আমার আমি
আমি কখনও
কোথাও জিতেছি বলে মনে পড়ে না । কেবল হেরেছি । জীবনের সব কিছুতে হারতে হারতে আজ আমি
সর্বহারা । আক্ষরিক অর্থে হয়তো না , কিন্তু মানসিকভাবে ভীষণ ভীষণ
ভেঙে পড়েছি । আমার অসার হাত – পা-গুলি কেবল আমাকে সাহায্য করছে । আর যা কিছু শরীরের অঙ্গ – প্রত্যঙ্গ
, সেগুলি যেন আমাকে পরিহাস করছে । আমার মস্তিস্ক আদৌ কাজ করছে কি না সে নিয়ে
আমারই সন্দেহ আছে । কি করব আমি ? আমি কি চিরজীবন বেকার থাকব ? দেখতে দেখতে আমার বয়স তো প্রায় ত্রিশ স্পর্শ করল । আর কতদিন ? কতদিন
এভাবে বাবার অন্ন ধ্বংস করব ? সব কিছুর একটা সীমা থাকা উচিৎ । কিন্তু কি জানেন , আমার কোনও
মাত্রাজ্ঞান নেই । আমি কোথায় থামতে হয় অথবা কতদূর এগোতে হয় , সে সব
কিছুই জানি না ।
কে আমি ? আমাকে আপনারা সকলেই প্রায় চেনেন । হ্যাঁ , চেনেনই তো ! বিশ্বাস হচ্ছে না তো ? তাহলে
আসুন কয়েকটি তথ্য অথবা সুত্র কিংবা পরিভাষায় hints দেওয়া যাক
। আমি এমন একজন যুবক যে বাড়ির কারো কথা মেনে চলি না । আমি যখন তখন বাড়ি থেকে বের
হয়ে যাই । যখন তখন বাড়ি ফিরি । আমার বন্ধু – বান্ধবরা
কয়েকটি নির্দিষ্ট ঠেকে আড্ডা মারি । আমাদের মধ্যে প্রায়ই মারপিট হয় । বাড়ির লোকে
আমাকে নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন । এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন , আমি কে ? এরপরেও
যদি আমাকে না চিনতে পারেন তাহলে আমার কিছু করার নেই । আমার মত আপনারও ঘটে কিসছু
নেই , এমনটা ধরে নিতে পারি । তার চেয়ে বরং আমার জীবনের বিতান্ত শুনুন । শুনলে ,আমি কে
বুঝতে পারবেন , কেমন !
আমি এক উল্কা । আমি এক ভয়ংকর বিভীষিকা । আমি প্রতারক । আমি বেইমান । আমি জঘন্য
। বাড়িতে কেউ আমাকে পচ্ছন্দ করে না । আমি যেন একটা পোষা জানোয়ার । যাকে খেতে – পরতে দিতে
হয় , কিন্তু যার কাছ থেকে কোনও কিছু পাওয়া যায় না । একবার আমি আমার দাদা আর বাবার
মধ্যে চলা কিছু বাক্যালাপ শুনেছিলাম । যা থেকে আমার মনে হয়েছিল , আমাকে এরা
বাড়ির পুরাতন আসবাবপত্র ভাবছে । সেই কথা বার্তার কিছু অংশ তুলে দিই ।
বাবা, ‘পলাশকে
নিয়ে তো আর পারা যাচ্ছে না !’
‘কেন আবার কি করেছে ?’-বকুল মানে
আমার দাদা জিজ্ঞেস করে ।
বাবা , ‘জানিস , তোর মা
বলছে ,আলমারিতে সংসার খরচের জন্য হাজার কুড়ি টাকা রেখেছিল । আজ দেখে পাঁচ হাজার টাকা
কম ।‘
‘ওকে তুমি কিছু বল না কেন ? তোমার
আশকারাতেই ও দিন দিন এমন বেহেড হয়ে যাচ্ছে’ । দাদা অভিযোগ করে ।
‘কি বলব বলতো ? ও কি আর
মানুষ আছে ? আমি কিছু বলতে গেলে উল্টে আমাকেই আজেবাজে কথা বলে দেবে । বিরাট একটা অশান্তির
সৃষ্টি হবে । পাড়ার লোকজন সব শুনবে । সে বারের কথা মনে আছে তো ?
