গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৮

তাপসকিরণ রায়

ধারাবাহিক হ্যান্টেড কাহিনী--৩৫

 উল্টোডাঙার রানীকুঠি রহস্য

 শশীভূষণ অনলাইনে খুঁজে পেলেন এক নতুন ভুতুড়ে জায়গার সন্ধান। উল্টোডাঙ্গার এক পড়ো বাড়ি, তার ইতিহাস হারিয়ে গেছে। সে এক মহলই বলা যায়--তার নাম রানীকুঠি। প্রায় আধ কিলোমিটার দূরত্বে এই কুঠির উত্তর দিকে রয়েছে এখানকার বার জুটমিল। রানিকুঠিতে রাতের বেলায় ঘটে যায় নানা প্যারানরমাল এক্টিবিটিস।  আনন্দবাজার পত্রিকার এক টিম এখানে এসে ভূতের অবস্থানের কথা স্বীকার করে গেছে। এ ব্যাপারে শশীভুশণ ইউ টিউবে খুঁজে পেলেন এক বিডিও। বিডিও অন করে তিনি শুনতে ও দেখতে  লাগলেন রাণীকুঠির রহস্য কথা--
‘’রানিকুঠিতে ছিল নানা রকম অত্যাচারের কাহিনী। এই কুঠিতে বহুদিন আগে নাকি এক রাজার বাস ছিল। রাজা ছিল ভীষণ অত্যাচারী ও খামখেয়ালী। সে রানীদের প্রতি ভীষণ অত্যাচার চালাত। তার মন ভোগ লালসায় পূর্ণ ছিল। রানিকুঠির পাশে ছিল এক বাইজী বাড়ি, রাজা বাইজিদের নাচ দেখত, হোই হুল্লোড় করত। কোন কোন বাঈজীর ওপর একঘেয়েমি এসে গেলে  রাজা তাকে হত্যা করে সেখানেই মাটির তলায় নাকি পুঁতে রাখত। এ সব ঘটনার পর একশ বছরের বেশী কেটে গেছে। শোনা যায়, রাতের বেলায় যারা রানিকুঠির রাস্তার আশপাশে যাতায়াত করে তারা নানা রকম শব্দ শুনতে পায়। এখানে আমাবস্যার গভীর রাতে নাকি এই বাইজী বাড়িতে জলসার মত গান নাচ আনন্দ উৎসব বসে। জায়গাটা যেন আবার জেগে ওঠে। এ জায়গায় নাকি রাতে কোথাও ঠাণ্ডা, আবার কোথাও গরম অনুভূত হয়। এই জঙ্গল দিয়ে কখনও কেউ হেঁটে গেলে শুনতে পায়, কেউ যেন ডেকে বলছে, বাবু এদিকে একটু শুনে যান--কেও যেন পাশ কাটিয়ে চলে যায়, কাউকেই দেখতে পাওয়া যায় না। আবার কখনও মনে হবে কুঠির কোন ঘরে আলো জ্বলছে, সেখানে গেলে আপনি কিছুই দেখতে বা শুনতে পাবেন না।  এক সময় ক্ষীণ ঝুমুরের শব্দ আপনি শুনতে পাবেন। চারদিকে তখন অন্ধকার অলৌকিকতার মাঝে কিছু যেন জেগে উঠেছে ! সাবধান--এখানে অনেক সাপের উপদ্রব রয়েছে, অসাবধানে অঘটন ঘটে যেতেই  পারে। নানান প্যারানরমাল এক্টিভিটিজ গ্রুপও এখানে এসে তাদের মেশিন ইনস্ট্রুমেন্টস দিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেছেন। তাঁদের মতে, এখানে আছে কিছু এবনরমাল এক্টিভিটিস।’’
শশিভূষণ উল্টোডাঙা যাওয়ার ব্যাপারটা একরকম ঠিকই করে ফেললেন। জাগাটা বেশী দূরে না। তিন বন্ধু মিলে  ঠিক করলেন তাঁরা নিজেদের কারেই সেখানে যাবেন। শশীভূষণ ও তাঁর বন্ধুদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় এমনি--শশীভূষণ অকৃতদার। অর্ণব বিপত্নীক আর জনান্তিকের স্ত্রী আছেন কিন্তু ছেলেপুলে না হওয়ায় সংসার নিয়ে তিনি তত জড়িয়ে পড়েননি। কাজেই একমাত্র তাঁদের দ্বারাই সম্ভব এ ধরনের মিস্টিরিয়াস ঘটনার পেছনে ছুটে ফেরা। ওঁরা প্রত্যেকে কলকাতায় থাকেন, ওঁদের নিজস্ব পেশা থাকা সত্যেও নেশা হিসাবে এই কাজটা তাঁরা মাঝে মাঝেই চালিয়ে যান।
রাত নটার দিকে শশীভূষণ দুই বন্ধুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন উল্টোডাঙার রানীকুঠির দিকে। রাস্তায় তখনও অল্প বিস্তর জ্যাম হয়ে আছে তবু আধ ঘণ্টার ভেতরেই ওরা উল্টোডাঙ্গাতে পৌঁছে গেলেন। খুঁজে খুঁজে জুটমিল পেতে তাঁদের দেরি হল না। এখানে কিছু লোকের যাতায়াত দেখতে পাওয়া গেল। এক জনকে শশী বাবু সামনের রাস্তার দিক থেকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা বলতে পারেন,এটাই তো বার জুটমিল ?
--হ্যাঁ, তবে জুটমিল অনেকদিন বন্ধ আছে, লোকটা বললেন।   
শশীভূষণ আবার জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা আপনি কি এখানকার রানীকুঠি কোথায় আছে বলতে পারেন ?
লোকটা মনে হল শুরুতে চট করে বুঝে উঠতে পারলেন না,তারপর হঠাৎ তাঁর মনে পড়াতে বলে উঠলেন, ও মানে সে তো পরিত্যক্ত দালানকোঠা, তাও বেশ জঙ্গলের মধ্যে আছে।  
জনান্তিক এবার বললেন, হ্যাঁ আমরা সেটারই খোঁজ করছি।
--সেটার--! আশ্চর্য বোধক প্রশ্ন টেনে লোকটা বললেন। লোকটা এবার শশীবাবুর কাছে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর কৌতূহল যেন আরও বেড়ে গেল, রানিকুঠি দিয়ে আপনারা কি করবেন ? লোকটা ভয়ের গলা নিয়ে বলে উঠলেন।
শশী এবার সামান্য ভূমিকা সহযোগে ওদের এমনি আসার উদ্দেশ্যর কথা লোকটাকে বললেন। লোকটাকে বেশ সাহসী ও কৌতূহলী বলেই মনে হল। তিনি হঠাৎ প্রস্তাব করে বসলেন,আমারও আপনাদের মত প্রবল ইচ্ছে ছিল--যদি বলেন--আমি কি আপনাদের সঙ্গে যেতে পারি ?
অর্ণব বলে ওঠেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমাদের কোন আপত্তি নেই, দল একটু ভারী হলে অসুবিধাটা কি ?
জনান্তিক ফিসফিসিয়ে শশীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে উঠলেন, আবার জীবনের কোন রিক্স থাকবে না ত?
লোকটার কান অব্দি কথাগুলি হঠাৎ পৌঁছে গেল, তাই তিনি বলে উঠলেন, না না, এমন ধরনের ঘটনার সাক্ষী আমি আগেও থেকেছি।
এবার ওরা চারজন শশীভূষণের কারে গিয়ে বসলেন। এখানে ড্রাইভার শশীভূষণ স্বয়ং আর তার পাশে নতুন লোকটা বসেছেন। পেছনে অর্ণব ও জনান্তিক বসেছেন।
মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে ওরা রানীকুঠির ধারে কাছে গিয়ে পৌঁছে গেলেন। লোকটা বললেন, এখানে নামতে হবে,জঙ্গলের ভেতরে গাড়ি যাবে না, তবে একেবারে ঘন জঙ্গল নয়, দু-একজন মানুষ এক সাথে চলাফেরা করার মত পথ আছে।
অর্ণব বললেন, শুনেছি, এখানে অনেক সাপ আছে !
লোকটা বললেন, হ্যাঁ, আছে ত--
শশী তার পকেট থেকে মোবাইল বের করে জঙ্গলের সরু পথে টর্চ ধরতে লাগলেন। সবাই ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছেন। সঙ্গের লোকটা বেশ সাহসী আছেন বোঝা যাচ্ছে। তিনি আগে আগে হাঁটছেন। তিনি নাকি আগেও দু- একবার এই রানীকুঠিতে ঘুরে গেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, ঘন অন্ধকারের মাঝে এখানে একটাও জোনাকি নেই।  কিংবা ঝিঁঝিঁ পোকার ঝিঁঝিঁ রবও আসছে না। হঠাৎ সবাই থমকে দাঁড়ালেন।
--আমাদের সামনে কোথাও শুকনো ডালপালা নড়েচড়ে উঠছে, লোকটা বললেন।
অর্ণব বললেন, রানীকুঠি থেকে এ শব্দ আসছে না তো?
লোকটা উত্তর দিলেন--না তো
অর্ণব বললেন, না তো বললেন, কিন্তু হতেও তো  পারে ?অর্ণব সাবধান হলেন, চারদিকের সুরক্ষা ব্যবস্থা দেখে নেবার চেষ্টা করলেন।  হ্যাঁ, তাঁর তিন দিকে সুরক্ষা আছে, অর্ণবের মনে হল, পিছন দিক থেকে চাইলে তাকে কেউ টেনে ধরে নিয়ে যেতে পারে কিন্তু না দেখার আগেই অর্ণব নিজের শরীরে কেমন একটা কাঁপুনি অনুভব করতে লাগলেন!
জনান্তিক অর্ণবকে বললেন, তুই এখনই ভয়ে কাঁপাকাঁপি শুরু করে দিলি নাকি ?
অর্ণব মুখে কোন কথা বা শব্দ উচ্চারণ করলেন না।
--রানীকুঠি ওই যে--লোকটা সামনের দিকে হাত তুলে দেখালেন।
বন্ধুরা সমান্তরালে সবাই দাঁড়িয়ে আছেন। সামনে অস্পষ্ট ছায়ার ভেতর ছাইরঙা ধোঁয়াশা মত দীর্ঘ প্রাসাদ দেখা যাচ্ছে।বিশাল তার দ্বার ও গম্বুজ দেখা যাচ্ছে। দরজার কোন পাট নেই। দেওয়াল ভাংচুর হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আছে।
দীর্ঘ দরজা-জানালাহীন প্রাসাদটা মস্ত এক ফাঁকা হয়ে ভেতরে প্রবেশের যেন নির্দেশ দিচ্ছিল। জনান্তিক বললেন, প্রাসাদটা একেবারে নিঝুম হয়ে পড়ে আছে, কোন অলৌকিক অস্তিত্বের কথাই যেন আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে--জনান্তিকের কথা শেষ হল না, রানীকুঠির ভেতর থেকে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে দু বার শব্দ হল--যেন জালনা বা দরজার পাট ধীরে ধীরে হাওয়ায় খুলে যাচ্ছে বা কেউ বুঝি  খুলে দিচ্ছে। সামান্য দাঁড়িয়ে এবার ওঁরা রানীকুঠির দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। জনান্তিক বলে উঠেন, হঠাৎ আমাদের ঠাণ্ডা লাগছে কেন বলত ? হ্যাঁ সত্যি। ওদের চারজনেরই বেশ ঠাণ্ডা লাগতে লাগলো। অথচ এত রাস্তা পার হয়ে আসার সময়  তাদের শীত আদৌ অনুভব হয়নি।
শশী বাবু বললেন, হ্যাঁ ভয়ের এমন ব্যাপারের কথা আমি পড়েছি, চল, আমরা এবার ভেতরে যাই--
একটা জিনিস সবারই নজরে পড়লো। বাইরেটা অন্ধকার হলেও রানীকুঠির ভেতরের দিকটা চোখ রাখার পরেই বোঝা গেল অতটা অন্ধকার সেখানে নেই। মনে হচ্ছে ভেতরে কোন কম পাওয়ারের আলো জ্বলছে। সেই আলো চাপা দেবার চেষ্টার পর যেন চাপা ছাইরঙা একটা আলো অন্দর মহলে ছড়িয়ে পড়েছে। সন্তর্পণে চারজন এগিয়ে গেলেন। সবাই চুপ করে আছেন, চরম উত্তেজনা ওদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। একের পর এক বিশাল ঘর পার হয়ে যাচ্ছেন ওঁরা। বড় বড় ইট সিমেন্টের চাই প্লাস্টার চারদিকে ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে আছে। চারদিক হাঁ করা সব দরজা-জানালাশুন্য ফাঁকা জাগাগুলি হঠাৎ চোখে পড়লে ভয়ের