খাটে, কেউ মাছ ধরে, কেউ কেরালা
সোনার দেকানে কাজ করে। বুড়ো বয়সে তারা ছেলে মেয়েদের রোজগারে খায়। ওদের কাউকে বৃদ্ধাশ্রমে
যেতে হয় না। কার কৃপায় ওরা বুড়ো বুড়ি হয় না? শক্ত সমর্থ থাকতেই
পরকালের ডাকে ওপাড়ে চলে যায়। কাজই হলো আসল লক্ষ্মী। স্বামী বলতেন তার মায়ের কথা। তিনি বলতেন, আমার মা সাধনায় ছিলেন রামপ্রসাদ। মা রক্ষাকালীর পুজো দিতে
দিতে গেয়ে উঠতেন রামপ্রসাদি। নিরামিষ মা কালীর আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে ছেলেদের নিয়ে সংসার
চালাতেন জীবনানন্দ ছন্দে। অভাব থাকলেও কোনোদিন তার ছাপ পড়েনি মায়ের চোখেমুখে। আসল মূল্যবান রত্নের সন্ধান তিনি পেয়ে
গেছিলেন পুজোর আসনে বসে। কোনোদিন তার কথায় প্রকাশ পেতো না সেসব কথা। তার চলনে, বলনে ফুটে উঠতো মাতৃরূপের জলছবি। মাকে দেখেই মাথা নত হয়ে যেতো সকলের। দাদু
মাকে মা বলেই ডাকতেন। তিনি সময়ে অসময়ে মাকে রামপ্রসাদী শোনাতে বলতেন। মায়ের গান শুনতে
শুনতে একদিন চলে গেলেন পরপারে তৃপ্ত মুখে। একবার বৈশাখি ঝড়ে আম গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়লো।
মা বললেন,তোদের দাদুর আত্মা মুক্তি পেলো। অই ডালে বাঁধা ছিলো
দাদুর মুক্ত হবার লাল চেলি। অবশ্য এটা ছিলো এক সাধুবাবার তুকতাক। বুড়ি ঠাকুমা সেদিন
কেঁদে উঠেছিলো জোরে। ঠাকুমা বলে উঠলেন,চলে গেলো,ও চলে গেলো। কোনো কিছুই আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না। তবু কিছু ঘটনা বার বার
তার অস্ত্বিত্বের কথা স্বীকার করে নেয়। একটা দেশি কুকুর আমাদের বাড়িতে থাকতো ছোটে থেকে।
তোমরা বিশ্বাস করবে কি না জানি না? সে অমাবস্যা,পূর্ণিমায় কিছু খেতো না। রক্ষাকালী পুজোয় উপবাস করতো। তার সামনে খাবার দিয়ে
দেখা গেছে সে খাবারের ধারের কাছে যেতো না। শুধু কথা বলতে পারতো না। কিন্তু ভাবে,
ভঙ্গিমায় সব বেঝাতে পারতো মানুষের মতো। মা বলতেন,পূর্বজন্মে তোর সঙ্গে কোনো আত্মীয়তা নিশ্চয় ছিলো। তাই তোর আমাদের বাড়িতে
আগমণ। যেদিন জিম দেহ রেখেছিলো সেদিন ওকে মাটি চাপা দিয়ে ধূপ আর ফুলে শেষ বিদায় জানিয়েছিলো
সারা পাড়ার বাসীন্দা। তাহলে কি বলবে তুমি এই ঘটনাকে। কোন যুক্তিতে অস্বীকার করবে তার
সারা জীবন ধরে পালন করা ব্রত,উপবাস। বলবে,কাকতালীয়। সেসব তো এক আধবার হয়। সারাজীবন ধরে নিয়মিত হয় না।
বিজয়ার সময় আমার মা জিমকে প্রথম মিষ্টিমুখ করাতেন। ধান
রাখার গোলার তলায় একবার গোখরো সাপ দেখে, ঘেউ ঘেউ শব্দ করে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছিলো সাপটা।
তারপর সাপুড়ে ডেকে সাপটি বনে ছেড়ে দেওয়া হয়। বড়দার বিছানার