আমার মনে
আছে । বেশ মনে আছে । মনে থাকবেই বা না কেন ? বাড়িতে বাবা চাকরি করে । দাদা
চাকরি করে । ঠাকুমা পেনশন পায় । তারা কেউ আমাকে একটা পয়সাও ঠেকায় না । আমি কি
বানের জলে ভেসে এসেছি ? আমারও সেই ঘটনার কথা বেশ মনে আছে । মনে থাকবে না আবার ? আমাদের
কেতো , ব্যাটা এদিক সেদিক খুব ঘুরে বেড়ায় । ট্রেকিং করে । পাহাড়ে চড়ে । সমুদ্রে , বনেজঙ্গলে
ব্যাটার অবাধ বিচরণ । সেবার এসে বলল , ‘ এবার যাচ্ছি সিল্ক রুট ধরে চিনের
একেবারে বর্ডারে , তোরা যেতে চাইলে যেতে পারিস’!
আমার তো
এই একঘেয়ে জীবন আর একদম ভাল লাগছিল না । আমি যাব বলে ঠিক করলাম।আমার এই ট্রেকিং করতে যাওয়ার কথাটা মাকে বললাম।মা রে রে
করে উঠল।আমি যেন বিরাট একটা গর্হিত কাজ করতে যাচ্ছি।বাবা,দাদা এমনকি
মা - ওরা সকলেই যেখানে খুশি যখন তখন বেড়াতে যাবে , তাতে কোনও দোষ নেই।আমি যেতে
চাইলেই যত দোষ ? এরকম একটা জীবন কারো ভাল লাগে।আমারও লাগছিল না।তাই শেষ মেশ হাজার পাঁচেক টাকা
ঘাপসে চলে গেলাম সিকিমের বর্ডার।
আমি এখনো কোনো চাকরি পেলাম না।বলুন আমার মনে তো ব্যথা থাকবেই।বাড়ির লোক এসব
বোঝে না।কেবল গঞ্জনা দেয়।আমাকে বলে ধর্মের ষাঁড়।এসব কথা সহ্য হয় না।তবু ইচ্ছা না
থাকলেও সহ্য করতের হয়।প্রতিবাদ করতে পারি না।একটা ভয় তাড়া করে।আমি বেকার ।আমার
রোজগার নেই।এই অবস্থায় কিছু বলতেএ যাওয়া মনে নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনা।তাই আমি
চুপচাপ থাকি।আমার ভবিষ্যৎ কি ? আমি ভেবে ভেবে কূলকিনারা পাই না।
এভাবেই একদিন আমি আমার অন্ধকার ভবিষ্যতের কাছ থেকে মুক্তি পেতে চাইলাম।আমি
নেশা করতে শুরু করলাম।যে সে নেশা নয়।গাঁজার নেশা।নেশা আমাকে গ্রাস করল।জানেন সমাজে
যারা এই নেশা করে তাদের একশ জনের মধ্যে নব্বই জনই , নেশা উপভোগ করতেএ পারে।তারা
সারভাইব করে যায়।কিন্তু বাকি দশ জন তা পারে না।তারা নেশাগ্রস্থ হয়ে যায়।আমি সেই দশ
জনের দলে।এই নেশাটা করলেই আমার মাথা কাজ করে না।আমি হিংস্র হয়ে উঠি।
বাড়ির সকলকে উত্যক্ত করি।তাই বাধ্য হয়ে ওরা আমাকে একটা রিহ্যাবিটেশন সেন্টারে
রেখে গেছে।আমি এখন আমাকে চিনতে পারছি।আমি এতদিন যা যা করেছি সবকিছুর জন্য লজ্জ্বা
পাই।জানি না আমি আবার আগের মত সুস্থ স্বাভাবিক হতে পারব কিনা । তবে একটা চেষ্টা
চলছে।আমার অমিকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে।