গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৮

সুবীর কুমার রায়

সুখস্মৃতি

জীবনে চলার পথে এমন ছোট ছোট কিছু ঘটনা ঘটে, সারাটা জীবন যা মনের কোণে সুখস্মৃতি হয়ে রয়েই যায়। আমার জীবনে এরকম অনেক, অনেক ঘটনা ঘটেছে। আজও হঠাৎ কোন বিশেষ ঘটনার কথা স্মৃতি হঠাৎ করে মনে করিয়ে দিলে, খুব ভালো লাগে, দিনটা ভালো কাটে। আজ হঠাৎ এরকমই একটি পরিবারের কথা মনের কোণে ভেসে উঠলো। তাঁরা কোথায় আছেন জানি না, তবু সেই দিনের সুখস্মৃতির জন্য তাঁদের ধন্যবাদ জানানোর জন্যই এই স্মৃতিচারণা।
বিয়ের কয়েক মাস পরেই আমরা হিমাচল প্রদেশে ঘুরতে যাই। আমার এক সহকর্মী, তার স্ত্রী, আড়াই বছরের শিশু কন্যা, ও শ্যালিকাকে নিয়ে আমার সাথে ভ্রমণ সঙ্গী হিসাবে গিয়েছিল। দু-একটা জায়গা ঘুরে আমরা পালামপুরে এসে হাজির হলাম। এখনকার অবস্থা আমার সঠিক জানা নেই, কিন্তু সেই সময় পালামপুরে রাস্তার ওপরেই একটা সম্ভবত তিনতলা বড় হোটেল ছিল। সেই সময় এই হোটেলটাকেই নিরাপদ ও সুন্দর মনে হওয়ায়, আমরা সেই হোটেলে দুদিনের জন্য দুটো ঘর নিয়ে দিব্যি গুছিয়ে বসলাম। পরের দিন সকালের দিকে পাকা রাস্তা ধরে চা বাগানের মধ্যে দিয়ে অনেকটা পথ হেঁটে নিউগল্ পার্কের উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময়, জায়গাটার সৌন্দর্য দেখে অবাক হয়ে গেলাম। একসাথে হাঁটা শুরু করলেও, আমার বন্ধুটি সম্ভবত আমাদের একটু একা হাঁটার সুযোগ দেওয়ার জন্যই, ধীরে ধীরে সপরিবারে অনেকটা পথ পিছিয়ে পড়লো। অবশ্য তাদের সাথে একটা বাচ্চা ছিল, এটাও ধীরে হাঁটার একটা কারণ অবশ্যই ছিল। সে যাহোক, নিউগল্ পার্কে আমরা অনেকক্ষণ সময় শুয়ে বসে আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে হোটেলে ফিরে স্নানাহার সেরে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি, এমন সময় হোটেলের একজন কর্মচারী আমায় এসে জানালো, যে আমার একটা ফোন এসেছে। আমি একটু অবাক হয়ে বললাম যে, আমাকে এখানে কেউ চেনে না, তাছাড়া আমি যে আজ এখানে থাকবো ও এই হোটেলে উঠবো তাও কারও জানার কথা নয়, কাজেই আমায় কেউ ফোন করতে পারে না, তার নিশ্চই কোথাও কোন ভুল হচ্ছে। হনহন্ করে নীচে ফিরে যাওয়ার আগে সে শুধু জানালো, যে একজন ডাক্টার সাব আপনার রূম নাম্বার ও নাম জানিয়ে ফোনটা করেছেন, নীচে গিয়ে ফোনটা ধরুন।
এবার  আমার ঘাবড়াবার পালা। বাড়িতে টেলিফোন নেই, অবশ্য তখন হাতেগোনা দু’-একজনের বাড়িতেই টেলিফোনের দেখা মিলতো। যে দু’-চারজন ডাক্তার আমার পরিচিত, তারা আমার অফিসেও আজ পর্যন্ত কোনদিন ফোন করেননি। তাহলে কি বাড়িতে কোন বিপদ ঘটায় কোন ডাক্তার আমায় ফোন করে জানাচ্ছেন? কিন্তু তিনিই বা এই হোটেলে আমার উপস্থিতি, এমনকী আমার রূম নাম্বার জানবেন কিভাবে। নীচে যাওয়ার সময় পাশের ঘরে বন্ধুকে ডাকতে গিয়ে শুনলাম, যে সে সম্ভবত সিগারেট কিনতে বেড়িয়েছে। অগত্যা একা একাই নীচে গিয়ে রিসেপশনে ফোনটা ধরলাম। অপর প্রান্ত থেকে এক পুরুষ কন্ঠ আমায় আমার নাম উল্লেখ করে জানালেন, যে তিনি ডক্টর অআকখ (এতবছর পরে আর তাঁর নাম মনে নেই) বলছেন। আমি তাঁকে জানালাম যে তাঁর বোধহয় কোথাও কোন ভুল হচ্ছে। কারণ এখানে, এই পালামপুরে আমি গতকালই এসেছি, এবং এখানে আমার কোন পরিচিত ব্যক্তিও বসবাস করেন না। উত্তরে তিনি শুধু বললেন, যে তাঁর কোন ভুল হচ্ছে না। আমি আমার বন্ধুটিকে জিজ্ঞাসা করলেই তাঁর পরিচয় পাবো। আমার বন্ধুর নাম উল্লেখ করে তিনি জানালেন, যে আজ সন্ধ্যায় যদি আমি সপরিবারে বন্ধুর পরিবারকে নিয়ে তাঁর বাসায় আসি, তাহলে তিনি খুব খুশি হবেন। সন্ধ্যায় দেখা হলে জমিয়ে আলাপ হবে জানিয়ে, সন্ধ্যার সময় তাঁর বাড়িতে যাবার জন্য আর একবার অনুরোধ জানিয়ে, তিনি ফোনটা ছেড়ে দিলেন।

সিগারেট কিনে বন্ধুটি হোটেলে ফিরলে, তাকে সব জানালাম। সে জানালো যে নিউগল্ পার্ক যাওয়ার পথে একটা ছবির মতো সুন্দর ছোট্ট বাড়িতে একজন বাঙালি ডক্টোরেট ভদ্রলোক থাকেন, যিনি সম্ভবত এখানকার কোন এনিমেল হাজবেন্ড্রী এন্ড ভেটেরিনারি সায়েন্স্ কলেজের প্রিন্সিপাল। আরও জানলাম যে যাওয়ার পথে তাঁর সাথে ওর আলাপ হয়েছিল, ভদ্রলোককে সে আমাদের কথা, আমরা এখানে কোন হোটেলে উঠেছি, কোথা থেকে এসেছি, এখান থেকে কোথায় কোথায় যাবো, ইত্যাদি সবকিছুই বলেছিলএতক্ষণে বুঝলাম, যে নিউগল্ পার্কে তাদের পৌঁছতে বিলম্ব হওয়ার তৃতীয় কারণটা কি।
যাইহোক বিকালের শেষভাগে আমরা ভদ্রলোকের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। নিউগল্ পার্ক যাওয়ার পথে, পার্ক থেকে অনেকটা পথ আগে, রাস্তার ডানদিকে সত্যিই একটা ছবির মতো সুন্দর ছোট্ট বাড়ি। বাড়ির সামনে ফুলগাছে সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটে আছে। বার দু’-তিন কলিং বেল বাজানোর পরে দুটো ফুলের মতো সুন্দর বাচ্চা দরজা খুলে আমাদের দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ছেলেটা বড়, বছর আষ্টেক বয়স, মেয়েটা বছর দুয়েকের ছোট। বাবাকে ডেকে দিতে বললে তারা নিজেদের মধ্যে চোখ চাওয়াচাওয়ি করে জানালো, বাবা বাড়ি নেই। বাধ্য হয়ে মাকে ডেকে দিতে বললে, তারা মাম্মি মাম্মি করে  চিৎকার শুরু করে দিলো। তাদের ডাকাডাকিতে বাচ্চা দুটোর মা এসে আমাদের সোয়া পাঁচজনের বিরাট অচেনা দলটাকে দেখে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কাকে চাই”? সর্বনাশ, আমাদের অত দূর থেকে ডেকে এনে এ কি রসিকতা! আমার বন্ধুটি আমাদের আসার কারণ জানাতে ভদ্রমহিলা আমাদের বসার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। কিছুক্ষণ কথাবার্তায় বুঝে গেলাম, ভদ্রলোক আমাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও তাঁর বাড়িতে আমাদের আসার অমন্ত্রণের কথা স্ত্রীকে বলতে সম্ভবত ভুলে গেছেন। আমরা চা খেয়ে আরও কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে কেটে পড়ার ধান্দা করছি, এমন সময় ভদ্রলোক এসে হাজির হলেন। জানা গেল কি একটা কাজে গিয়ে তিনি আটকে গেছিলেন।
