গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৮

স্বরাজ দত্ত

দীপান্বিতা

    প্রতিদিনের মতো আজও প্রায় ফাঁকা হয়ে যাওয়া স্টেশনে নেমে একবার মোবাইল ফোনে সময়টা দেখে নিলো দীপান্বিতা। আজও প্রায় পঁচিশ মিনিট লেট করেছে ট্রেনটা। ক্লান্ত অফিস পাড়ার শেষ মানুষগুলোকে টানতে টানতে ট্রেনটাও বুঝি ক্লান্ত হয়ে পরে রোজ। বিবাদিবাগ ছেড়ে হাওড়া ব্রিজের তলায় ঢুকতেই, সমস্ত অন্ধকার যেন হুড়মুড় করে ঢুকে পরে ট্রেনের কামড়ায়। আরো, আরো বেশী ক্লান্তি এসে বসে পাশের ফাঁকা সিটে। বয়ে যাওয়া গঙ্গার ভেজা হাওয়া জড়িয়ে দেয় ঘুমের চাদর। অনেক কষ্টে চোখদুটো খোলা রাখে দীপান্বিতা। গঙ্গাকে বাঁপাশে রেখে ট্রেনটা ডানদিকে ঘুরতেই একটা কেন্দ্রীভূত টান অনুভব করে সে, এ টান ঘরে ফেরার টান। এ টান দরজার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা বন্ধ মিলের অকাল বুড়িয়ে যাওয়া বাবা আর ক্রমাগত দুশ্চিন্তার জাল বুনে যাওয়া মায়ের চোখকে স্বস্তি দেওয়ার টান। এ টান একটা দিন শেষ করে, আরেকটা দিন শুরু করার লড়াইয়ের টান।
    লক-আউট মিল স্বপ্ন থামিয়ে ছিল আগেই। গ্রাজুয়েশনটা করতে করতেই নিজের হাতে চ্যানেল সার্ফ করে ঢুকে পতে হয়েছে অ্যাডভেঞ্চার আর ডিসকাভারি ছেড়ে রুজি-রুটি ডিসকভারের রাজ্যে। ক্যুরিয়র কোম্পানির ব্যাক অফিস ছেড়ে বর্তমানে এক মাড়ওয়ারি ফার্মে। রোজকার খাতা লেখা থেকে শুরু করে কাস্টমার অ্যাটেন্ড। সকাল দশটার মধ্যে গদির সাদা চাদরে তাঁর পায়ের ছাপ নাকি মালিকের লক্ষ্মী নিয়ে আসে। আর, সব শেষ করতে করতে রাত আটটা প্রায়। কোনোক্রমে দৌড়ে স্টেশনে পৌঁছতে হয়। কারণ, শেষ ট্রেনটা মিস্‌ করলেই আবার দু-কিলোমিটার হাঁটা। মরা অফিস পাড়ার ছায়া ভূত, আর ফুটপাথের প্লাস্টিক বাধা দোকানগুলো যেন একসাথে হেসে ওঠে, পিছু নেয়, গায়ে হাত দিতে চায়। ধর্মতলা কে সি দাশের সামনেটা এলে তবেই একটু শ্বাস ছারে সে। অন্যথায় প্রশ্বাসে অন্য কিছুর গন্ধ আসে। এরপর আবার বাসের জন্য অপেক্ষা।
    রক্ষে একটাই, শনিবার দিনটা হাফ-ডে দেয় ওরা। রবিবার পুরো বন্ধ। রবিবারটা সমস্ত কিছু ব্যাল্যান্স করতে গিয়ে কোথা দিয়ে যে চলে যায়, কিছুতেই বুঝতে পারেনা দীপান্বিতা। তাই শনিবারের হাফ-ডে টা ওর একার। স্বপ্নের সব বাতিগুলো একটা একটা করে নিভিয়ে দিতে দিতেও, একটা বাতি শেষ অবধি নেভাতে পারেনি ও। অনেক যত্নে বাঁচিয়ে রাখা সেই মৃদু আলো আজকাল মাঝে মাঝেই পথ দেখায় তাঁকে। আসা-যাওয়ার পথের নিত্যসঙ্গী হেড-ফোনের তারগুলো দিয়ে কানের ভিতরে সেঁধিয়ে যাওয়া সবকটা সুর, তাল এখন আলাদা আলাদা করে প্রকট হচ্ছে ওর কাছে। এ এক অন্য ভুবন। যেখানে শুধুই শান্তি।