মাথার কাছে সে শুয়ে থাকতো। কোনো বিপদ বুঝলে ঝাঁপিয়ে পরতো নিঃস্বার্থ ভাবে। প্রত্যেক
প্রাণীর কাছে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু।
স্বামী চলে যাওয়ার পরে একদম একা হয়ে পরেছিলেন তিনি। মনে
পরতো তার আদর। প্রথম ফুলশয্যার রাত। কি করে যে একটা একটা করে রাত, দিন পার হয়ে যায়, বোঝাই যায় না। তবু বুঝতে হয়, মেনে নিতে হয়। একটা
ঘুঘু পাখি তার স্বামী মরে যাওয়ার পর থেকেই এবাড়িতে আসে। আম গাছের ডালে বসে আপন মনে
কত কথা বলে। ঘুঘুর ঘু,ঘুঘুর ঘু। সবিতাদেবীর সঙ্গে পাখিটার
খুব ভাব। মনে হয় স্বামী ঘুঘুর রূপ ধরে আসেন। তিনি আম গাছের তলায় খুদকুড়ো ছিটিয়ে দেন।
ঘুঘু পাখিটা খায় আর গলা তুলু সবিতাদেবীকে দেখে। কিছু বলতে চায়। তিনি বোঝেন। আর আপনমনেই
পাখিটার সঙ্গে বকবক করেন। পুরোনো দিনের কথা বলেন। ছেলের বৌ বল,বুড়িটা পাগলী হয়ে গেছে। প্রতিবেশীরা অতশত বোঝে না। হাসাহাসি করে। শুধু তার
ছেলে বোঝে মায়ের অন্তরের কথা, ব্যথা। ঘুঘু পাখিটা সারাদিন
ডেকে চলে। এবার আয়, এবার আয়। বুড়ি বলে,ও ঘুঘুর ঘু,বলে না। বলে,এবার আয়,এবার আয়। নাতি এসে মাঝে মাঝে ঠাকুমার কাছে
বসে। আর ঘুঘু পাখিটার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলে,এবার আয়।
নাতিকে গল্প বলে ঠাকুমা। নিজের জীবনের কথা বলেন, জানিস, ছোটোবেলায় আমার বন্ধুদল ছিলো। বক্রেশ্বর
নদী ছিলো। গাছ ছিলো। তারাও আমার বন্ধুর দলে ভিড়ে গেয়েচিলো। নদীর ধারে বনকুলের গাছ ছিলো।
তারা সাজিয়ে রাখতে আমাদের জন্য মিষ্টি কুল। আমরা আঁচলে করে, বা গামছায় বেঁধে মুড়ি নিয়ে যেতাম। ছোলাভাজা,কুসুম ফুলের বীজ ভাজা চালভাজা নিয়ে যেতাম। নদীর ধারে বসে জলে পা ডুবিয়ে খেতাম। নদীর জল হেঁট হয়ে বসে চুমুক দিয়ে
পান করতাম। পায়ে বিভিন্নরকমের রঙীন মাছ চুমু খেয়ে যেতো। আমরা মুড়ি খাওয়ার পরে গামছা
করে রঙীন মাছ ধরতাম। আবার ছেড়েও দিতাম। তারা সাঁতার কেটে খেলা দেখাতো।
একবার সন্ধ্যা হল,আমরা আমড়া গাছে ভূত দেখেছিলাম। ভূতের কথা শুনে নাতি
বললো,কি ভূত গো ঠাকুমা। ভালো না খারাপ।
তখন ভূত গুলোও ভালো ছিলো। আমাদের শুধু বলেছিলো, তিনি সন্ধে বেলা বাড়িতে পড়তে বসবি। এখন আমরা আসর জমাবো। তোরা বিকেলে খেলবি। জানিস না,তিনি সন্ধে বেলা, ভূতে মারে ঢেলা। ভূতের গল্প শুনে নাতি ঠাকুমার কোল ঘেঁষে বসতো। ঠাকুমা বলতেন,ভয় কি আমি তো আছি। ঠাকুমা সবিতা দেবী ঠাকুরকে বলেন,আর একবার সময়ের চাকাটা উল্টোদিকে ঘোরানো যায় না। তাহলে আবার ছোটো বয়সটা পাওয়া যাবে। নদীর জল খাওয়া যাবে। স্কুল ফাঁকি দিয়ে মাঠে, মাঠে ঘোরা যাবে। ঘু ঘু পাখিটা বিজ্ঞের সুরে বলে,না না না, ঘুঘু, ঘুঘু।
তখন ভূত গুলোও ভালো ছিলো। আমাদের শুধু বলেছিলো, তিনি সন্ধে বেলা বাড়িতে পড়তে বসবি। এখন আমরা আসর জমাবো। তোরা বিকেলে খেলবি। জানিস না,তিনি সন্ধে বেলা, ভূতে মারে ঢেলা। ভূতের গল্প শুনে নাতি ঠাকুমার কোল ঘেঁষে বসতো। ঠাকুমা বলতেন,ভয় কি আমি তো আছি। ঠাকুমা সবিতা দেবী ঠাকুরকে বলেন,আর একবার সময়ের চাকাটা উল্টোদিকে ঘোরানো যায় না। তাহলে আবার ছোটো বয়সটা পাওয়া যাবে। নদীর জল খাওয়া যাবে। স্কুল ফাঁকি দিয়ে মাঠে, মাঠে ঘোরা যাবে। ঘু ঘু পাখিটা বিজ্ঞের সুরে বলে,না না না, ঘুঘু, ঘুঘু।
আজ সকাল থেকে সবিতাদেবী উঠোনের রোদে বসল আছেন। ছেলে অফিস
যাওয়ার আগে আজকে প্রণাম করলো। কোনোদিন করে না তো। তিনি আশীর্বাদ করলেন ছেলেকে প্রাণভরে।
ছেলে বললো,সাবধানে
থেকো। আজ ওরা পিকনিক করতে যাবে পুকুরের ধারে। ছেলে চলে গেলো।
এখন শীতকাল। পিকনিকের সময়। যাবে বৈকি। নিশ্চয় যাবে। তারও
যেতেন। যুগে যুগে পরম্পরা এইভাবেই তো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। ভাবেন সবিতাদেবী। বৌমা নাতিকে
দিয়ে একবাটি মুড়ি,তরকারী নামিয়ে দিয়ে গেলো। ঠাকুমা খিদে পেলে খাবে। ঠাকুমা বললেন,বেশ বাবা। তোমরা যাও। আমি ঠিক খেয়ে নেবো। মনে পরে গেলো একবার ফাঁকা বাড়ি
পেয়ে রান্না করে খেয়েছিলেন। পুড়ে গেছিলো তরকারীটা। সেই প্রথম রান্নার অভিজ্ঞতা। তারপর
দুপুরবেলা তালবোনা পুকুরে সাঁতার কেটে তাল কুড়িয়ে এনেছিলেন। সব মনে আছে। আরও মনে পরছে
পাড়ার ধীরেন ফাঁকা বাড়ি পেয়ে তার কাছে এসলছিলো। খুব ভালে ছেলে। অনেক গল্প হয়েছিলো।
একটা চুমু খেয়েছিলো। আর কিছু নয়। বলেছিলো, সারা জীবন এই স্মৃতি
মনে থাকবে তার। ধীরেন এক বছর পরে ক্যান্সারে মারা গেছিলো। কিন্তু কিশোরী সবিতার কাছে
সে অমর হয়ে আছে। স্বামীকে সব কথা খুলে
বলেছিলো। বড় সরল তার মন। বলার ফলে অশান্তি হয়েছিলো অনেক
একজন মৃত মানুষ জীবন্ত হয়ে উঠেছিলো সংসারের টানা পোড়েনে। তারপর বয়স বাড়লে তার স্বামী বুঝেছিলেন পাগলামীর কথা। তখন তার গোপন বাল্যপ্রেমের কথা তিনি বলেছিলেন সবিতা দেবীকে,যখন তখন নয়নার ছবি ভেসে উঠতো নয়ন জুড়ে। তবু সেকথা বলা হয়নি আজীবন। দূর থেকে শুধু দেখা আর দেখা। সে দেখা মৃত্যুর আগে অবধি ছিলো অন্তরজুড়ে।
একজন মৃত মানুষ জীবন্ত হয়ে উঠেছিলো সংসারের টানা পোড়েনে। তারপর বয়স বাড়লে তার স্বামী বুঝেছিলেন পাগলামীর কথা। তখন তার গোপন বাল্যপ্রেমের কথা তিনি বলেছিলেন সবিতা দেবীকে,যখন তখন নয়নার ছবি ভেসে উঠতো নয়ন জুড়ে। তবু সেকথা বলা হয়নি আজীবন। দূর থেকে শুধু দেখা আর দেখা। সে দেখা মৃত্যুর আগে অবধি ছিলো অন্তরজুড়ে।
সবিতা দেবী এক মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে যৌবনে বিকেলে যখন বেড়াতে
যেতেন তখন সবাই তাকিয়ে দেখতো। ছেলে বড়ো। মেয়ে ছোটো। মেয়েকে অনেকে ভালোবেসে চকলেট দিতেন।
মেয়ে আর একটা হাত পেতে বলতো,আর একটা দাও। দাদা খাবে। ছোটো থেকে আমরা সবাই ভাগ করে খাবো, এই আদর্শে মানুষ তার ছেলে মেয়ে। ভারতীয় দর্শন তো সেই কথাই বলে। স্বামী অসীম
চাকরী করতেন বেসরকারি একটা কারখানায়। ম্যানেজার ছিলেন তিনি। ছোটো থেকে নিজে অনেক কষ্ট
করেছিলেন। মুদিখানা দোকান ছিলো তার বাবার। বৃদ্ধবাবা, বাজার
যেতে পারতেন না। তখন রাস্তায় ছিলো মাটির ধুলো। বৃষ্টি পরলে কাদায় পিছল হয়ে যেতো পথ।
তবু মাথায় করে বয়ে আনতেন নুনের বস্তা, যার ওজন ছিলো ষাট কেজির
মতো। অমানুষিক পরিশ্রম করে বড় হয়েছিলেন তিনি। পেট ভরে দুবেলা খাবার জুটতো না। সবিতাদেবীর
খুব খারাপ লাগতো। তাই তিনি তার দাদা, দুকড়ি কে সব কথা খুলে
বলেন। দুকড়ি দাদা কলকাতায় কাজ করতেন। অনেক মাড়োয়ারি, কারখানার
মালিকের সঙ্গে তার জানাশোনা ছিলো। তিনি অসীমকে একটা কারখানার ম্যানেজার পদের চাকরী
জোগাড় করে দিলেন। অসীম নিজের দুঃখের কথা ছেলেমেয়েদের কোনোদিন বলেন নি। তিনি ছেলে ওমেয়েকে
জমিদারের সন্তানের মতো মানুষ করেছিলেন। ঝুলনের দিনে পুতুলে ভর্তি হয়ে যেতো ঘর। ছেলেমেয়েরা
ঝুলন সাজাতো। আর অসীমবাবুর খুব ভালো লাগতো। ছোটোবেলার নিজের না পাওয়ার দুঃখ তিনি ভুলে
যেতেন। দোলের সময় ছেলে মেয়েকে কিনে দিতেন নতুন জামা। সেই জামা পরে তারা দোল খেলতো।
মিষ্টি,মাংস, ফল কিছু বাকি থাকতো
না। কত লোক আসতো তার বাড়িতে রং মাখাতে। তারপর মিষ্টিমুখ করে ফিরে যেতো রাম রাম বলে।
আমরা শ্রদ্ধেয় লোককে দেখে যেমন নমস্কার করি। যারা হিন্দীভাষী তারা শ্রদ্ধেয় গণ্যমান্য
লোককে দেখলে বলে,রাম রাম রায় বাবু। লিলুয়া শহরে পটুয়াপাড়ায়
বাসা ভাড়া করে থাকতেন অসীমবাবু। তারপর একদিন তার গ্রামের ভাই মরে গেলো কম বয়সে। জীবন
ওলট পালট হয়ে গেলো। চাকরী ছেড়ে আবার চলে গেলেন গ্রামে। জমানো পয়সা,সোনাদানা সব খরচ হয়ে গেলো। ধার, দেনা করে কোনোরকমে
একটা দোকান করলেন। মুদিখানা। আবার শুরু হলে জীবন সংগ্রাম। মেয়ের বিয়ে হলো কোনোরকমে।
ছেলের তখনও চাকরী হয় নি। শরীরের ওপর চাপ খুব বেশি হয়ে পরলো। তার ফলে অল্প বয়সে মারা
গেলেন তিনি। এবার দোকান চালায় ছেলে। দোকান বেশিদিন চালাতে হলো না। ছেলে চাকরী পেলো।
সেদিন খুব আনন্দ হয়েছিলো সবিতাদেবীর।
