গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৮

অরুণিমা চৌধুরী

মন জানালা খুলে দে না

তখন সেজোদিদার কাছে থাকতুম। সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে তুলিয়ে মা দিদার জিম্মায় দিয়েই ছুটতো বাস ধরতে। আর আমি বগলে চারটি এবিসিডির প্লাস্টিক ছাঁচ, বই টই কিছু একটা, একটা ইজের অতিরিক্ত- নিয়ে ঢুকে পড়তুম দুকামরার ব্যারাক বাড়িটায়। বাড়িটার বারান্দায় গোল লোহার পাইপ, দুহাতে ধরে ঘুরেঘুরে দোল খাওয়া যায় বেশ, অবশ্য দিদার নজরে এলেই বকবে অতএব সবটাই চুপিচুপি। নীলুমাসি, শিলুমাসি, ইলুমাসি সব্বাই ঘুম থেকে উঠে পড়লেও নিপুমামার তখনো ঘুম ভাঙেনি। ঘুম ভাঙলে তবে চা হবে। আর তাইতে আমার খুব লোভ। কেন! না, দিদা নোনতা বিস্কুট দেবে, যত দেবে আমি সওব চায়ে ডুবিয়ে দেবো। খাবো না। বলবো, "আরো বিস্কুট দাও!" তারপর সবটা চায়ে ভিজে, বিস্কুট কাদাকাদা হয়ে, আমার ছোট্ট কাপ উপচে উঠলেই চামচ চাইব। কি আরাম চায়ে ভেজানো বিস্কুট খেতে! তারপর মাসিরা বই খুলে বসলে আমিও আমার সম্বল খুলে বসবো। মাসিরা খবরদারি করবে আমার উপর। আমি কিন্তু অপেক্ষায়, কখন ইস্কুলের রিক্সা আসবে ওরা বেরিয়ে পড়লেই আমি চৌকির নীচ থেকে ইলুমাসির পুতুলের বাক্স হাঁটকাব।
এমনি করে সকাল কিছুটা পাতলা হবে, দিদা রান্নাঘরে চাল ভিজিয়ে বারান্দায় আসবে। আমি ঠিক ফাঁকতালে গিয়ে ভেজা চালের ভিতর মুঠো ডুবিয়ে খলবল করব। আমার কি যে ভালো লাগতো চাল খাবলাতে! অথচ এখন রোজই চাল ধুচ্ছি, রান্না করছি, সেই অনুভূতি নেই তো!
সে যাইহোক, সেজোদাদুর বাড়িতে থাকত আরেক দিদা,মায়ের এক সম্পর্কিত বালবিধবা পিসি, যাকে আমরা ডাকতুম "কোদাল দিদা" বলে। অমন সুন্দরী, ফর্সা, ছেলেদের মতো করে চুল কাটা, কোমর পড়া মানুষটিকে কেন যে আমরা ভাইবোনেরা সবাই "কোদালদিদা" বলেই ডাকতুম,তার কোন হদিশ আজ আর দিতে পারব না।
কোদাল দিদা নিরামিষাশী, বারান্দায় এইটুকু একটা পিঁড়ি পেতে সবজি কাটতো। এমনিতে ভালোই, কিন্তু আমি তাকে এড়িয়ে চলতুম। কেন না কোদাল দিদার ভারী ছড়াকাটার অভ্যেস। আমায় দেখলেই তার প্যারোডি করার ঝোঁক( এখন প্যারোডি বুঝলেও, তখন কি ছাই বুঝতুম!) দিদা সুর করে গাইতো, "অমিতার বর এসেছে ল্যাংটা লো ল্যাংটা, অমিতা মাথায় দেলো ঘোমটা "..
এর পিছনের গল্পটি একটু জানা দরকার, আমাদের পাড়ায় একটি পাগল আসতো। হাঁটতে পারতো না, পাছু ছেঁচড়ে রাস্তা দিয়ে যেতো। কাউকে মারাকোটা করেনি কখনো। গরমের দিনে আম কাটলে,প্রায়ই মা আমার হাত দিয়ে তাকে আম পাঠাতো। তাতেই সবাই আমায় ক্ষেপাতো, আমি রাধুপাগলাকে বিয়ে করব। বলা বাহুল্য, পাছু ছেঁচড়ে চলার কারণে রাধুর প্যান্ট ছিল ছেঁড়া।
 
এবার বলুন, ছোট বলে আমার কি একটা মান সম্মান নেই! খুব রাগ হতো কোদালদিদার উপর।
তবে সে বুড়ির অনেক গুণ, অবসরে পুরনো কাপড়ের পাড় থেকে সুতো খুলে এমন সুন্দর নক্সি কাঁথা সেলাই করতে আর কাউকে দেখিনি।
বেলা আরেকটু গড়ালে, মাসিরা আমায় নিয়ে খেতে বসতো। সেই ছোট্ট রান্নাঘরেই সেজোদিদার উনুন একদিকে, আরেকদিকে সার বেঁধে নীলুমাসি, শিলুমাসি ইলুমাসি আর আমি। আমি তখন কোদালদিদার পিঁড়িটি কায়দা করে দখল করেছি।
এইবার খেতে বসে আমার অনেক শিক্ষেদীক্ষে হতো। শিলুমাসি যা শেখাবে, ইলুমাসি ঠিক তার উল্টো কথা কইবে। এই যেমন খেতে বসে আমি ছোট মানুষ, থালার বাইরে ভাত ছড়াতুম ঢের। শিলুমাসি হয়ত বল্লো, "ভাত কুড়িয়ে নে, নষ্ট করতে নেই। " আমিও লক্ষ্মী মেয়ের মতো যেই না কুড়িয়ে নিয়ে খেতে যাব, অমনি ইলুমাসি হাতে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে বলবে, 'মাটির থেকে কুড়িয়ে খাচ্ছিস, পেট ব্যথা করবে না!"দিদা বলতো, " অমন জিভ বের করে, হাঁ করে খেতে নেই, বিয়ে হলে লোকে নিন্দে করবে"... তখন বুঝিনি, এখন বুঝি, বিয়ে ব্যাপারটা শিলুমাসি ইলুমাসির দ্বন্দ্বের মতো, যাই করো জিভ নাড়াও বা নাই নাড়াও, দোষের। এই দ্যাখো! আবার অফ দ্য ট্র‍্যাক কইতে বসে গেছি..
মাসিরা যেদিন ইস্কুলে যেতো,সেদিন তো যেতোই, তারপর সেজোদিদার মাথায় ছোট ছোট হাতে তেল থাবড়ে বাচ্চা মতো ত্যাড়াবেঁকা একটা বিনুনি বেঁধে দিতুম। দিদা চানে যাবার আগে খবরের কাগজটি মেলে বসতো। সেরকমই একদিন পাতা জুড়ে ছবি এলো উত্তম কুমার আর নেই। যেদিন মাসিরা ইস্কুল যেতো না, তিনজনেই বাড়ি থাকতো, সেদিন অবধারিত ভাবে আচার চুরি করতো। নীলুমাসি তিনজনের মধ্যে বড়, তাই কিছু দায়িত্ববোধ ছিল। তেঁতুল, কুলের আচার আমার মুখে ঢুকিয়ে বীজ গুণে রাখতে হতো তাকে। তা সত্ত্বেও আমি ও কম্মোটি করতুম। বীজটি গিলে ফেল্লেই ভয় দেখানো হতো, "পেটে গাছ হবে".. আমি পুকুরের পাড়ে ভাবতে বসতুম, তাইতো! মাথার উপর দিয়ে ডালপালা উঠছে, পা দিয়ে শিকড় নেমে যাচ্ছে, আমি মা যাব কেমন করে! মা! ব্যস! মায়ের কথা মনে পড়লেই তো কান্না গিলে কাঠ হয়ে থাকা.. মা কেন ইস্কুলে যায়! যায় যদি, আমায় কেন নেয় না! 
এমনি দুপুরের দিনে ঘুলঘুলি দিয়ে অন্ধকার ঘরে আলো আসতো, রাস্তার ধারের ব্যারাক বাড়ি, দুপুরভর তাতে লোক চলাচল করে। আর চৌকির উপর শুয়েশুয়ে তিন মাসির সঙ্গে আমি উলটো মুখো লোকের চলাচলের সিনেমা দেখি..
এখনো অবসরে সেই মানুষগুলো চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে যায়, সবাই উল্টোমুখো। আয়নায় ছায়া পড়ে। অনেকদিন চুলে কলপ করিনি। কেমো নেবার পরে আমার প্রায় সব চুল সাদা হয়ে গেছে। আর নীলুমাসি! অনেক অনেক বছর আগে যখন দেখেছি, তার বিয়েটাও দোষের হয়ে গেছে, অথচ সে কোনদিন মুখ হাঁ করে সপসপ করে ভাত খায়নি। আমার অসুন্দর নীলুমাসির সুন্দর মেসোমশাই এ বাড়িতে আসা যাওয়ায় আগল পরিয়েছেন। শিলুমাসির বাচ্চাটা সেরিব্রাল পলসিতে মাত্র সাত বছর বয়সে চলে গেছে.. কোদালদিদা তো আমার সেই ইস্কুলে ভর্তির আগের বয়েসেই নেই হয়ে গেলো। একদিন রাতে ঘুমিয়ে আর উঠলোনা। সেজোদিদার কোমর পড়ে গেছে। বাড়িটা এখনো আছে, কিন্তু স্থান সঙ্কুলান হয়নি কারো..
সময় এগিয়ে যায়,আমি পিছিয়ে আসি.. শীতকাল কবে ফুরোবে, আমার কবিতা আসেনা বড় ডিপ্রেশন হয়।