    লক-আউটের ধাক্কায় সেকেন্ড ইয়ারেই ছাড়তে হয়েছিল গানের স্কুল। তবু গান ছাড়েনি ওকে। শনিবারের হাফ-ডে টা এক নতুন আশা দিয়েছে। অফিস শেষ করেই ক্লান্ত শরীরটাকে বুঝিয়ে পড়িয়ে, বেলেঘাটার শান্তনু স্যারের কাছে ছোটে সে। বাসের জানালা দিয়ে সব ক্লান্তি নামিয়ে দিয়ে যায় সি আই টি রোডের দুপাশে। ওর অদ্ভুত সুন্দর গলা, উচ্চারণ, আলাদা করেছে ওকে অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে। স্যারও পরম মমতায় নিজের মতো গড়ে নিচ্ছেন ওকে একটু একটু করে।
    ছেড়ে যাওয়া ট্রেনের হুইসল ছিন্ন করল চিন্তাসূত্র। অফিসের ছোটো মালিকের দেওয়া বিকৃত প্রস্তাব, এক ধাক্কায় স্যালারি উল্লম্ফনের প্রস্তাব, কাজের সময় কমিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব সব ভেসে গেল আলহাইয়া বিলাবল-এ। শেষদিন ক্লাসে কিছুতেই কোমল আর শুদ্ধ নিকে বাগে আনতে পারেনি সে। স্ট্যান্ডিং নোটের পাও মাঝে মাঝেই ঢলে পরেছে মা-এর কোলে। আরোহণের সময় যদি বা লেগেছে, অবরোহণের সময় কিছুতেই দীপান্বিতা ছুঁতে পারছিলনা শুদ্ধ নিঅনেক বকেছেন স্যার। কিন্তু! কিন্তু, শুধু দীপান্বিতাই জানে এই নিশব্দটি বারবার অপদস্থ করেছে তাঁকে। ভেঙ্গেছে স্বপ্নের মিনার। পারিনি, করিনি, হয়নিবারবার পিছু টেনে ধরেছে তাঁর চলার পথ। এক মুহূর্তে মনে পরে গেলো বাবার বন্ধ হয়ে যাওয়া বিখ্যাত মিলের নামটার শেষেও সেই নি, বেলঘরিয়ার বিখ্যাত – ‘মোহিনী মিল শুদ্ধ আর কোমলের ফাঁকটা তাই চিরকাল অস্পষ্ট থেকেছে ওর কাছে। ওর সব নি-ই নেতিবাচক।
    টালা স্টেশন থেকে ওদের বাড়ি হাঁটা পথে বেশ খানিকটা। স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে এসে ডানদিকে উঠে আসতে হয় হেমন্ত সেতুর দিকে। তারপর বি টি রোড বরাবর খানিকটা এগিয়ে বাঁদিকের খাল পার ধরে যেতে হয় আরো প্রায় পনের মিনিট। জায়গাটা সন্ধ্যের পর থেকেই এড়িয়ে চলে সাধারণ মানুষ। খাল ধারে সার সার পার্ক করা লড়ি মৃত জন্তুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে এক পাশেমাঝে মাঝে দু-একটা ঝুপড়ি। পিছনে বয়ে চলা খালের নিকষ কালো জল অন্ধকারকে আরও আরও গাঢ় করে তোলে। ঝুপড়িগুলোতে কে বা কারা থাকে, তা নিয়ে কখনো আগ্রহ তৈরি হয়নি দীপান্বিতার মনে। ছোটবেলা থেকে শুধু জেনেছে, এ জায়গাটা ভালো নয়। এই ফাঁকা জায়গাটায় এলেই জোরে জোরে সুর ভাজতে শুরু করে সে। নিজেকে নিজের সাথে নিয়ে হেঁটে যায় সুরের পথে। ও অনুভব করতে পারে, সমস্ত কালোয় হালকা একটা আলো জ্বলে। সুরের ঝর্নায় সমস্ত নৈশব্দ আর ভয় পিছলে পরে বয়ে যায় খালের জলে।
    আজ স্টেশন থেকে ডানদিকে উঠে আসতেই হালকা বৃষ্টি এলোথেমেও গেল। বৃষ্টির খুনসুটিতে রাস্তার কুকুরগুলোও আজ অন্য কোনো আশ্রয়ে। অন্যদিন একটা লাল রঙের কুকুর ওকে নিশ্চুপে এগিয়ে দিয়ে আসে খাল পার অবধি। দীপান্বিতা বুঝল, আজ তাঁকে একাই পার করতে হবে এই বিজন রাস্তা। সামনে বি টি রোডটা দেখতে পেয়েই একটু জোড়েই চেঁচিয়ে উঠল দীপান্বিতা- আজ নিষাদের পালা। আজ তোমায় ছারছিনা নি। আজ তোমায় নিয়ে পার হব এই নিকষ কালো অন্ধকার। হঠাৎ বৃষ্টি এলো জোরে। দুরের দোকানের আলোটা এতটাই দূরে যে, সেখানে পৌছতে গেলে সবটা ভিজে একশা হয়ে যাবে। ব্যাগে ছাতা নেই। কাল সকালে আবার আটটা পঞ্চান্ন-র ডাউন নৈহাটি লোকাল। যদি জ্বর আসে? ছোটবাবুর...............! আগা-পাশ-তলা ভাবতে ভাবতেই দুটো পার্ক করা লড়ির মাঝে আশ্রয় নিলো দীপান্বিতা। বাড়তে লাগল বৃষ্টির তোড়। আরও একটু ভিতর দিকে সরে এলো দীপান্বিতা।
    হঠাৎ মৃত অফিস পাড়ার গন্ধটা নাকে এলো দীপান্বিতার। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চারটে বলিষ্ঠ হাত জাপটে ধরল তাঁকে। মৃত সরীসৃপের মতো পরে থাকা একটা লড়ি হঠাৎই যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। ফাঁক হয়ে গেল ড্রাইভারস কেবিনের দরজা। চারটে হাত একপ্রকার পাঁজাকোলে করে তাঁকে চালান করে দিল কেবিনের ভিতরে। শরীরটাকে যেন ছিঁড়ে নিতে চাইছে বীভৎস ক্ষুধার্ত হায়নার দল। সমস্ত চিৎকার বৃষ্টির সাথে দলা পাকিয়ে আছড়ে পড়তে থাকল কালো পিচে। বয়ে যেতে থাকলো খালের আরো কালো জলের দিকে।
    সমস্ত প্রতিরোধ শেষ হয়ে আসছে দীপান্বিতার। চোখের সামনে ভেসে উঠছে বাবা, মা, অফিসের ছোটবাবু, বাগবাজার স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে দাঁড়িয়ে থাকা এক জোড়া বোকা বোকা চোখ, গানের স্যার.........। হঠাৎ! প্রচণ্ড চিৎকারে একজন কেবিন থেকে ছিটকে পড়ল বাইরে। মুহূর্তটা বোধগম্য হওয়ার আগেই ঝলসে ওঠা বিদ্যুতের আলোয় আর একজনের মাথা থেকে গলগল করে রক্ত বেড়তে দেখতে পেল দীপান্বিতা। কয়েক সেকেন্ড অস্পষ্ট গোঙ্গানি, জল পাড়িয়ে ছুটে যাওয়ার শব্দ, আর তারপর, সব শান্ত। খেয়ালী বৃষ্টিও যেন একদম থেমে গেল কারো এক গোপন নির্দেশে। সময় নষ্ট না করে প্রায় সিটের নিচে সেঁধিয়ে যাওয়া শরীরটা ওপরে টেনে তুলল দীপান্বিতা। গাছের পাতার ছলকে পরা চাঁদের আলোয় সে দেখল, লড়ির সামনে রক্ত মাখা হাঁসুয়া হাতে এক এলোকেশী নারী মূর্তি।
    চাওয়া-পাওয়ার হিসেবটা নিজের হাতে কষতে শেখার সাথে সাথেই ভূত বা ভগবানের প্রতি বিশ্বাসটুকু সযত্নে ট্র্যাঙ্কে তুলে রেখেছিল দীপান্বিতা। কিন্তু সামনে যা দেখছে তা কি? কে এই নারী মূর্তি? দীপান্বিতা অবাক বিস্ময়ে শুধু তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে। আসতে আসতে তাঁর দিকে এগিয়ে এলো সে। হাত বাড়িয়ে দিল তাঁর দিকে। এ হাতে বরাভয়। এ হাতে বিশ্বাস। নিজের হাতও বাড়িয়ে দিল দীপান্বিতা। বেড়িয়ে এলো দুঃস্বপ্নের সেই সরীসৃপের জ্বলন্ত জঠর থেকে। আস্তে আস্তে তাঁর হাত ধরে পাশের একটা বস্তিতে ঢুকে এলো দীপান্বিতা। এগিয়ে দেওয়া জলের গ্লাসের সবটুকু এক নিঃশ্বাসে শেষ করে এক দমকায় নিভিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল ভিতরের ঘৃণার আগুন। মৃদু স্বরে মুখ খুললেন সেই নারী। ম্যাঁ মুন্নীবাঈ। খাল পাড় কি সবহি লড়ি ড্রাইভার আওড় খালাসী জানতে হ্যায় মুঝে ইসি নাম সে। ইসহি নাম সে জানতে হ্যায় পুলিশ আউট-পোস্ট ভি। প্রতিটি শব্দে দীপান্বিতা অনুভব করছিল ক্ষোভ, ঘৃণা আর জিঘাংসার কোরাস। প্রতিটি শব্দে অসম্ভব স্পর্ধা আর আত্মবিশ্বাস। একটু থেমে আবার শুরু করল মুন্নীবাঈ – “হাম হার দিন আপকো ইহা সে গুজারতে দেখতে হ্যায় বহিন, তুম যো গাতে হো, বো মেরে দিল তক্‌ ফারাক সে পউছতি হ্যায়। তুম অ্যাঁয়সি হি গাতে র‍্যাহেনা ব্যাহেনা। কিসিকো হিম্মত নেহী কে তুমহে ইহা আঁখ উঠাকে দ্যেখে। কাল সে হাম খুদ খাঁড়ে র‍্যাহেঙ্গে মোড় পে। ম্যাঁ আচ্ছি অউরত তো হু নেহী, পর যো ভি হু, তুমহে ব্যাহেন মানা। তুম ঘর যাও
    বাইরে পা রাখল দীপান্বিতা। দূরের দকানের এফ এম তরঙ্গে ভেসে আসছে আলহাইয়া বিলাবল, হয়নি, করিনি, পারিনি............ মুন্নী.........নাঃ! কোমল নিআর শুদ্ধ নি-এর ফারাকটা খুঁজে পেয়েছে দীপান্বিতা, দূর থেকে ভেসে আসছে বিলাবলের সুরের মূর্ছনা...... “অঞ্জলি লহ মোর, সঙ্গীতে......। ধরে ফেলেছে দীপান্বিতা। ধরে ফেলেছে নি। এবার পা-এর পালা। পা তো তাঁকে সঠিক ভাবে ফেলতেই হবে। আরোহণ আর অবরোহণ নিজের দখলে নেবে সে। বিস্তার করবে নিজের মতো। এ জার্নি তাঁর।
    ছোটবাবুর উত্তরটা আগামীকালের জন্য তুলে রাখল দীপান্বিতা। এখন বাড়ি অবধি রাস্তার প্রতিটি স্টেপে ...... সা রে গা পা । ধা ণি ধা পা । মা্‌ গা রে । গা পা ধা নি সা............... কবন বাটারিয়া ........ গ্যাইলো মাঈ............ আলহাইয়া বিলাবল.........।।