গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৮

অঞ্জন সরকার

কেলো


পঞ্চমী এসে গেল,এখনও দরজি থেকে নতুন কাল জিনসটা পাইনি । মন খারাপ।  
ষষ্টির দিন পাড়ার পুজোর কিছু প্রসাদ দেওয়ার কাগজের প্লেট, শালপাতার থালা, ফল, ফুলের মালা  আর কিছু ফুলও ইত্যাদি কেনার ছিল। মেয়েরা রাত থেকেই লেগে যাবে ফল ধুয়ে কেটে প্রসাদের জন্যে তৈরি রাখতে। সারাদিন  বেরিয়ে গেল বাজার নিয়ে আসতে। 
সপ্তমীর দিন বাবা মায়ের দেওয়া কাজ করা পাঞ্জাবী পাজামা পরেই বেরলাম। প্যান্ডেলে ঢোকার মুখেই প্যাঁক খেয়ে গেলাম। 
       
পাজামাটার বদলে ধুতি পরলেই, সপ্তমীতেই সাত পাক হয়ে যেত রে!
আড় চোখে দেখে বুঝলাম পাড়ারই, আমার ক্লাসেরই তিন চারটে মেয়ে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে। ডেঁপো যত। মেজাজ ব্যোমকে গেল। মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, “ দাঁড়া! জমিদারটা হয়ে নি! সবকটাকেই বিবি-মহলে নিয়ে নেবো।”
ওদের হাঁসি আরও বেড়ে গেল, “ একটাকেই জোগাড় করে দেখা।” ইয়ার্কি পাত্তা না দিয়ে বন্ধুদের আড্ডায় চলে গেলাম।
সত্যিই তো, আলোক, বরুণ, মনোজ, পার্থ সকলেই কাউকে না কাউকে লটকে নিয়েছে। কিছু একটা করতে হবে। 
সন্ধ্যের সময় দরজির কাছে গিয়ে জিনস পেলাম না। সেই টেনশন। একটা নেভি ব্লু টি শার্ট কাকা পাঠিয়েছে বিদেশ থেকে। অষ্টমীর আরতির সময় সবাই চরম সাজের বাহার দেখায়। অষ্টমীর রাতে একবার কিছুক্ষণের জন্যে পরতেই হবে। আর বিজয়া দশমীর শেষ ছুটির দিনে সব বন্ধু ও বান্ধবীরা এক সঙ্গে চাইনিস খেতে যাওয়ার প্ল্যান আছে। 
অষ্টমীর সকালে জিনসটা পাওয়া গেল। মনে কিছুটা আশার সঞ্চার।এবার কিছু একটা চেষ্টা করা যেতে পারে। অঞ্জলির সময় ফুল দেওয়া নেওয়া দিয়ে শুরু করা যেতে পারে, হাত ধরে প্রথম পাঠ। ক্লাসের মেয়েগুলো ফুল দিচ্ছে মন্ত্র পড়ার আগে। আমি ফুল চাইতেই, বেশ ইঙ্গিত-পূর্ণ দৃষ্টিতে নমিতা আস্তে বলল, “মন দিয়ে মায়ের থেকে চেয়ে দেখ কি পাস!” হাতের ছোঁয়াটা ভাল করে উপলব্ধি করার আগেই পন্ডিতমশাই মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করে দিলেন।
সন্ধ্যের সময় মণ্ডপের সামনে অনেকটা জায়গা খালি করা হয়েছে ঢাকিদের নাচের জন্য। কালো জিনসে, কেলে কার্তিক সেজে মণ্ডপের সামনে, দাঁড়িয়ে আছি।আমরা, কিছু ছেলেরা ধুনুচি নিয়ে ঢাকিদের মাঝেই নাচতে নেমে পড়ি। ঢাকিরা বাজাতে শুরু করে দিয়েছে। আমার পেছন থেকে চেনা গলা।“এই! আমিও নাচতে পারি?” নমিতা, পেছনে দাঁড়িয়ে। বললাম, “হাতে গরম লাগবে।” বলল “ পুনেতে আমার দিদিরা তো নাচে!” মনে হোল একটা সুযোগ আসছে। ধুনুচি ধরার প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে কিছুক্ষণ হাতের স্পর্শের অনুভূতি উপলব্ধি হোল। “ হাতটা ছাড়! বুঝে গেছি, পারবো।” সম্বিৎ ফিরে পেলাম। একটু পরেই আমাকে একটা ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ ছুঁড়ে দিয়ে বান্ধবীদের সাথে অদৃশ্য হয়ে গেল।
নবমীর দিনে সবাই একসঙ্গে বসে ভোগ খাচ্ছি,  নমিতা আমাকে দেখিয়ে বলল, “ওরে অত খাস না। কালকের চাইনিসের জন্যে কিছু জায়গা রাখ।” দিদি আবার আস্তে করে জিজ্ঞেস করে নিলো, “মেয়েটা কে রে!তোর ক্লাসের?” ছোট্ট ‘হুঁ’ দিয়ে চেপে গেলাম।
বিজয়া দশমীর দিনে দুপুরে চাইনিস খেতে যাওয়ার প্ল্যান। নমিতা এসে জিজ্ঞেস করে গেছে, “ আমাদের কটার সময় যাওয়া, আসছিস তো?আমি কিন্তু একটাও চাইনিস খাবারের নাম জানিনা!বলে দিস।” মনের মধ্যে যেন ‘অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে আলোর আভা’ দেখছি। আমি তখন, পুজো কমিটির বাসে, যারা ভাসান ঘাটে যেতে চায় তাদের কুপন দিয়ে নাম লিখছি।তখনই “এই যে রঞ্জন! আমার মেয়ে আর নাতনী ভাসানে যাবে। তুমি ওদের কয়েকটা ঠাকুর দেখিয়ে দিয়ো ঘাটে।এই প্রথম যাচ্ছে তো।ফেরার সময় আবার বাস না মিস করে।” মুখ তুলে দেখি স্কুলের প্রিন্সিপাল মহাদেব বোস। বাবা পেছনেই ছিলেন। “ হ্যাঁ হ্যাঁ মহাদেব বাবু! সেটুকু নিশ্চয়ই করবে!
এর চেয়ে বড় কেলো হয়??   
তাই তো গাই,
 “প্রেমের গলি কোন দিকে, হায়! কেউ আমারে দেখাইল না, 
ও ক্ষেপা মন, এ জীবনে, তোর প্রেম করা আর হইল না।”