ভদ্রলোক আমাদের পাশে বসে জমিয়ে নানারকম গল্প শুরু করলেন। বুঝলাম ভদ্রলোক কথা বলতে বেশ  ভালবাসেন। তাঁর হাতে ও পায়ের পাতার বিভিন্ন জায়গায় দেখলাম  লাল লাল রঙের ছোপ। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, খরগোশের কামড়ের জন্য মারকিউরোক্রম লাগিয়েছেন। ওষুধ লাগিয়েছেন বেশ করেছেন, তা বলে সারা হাতে পায়ে? উনিই জানালেন, যে তাঁর অস্ট্রেলিয়া না কোথাকার যেন খরগোশের একটা ছোট্ট ফার্ম আছে। এই প্রজাতির খরগোশের লোম থেকে অত্যন্ত মূল্যবান উল তৈরি হয়। সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে নাকি সেই উল। ওই খরগোশগুলো ভীষণ কামড়ায়, এবং তাদের কামড়ের জন্যই, এতো জায়গায় ওষুধ লাগাবার প্রয়োজন হয়েছে। শুনলাম ভদ্রলোক দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন এবং বিদেশ থেকেই তিনি দু’-দুবার ডক্টোরেট করেছেন। তিনি জানালেন, যে এখানকার মানুষের বিশ্বাস যে এই অঞ্চলে মাছ চাষ করা সম্ভব নয়। তিনি কিন্তু মাছ চাষ করে দেখিয়েছেন, যে এখানেও মাছ চাষ সম্ভব। হিমাচলে ব্যবসা করতে গেলে হিমাচলের একজন মানুষকে পার্টনার হিসাবে নিতে হবে, না এরকম কি একটা নিয়ম আছে। তিনি বোধহয় সে ব্যবস্থাও করে ফেলেছেন। ইতিমধ্যে একপ্রস্ত চা জলখাবারের আয়োজনও সম্পন্ন হয়ে গেছে।
ওনার স্ত্রী জানালেন যে তাঁর বাপের বাড়ি কলকাতার গরচায়। দীর্ঘদিন এই ফাঁকা জায়গায় থেকে থেকে ওনার স্বামীর কলকাতার রাস্তাঘাট ও যানবাহনের ভীড়ভাট্টার ওপর একটা আতঙ্ক এসে যাওয়ায়, তিনি সহজে আর কলকাতামুখো হন না, ফলে তাঁরও বাপের বাড়ি বিশেষ যাওয়া হয়ে ওঠে না। প্রসঙ্গক্রমে আমি বললাম যে গরচায় আমি অনেকবার গিয়েছি, কারণ আমার এক আত্মীয় দীর্ঘদিন গরচায় বসবাস করেন। আমার কথা শুনে ভদ্রমহিলা জানতে চাইলেন, যে আমার সেই আত্মীয় গরচার কোথায় থাকেন। রাস্তার নাম উল্লেখ করতেই তিনি জানালেন, যে তাঁর বাড়িও গরচার ওই একই রাস্তায়। বাড়ির নম্বর জানতে চাওয়ায় তাঁকে বাড়ির নম্বর বলতেই, তিনি উল্লাসিত হয়ে জানালেন, যে তিনিও ওই একই বাড়ির বাসিন্দা। সত্যি কি অদ্ভুত যোগাযোগ। এবার তিনি আমার আত্মীয়র নাম জিজ্ঞাসা করলেন। শিবপুর বি.. কলেজ থেকে পাস করা, অবিবাহিত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বৃদ্ধ ভদ্রলোকের নাম শুনে তিনি হাতজোড় করে কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার করে বললেন, “শচীন