উদ্বেগ হয়। আট দশটা ঘর পার হয়ে ওরা বোধ হয় কুঠির পেছন দিকে এসে পড়েছেন। এখানে হঠাৎ ওরা দেখলেন একটা দীর্ঘ কালো ছায়া জানালার পাশ থেকে ঝুলে ছাদ পর্যন্ত দৈর্ঘ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ণব দেখেই ভয় পেয়ে  গোঁ গোঁ শব্দ করে উঠলেন। হ্যাঁ ছায়াটা দস্তুর মত নড়ছে চড়ছে--যেন ওদের দিকেই কিছু ইশারা করার চেষ্টা করছে ! শশী বাবু আর দাঁড়াতে পারলেন না, পকেট থেকে তিনি বড় চাকুটা বের করে চীৎকার দিয়ে উঠলেন, কে ? কে ? তখনও  তেমনি ছায়াটা দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গের লোকটা সাহসী বটে, সে দু পা এগিয়ে দেখে বললেন, মনে হচ্ছে বাইরের কোন গাছের ছায়া ভাঙা জালনা দিয়ে এসে পড়েছে।
অর্ণব ভয়ে কাঁপছিলেন। জনান্তিক ও লোকটা এবার অর্ণবকে সামলাবার জন্যে ধরে থাকলেন। শশী বাবু কপা এগিয়ে এসে ছায়ার ওপর ছুরির ফলা চালাতে লাগলেন। হ্যাঁ, বোঝা গেল ওটা আসলেই গাছের ছায়া।
রানীকুঠি থেকে বেরিয়ে এলেন ওঁরা। না, প্যারানরমাল কিছুই পাওয়া গেল না, এখন অর্ণব সুস্থতা ফিরে পেয়েছেন। শশী বাবু লোকটাকে বললেন, আচ্ছা বাঈজী  বাড়িটা কোথায় বলতে পারেন ?
লোকটা বললেন, আমি জানি, যাবেন ?
--হ্যাঁ ওখানে হয়ত কিছুর দেখা মিললেও মিলতে পারে, শশী বললেন।  
--চলুন তা হলে, লোকটা আগে আগে হাঁটতে লাগলেন। দেখা গেলো লোকটা মোবাইলে টর্চ জ্বালিয়েছেন, সাপের ভয়ে এখানে এটুকু সতর্ক হতেই হবে। শশীভূষণ মোবাইলের ঘড়ির দিকে তাকালেন, ওরে বাবা--রাত বারোটার কাছাকাছি !হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা জায়গা গরম বোধ হচ্ছে। গরমের পর আবার ঠান্ডা, জাগাটাই অদ্ভুৎ, একই জাগায় বিস্ময়কর ঠাণ্ডা-গরম আবহাওয়ার পরিবেশ।
লোকটা বললেন, ওই তো বাইজী বাড়ি দেখা যাচ্ছে। ওরা এগিয়ে গেলেন বাইজি বাড়ির দালানের দিকে। এখানেও প্রকাণ্ড গেট, দালানও নেহাত কম বড় নয়, প্রকাণ্ড উঁচু ভাঙাচোরা দালান। একদম হাট হয়ে দরজা-জানলার জায়গাগুলি হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। চারজন ভয়ে ভয়ে পা টিপে ঢুকে গেলেন বাইজি বাড়ির ভেতরে। কিছু দেখা যাচ্ছে না, মাঝে মাঝে টর্চ ফেলতে হচ্ছে। কেন যেন এই জায়গাটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আছে। হঠাৎ মনে হল ঘরে কেউ যেন বড় বড় শ্বাস ফেলে চলেছে। শ্বাসের শব্দ স্পষ্টতর হয়ে চলেছে। এবার ওরা ভয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। কিছু সময় পরে শশী বাবুর মনে হল, না এটা বাতাসও হতে পারে। এখন হয়ত বাইরে বাতাস চলছে, সে বাতাস কোন এক অ্যাঙ্গেলে এসে ঘরে ঢুকে পড়ছে। আর তা এ ঘর ও ঘর করার সময় শ্বাস ফেলার মত শব্দ তৈরি হচ্ছে। না আর কিছুই দেখা হল না। তার মানে কি কিছুই নেই এখানে ? অলৌকিক কেউ কোন দিন কিছুই তা হলে দেখেনি ? তবে যে বলা হয় পত্র-পত্রিকা ও বিভিন্ন প্যারানরমাল এক্টিভিটিস গ্রুপরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখে গেছে--ওরা স্বীকার করেছে যে এখানে প্যারানরমাল এক্টিভিটিস সত্যিই আছে ! আর একটু এগোলেই জঙ্গলের শেষ হবে।  অর্ণবের ভয় অনেকটা কেটে গেছে। তিনি বললেন, ভয়ের তো কিছুই দেখলাম না! এখানকার সব ঘটনা কি তা হলে বুজরুকি বলে বুঝবো ?
সঙ্গের লোকটা হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন, চুপি চুপি কান পেতে ভয় ভয় চেহারা নিয়ে বলে উঠলেন, এ কি ! জঙ্গল থেকে ঘুঙুরের আওয়াজ আসছে না ?
--কোই ? কোই ? বলে শশীভূষণ কান পেতে থেকে ফিসফিস করে বলে চললেন, এ তো শব্দ বেড়ে চলেছে ? ঠিক তাই। কোথাও যেন মহফিল বসেছে, ঘুঙুরের আওয়াজ, বাইজিদের হাহা হিহি হাসির শব্দ, পুরুষদের মাতাল জরানো গলা, সব মিলিয়ে একটা শব্দ বনের দিক থেকে গুঞ্জরিত হয়ে আসছিল। শশী বাবু হঠাৎ বলে উঠলেন, চলুন আমরা এগিয়ে দেখি--
অর্ণব ভয়ে কিছু বলতে গেলেন কিন্তু ভাষা তার মুখ থেকে ফুটল না। জনান্তিক শশীকে প্রশ্ন করলেন, ওখানে যাবি নাকি?
লোকটা বড় রোমাঞ্চিত বলে মনে হল, বললেন, চলুন না,একটু একটু করে এগিয়ে গিয়ে দেখি--
অর্ণব দুদিকে দুহাতে শশী বাবু ও জনান্তিককে আঁকড়ে ধরে আছেন। লোকটা এখন সবার সঙ্গে এগোচ্ছেন। কপা এগিয়েই ওরা সবাই  এসে থমকে দাঁড়ালেন।  ওদের সামনে এক অলৌকিক দৃশ্য দৃশ্যমান হয়ে চলছে ! বাইজি বাড়ির অন্দর মহলের আলোর আভাস মনে হচ্ছে, বেশ কিছু লোক ওখানেই হই-হুল্লোড় করে বেড়াচ্ছে আর তারই মাঝে ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে হঠাৎ হঠাৎ ঘুঙুরের আওয়াজ বেজে উঠছে। সে সঙ্গে বাঈজীর নাচ ভঙ্গীর দু চারটে স্লো মোশান দৃশ্যের পটভূমি চোখ জুড়ে রয়েছে। তারপর আর কিছু মনে নেই, কখন যেন সামনের বাইজি বাড়ির আলো হৈ হুল্লোড় থেমে গেছে, ওঁরা চারজন কত সময় ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা  নিজেরাই যেন তা জানেন না ! ওঁরা তা হলে কি নিজেদের সম্বিৎ হারিয়ে ফেলেছিলেন ? বাস্তবিকই কি ওঁরা এত সময় ধরে এত সব দেখেছেন ? যখন ওরা স্বাভাবিক হলেন তখন আর কিছু নেই। চারদিকে বনের অন্ধকার আর নিস্তব্ধতা। মাঝে মাঝে ওঁদের মনে এ সবের সমস্ত কিছুই ভ্রম বলে মনে হল। কিন্তু সত্যি কি তাই ? চারজন ব্যক্তি এক সঙ্গে একই ভ্রমিত দৃশ্য অবলোকন করতে পারেন কি ?
লোকটা আর তিন বন্ধু ওঁরা সবাই এবার ফিরে আসছেন। যাই হোক, অলৌকিক কিছু তো ওঁরা দেখতে পেয়েছেন, তার মানে আজকের দিনটা তাঁদের একেবারে নিষ্ফলা যায়নি।