মনে পরে তার, একবার সুতিকা হয়েছিলো তার। পেট ফেঁপে যেতো। বারবার
পায়খানা যেতে হতো। তখন মাঠে,ঘাটে সারতো সবাই। শ্বশুরমশাই খাল
কেটে দিয়েছিলেন। তারপর শুয়োগাছি গিয়ে সাধুবাবার কাছে শেকড়,বাকড় খেয়ে বাবা ভূতনাথের দয়ায় অসুখ ভালো হয়েছিলো। শুয়োগাছি থেকে আসার সময়
মেয়েটাকে সারা রাস্তা কাঁধে করে এনেছিলো ছেলে। বাড়িতে এসে দেখলেন,শ্বাশুড়ি মরে গেছেন। শ্বাশুড়ির ছোটো মেয়েটা ভুগছিলো খুব। কাঠির মতো শরীর
হয়ে গেছিলো। শ্বশুর বললেন সবাইকে,ওর মরদেহের সঙ্গে মেয়েটাকেও
বেঁধে দাও। ও তো আর কদিন পরেই মরবে। কিন্তু সেই মেয়ে বড়ো হয়ে গ্রামের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী
হয়েছিলো। রাখে হরি মারে কে? সবিতাদেবী ভাবেন ঈশ্বরের করুণার
কথা। যাইহোক,চাকরী পাওয়ার পরে ছেলের বিয়ে দিলেন সবিতাদেবী।
এখন ছেলে,ছেলের বৌ আর নাতি এই নিয়ে তার সংসার। কোনো কিছুর অভাব নেই। তবু সবিতাদেবীর মনে হয়,আগের দিনগুলোই
ভালো ছিলো। অভাব থাকলেও শান্তি ছিলো হৃদয় জোড়া। যাইহোক এখন বয়স হয়েছে। ভালোমন্দ সব
সমান মনে হয়। বাথরুম যেতে গিয়ে কলতলায় পা পিছলে পরে গেলেন সবিতাদেবী।
বুকটায় খুব ব্যাথা করছে। ঘুঘু পাখিটা নিচে নেমে এসেছে গলা কাঁপিয়ে কি দেখছে পাখিটা।
তিনি ভাবছেন,আমাকেই
দেখছে। একি হলো। আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না কেন?। চিৎকার করার
ইচ্ছে হলেও গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোলো না। তার বাবা,মা,স্বামীকে এবার দেখতে পাচ্ছেন। আর দেখছেন,তিনি ঘুঘু
পাখি হয়ে গেছেন। একটা শীর্ণ শরীর পরে আছে কলতলা জুড়ে। তার শরীর বেশ হাল্কা লাগছে। ঘুঘু
পাখিটার সঙ্গে উড়ে চলে গেলেন খোলা আকাশের নীচে।
সন্ধেবেলা ছেলে,বৌমা,নাতি এসে দেখে,মা পরে আছে কলতলায়। শরীর কাঠ হয়ে গেছে। সবাই ধরাধরি করে নিয়ে এলো বারান্দায়
দড়ির খাটে। আর চাদর,বিছানা নষ্ট করে লাভ নেই। বৌমা ভাবছে।
নাতি বললো,একটা চাদর ঢাকা দাও ঠাকুমাকে। ঠান্ডা লাগবে। ছেলে
একটা সাদা শাড়ী এনে ঢাকা দিলো। তারপর পাড়ার লোকজন এসে নিয়ে গেলো শ্মশানে। সব মিটে গেলো
পনেরো দিনের মধ্যেই।
এখন ছেলে একা। তার ছেলেও বড়ো হচ্ছে। সমানে অনন্তকাল ধরে
চলেছে এই প্রবাহ। ছেলে ভাবছে,মা নেই,বাবা নেই।মন খারাপ। এবার তার মনের খবর কে
নেবে?মায়ের কাছে সময় দিতে পারেনি। শুধু কাজ, কাজ আর কাজ। আর এই কাজ শেষ হলে সেও একা হয়ে পরবে। আজ কবি বন্ধু বাড়িতে এসেছে।
বেশ ভালো লাগছে। বন্ধু বলছে,জন্ম, মৃত্যু তো থাকবেই। সত্যকে মেনে নিতে হয়। তাহলেই আনন্দ। সে বলছে,তবু সব কিছুর মাঝেই ঋতুজুড়ে আনন্দের পসরা সাজাতে
ভোলে না প্রকৃতি। সংসারের মাঝেও সাধু লোকের অভাব নেই। তারা মানুষকে ভালোবাসেন বলেই জগৎ সুন্দর আকাশ মোহময়ী, বলেন আমার মা। সব কিছুর মাঝেও সকলের আনন্দে সকলের মন মেতে ওঠে। সকলকে নিয়ে একসাথে জীবন কাটানোর মহান আদর্শে, আমার দেশই আদর্শ।
সত্য শিব সুন্দরের আলো আমার দেশ থেকেই সমগ্র পৃথিবীকে আলোকিত করুক।
সত্য শিব সুন্দরের আলো আমার দেশ থেকেই সমগ্র পৃথিবীকে আলোকিত করুক।
আমি বললাম, এক নাগাড়ে বকে গেলি অনেকক্ষণ। বন্ধু বললো, তুমি আরও কিছু বলো। সেই জন্যই তোমার কাছে আসা। আমি আবার বলতে শুরু করলাম,আমার কথা আমার গোপন কথা। আমার অনুভবের কথা। কবি বন্ধু আমার কথা শুনতে ভালোবাসে। সে সংসারী। তবু সব কিছু সামলে তার কবিতা তো লিখে চলে।
আমি বন্ধুকে বলতে শুরু করলাম শরত জীবনের কথা। এবার আমার জীবনের পরবর্তী অঙ্ক শুরু।
তারপর শুরু হলো আমার জীবনের রোজ নামচা। আমি ট্রেনে এখন
রবির সঙ্গেই যাওয়া আসা করি। রবির সঙ্গে আমার খুব ভাব। অন্তরঙ্গ বন্ধু আমার। তাছাড়া
ধীরে ধীরে আরও বন্ধু হলো। রবি বললো,শোন আমার একটা কবি সম্মেলনের আলোচনার কথা। এই ট্রেন
জার্নির অভিজ্ঞ তার কথা।
রবি বলছে, যে সব মানুষ অন্ধ, খোঁড়া
কিংবা বার্ধক্যের কারণে মানুষের সাহায্য চেয়ে বাঁচতে চান তারা ভিখারি নন।
একটা সাহিত্য সম্মেলনে রবি বক্তব্য রাখছিলো। বিষয় হলো, ভিখারি- আপনার
চোখে। স্টেজে উঠে গল্পটা বলছিলো।
রবি আবার শুরু করলো তার বক্তব্য, দাঁড়িয়ে। সামনে অনেক কবি, সাহিত্যিক, ও আরও অনেক গণ্যমান্য মানুষ বসে আছেন,
তাদের আমি সকলকে শ্রদ্ধা জানাই। আমি বলছি অভাবের কারণে, রোগের কারণে যারা ভিক্ষা করেন তারা ভিখারি নয়। কারণ বাঁচার অধিকার জ্ঞাপন
করার জন্য তারা
মানুষের দ্বারস্থ হন। বাঁচতে চাওয়া, একমুঠো খেতে চাওয়া তো অন্যায় নয়। মানুষকে ঠকিয়ে যারা টাকার পাহাড় গড়ে তোলে সত্যিকারের
ভিখারি তারাই।
সে বলে চলেছে, আমি ভিখারি দেখেছি অনেক। সেই গল্প আমি আপনাদের শোনাবো।
মানুষের দ্বারস্থ হন। বাঁচতে চাওয়া, একমুঠো খেতে চাওয়া তো অন্যায় নয়। মানুষকে ঠকিয়ে যারা টাকার পাহাড় গড়ে তোলে সত্যিকারের
ভিখারি তারাই।
সে বলে চলেছে, আমি ভিখারি দেখেছি অনেক। সেই গল্প আমি আপনাদের শোনাবো।
সবাই একবাক্যে বলে উঠলেন, বলুন, আমরা
শুনতে চাই।
রবি বলছে, যাদের প্রচুর আছে অথচ সামান্য পেনশেন ভোগীর কাছে
ঘুষ নেয়, বিধবা মহিলাকে মৃত স্বামীর জমানো হক্কের টাকা পাইয়ে
দেবার আগে তাকে শোষন করে ছারপোকার মতো তারাই প্রকৃত ভিখারি। এবার আমি আমার লেখা গল্প
পাঠ করছি।
(শেষ অংশ আগামী সংখ্যায়)