কাকা আপনার আত্মীয়? উনি আপনার কে হন? আমার জীবনে লেখাপড়া শিখে বড় হওয়ার পিছনে সমস্ত অবদান ওনার। জিওগ্রাফি ভালবাসলেও ওই সাবজেক্টটার ওপর একটা ভীতি আমার ছিলই। উনি আমায় জিওগ্রাফি বুঝিয়ে দেওয়া শুধু নয়, আমি জিওগ্রাফিতে মাস্টার্স করার সময়, উনি আমার সমস্ত নোট তৈরি করে দেন। এবার আমার বিষ্মিত হবার পালা। অবাক হয়ে তাঁকে বললাম,“উনি সম্পর্কে আমার দাদু হন, লেখাপড়ায় উনি খুবই ভালো ছিলেন শুনেছি, কিন্তু উনি তো সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, উনি আপনাকে জিওগ্রাফির নোট কিভাবে তৈরি করে দিতেন বুঝলাম না উত্তরে ভদ্রমহিলা জানালেন যে উনি যতটা সময় পেতেন, নোট তৈরি করে দেওয়ার জন্য আমার জিওগ্রাফির বইপত্র পড়তেন। পরবর্তীকালে আমি আমার ওই দাদুর কাছ থেকে শুনেছিলাম, যে তিনি ওই ভদ্রমহিলাকে জন্মাতে দেখেছেন। পড়াশোনায় খুব ভালো হলেও, জিওগ্রাফির প্রতি ভীতিতে মাস্টার্স পড়া ছেড়ে দেবার উপক্রম হওয়ায়, তিনি তাঁকে সাহায্য করেন। অবশ্য এর জন্য তাঁকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছিল।
যাইহোক এইসব নিয়ে আড্ডা আলোচনায় বেশ একটু রাতই হয়ে গেছিল। এবার আমরা হোটেলে ফেরার জন্য উঠে দাঁড়াতেই, ভদ্রলোক হঠাৎ বললেন এখন হোটেলে ফিরে গিয়ে রাতের খাবার না খেয়ে, এখানে দুটো ডাল ভাত খেয়ে গেলে হতো না”? এক মুহুর্ত সময় অপচয় না করে আমি সরাসরি বললাম, “এই কথাটা   শুনবার জন্য আমি অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে ছিলাম। কয়েকদিন ধরে লাউকি, আলু গবি, আর আলু মটর খেয়ে খেয়ে জিভে চড়া পড়ে গেছেআমার কথায় ভদ্রলোক হেসে ফেলে বললেন, এতো লজ্জা পেলে চলে? তিনি তাঁর স্ত্রীকে চটপট্ কিছু আয়োজন করে ফেলতে বললেন। আমিও আমাদের সঙ্গের তিনজন মহিলাকে ওনাকে একটু সাহায্য করতে বললাম।
অল্প সময়ের মধ্যেই খানা প্রস্তুত। খুব সুন্দর কি একটা চালের গরম ভাত, সুন্দর ঘি, ডাল, আলু চোখা, বেগুন ভাজা, আর ভদ্রলোকের চাষের সেই বাটা মাছের মতো দেখতে, কি একটা মাছ ভাজা। আহা ঠিক যেন অমৃত খেলাম। ভদ্রলোক অবশ্য একটু দুঃখ করেই বললেন যে এতো রাতে ভালো কিছু জোগাড় করা মুশকিল,  আপনাদের হয়তো খেতে একটু কষ্টই হলোআমরা জানালাম, যে বেশ কয়েকদিন পরে বাঙালি খানায় যেন অমৃতের স্বাদ পেলাম।
এবার ওঠার পালা। ভদ্রলোক বললেন এই পথে রাত হলেও কোন ভয় নেই। নিশ্চিন্তে চলে যান, কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে, আমার নাম বলবেন আর হোটেলে পৌঁছে আমায় একটা ফোন করে জানাবেনধীরে ধীরে একসময় আমরা হোটেলে ফিরে এসে তাঁকে আমাদের পৌঁছানো সংবাদ জানালাম।  
এবার আপনারাই বলুন, এই দিনটাকে কি ভোলা যায়? প্রার্থনা করি ওনারা যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন।