নির্জনতা
ঘরের ভিতর
শুধুই ওষুধের গন্ধ।ঘুমোট হয়ে আছে চারপাশ। এসির হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে নির্জনতার
ঠাণ্ডা প্লাবন।বাইরে একটানা ঝিরঝিরে বৃষ্টি। কাঁচের জানালার ও প্রান্তে দোকানপাট,আলোর
রোশনাই, ব্যস্ততা কোনটাই থেমে নেই।যেন সব নির্জনতা এক সাথে এসে বসে আছে নার্সিংহোমের
দোতলার কোনের এই ঘরে।দুই দিন অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে আজ ভোর রাতে অরিনের অপারেশন
হয়ে গেছে।ডাক্তারি ভাষায় মেজর অপারেশন।নাকে অক্সিজেনের নল, হাতে
সেলাইনের ছুঁচ ফোঁটানো, অজস্র ইনজেকসন নিয়ে বেহুস মানুষটা।
দুটোদিন
অরিনের অসহ্য যন্ত্রণার সাথে মিশে গিয়েছির রিনি ও।কথায় কথায় ভুলিয়ে রাখতে চেয়েছিল
অরিনকে নানাভাবে।বড় কথা বলতে ভালবাসে রিনি।অথচ আজ কথা শোনার মানুষটাই তো চুপচাপ
শুয়ে আছে সেই সকাল থেকে।আত্মীয় বন্ধুরা ফিরে গেছে যে যার নিজের কাজে।নিস্থব্দতা
যেন বার বার করাঘাত করছে তার মানসিক সমস্ত ভাবনায় আজ।‘ভাল হয়ে
যাবে তো”? “আবার আগের মতন সব কথা শুনবে”?সকাল থেকে ফোনে ফোনে কথা হয়েছে প্রচুর।সে তো ছিল শুধু সান্ত্বনা।বেলা গড়িয়ে
দীর্ঘ দুপুর।ফ্যানের হাওয়ায় একটানা শব্দের প্রতিধ্বনি চোখ জুড়িয়ে আসছে না
একটুও।মোবাইল বড় বিস্বাদ মনে হয়।প্রতিক্ষা নেই আজ আর কারোর জন্য, “কখন জ্ঞান
ফিরবে এই মানুষটার”।এই অজানা ভয়ে ভিতর পর্যন্ত
শুকিয়ে যাচ্ছে সব কিছু।বায়োপসির রিপোর্ট পাওয়া যাবে তিন দিন পর, যদি
রিপোর্ট নেগেটিভ হয়?কি করবে রিনি?কখন উঠে বসবে অরিন?চোখে চোখ চোখ রেখে আবার আগের মতন –গলা শুকিয়ে আসছে বার বার।
“মা” দরজায়
হালকা ধাক্কা।ছেলে অংশ, দরজা খুলে কিছুটা স্বস্তি পায় রিনি।
“বাবা এখন কেমন”?
একে একে
ডাক্তার, নার্স ,বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী ,শুরু হয় আসা যাওয়া।সন্ধে গড়িয়ে কখন বৃষ্টি থেমে গেছে কাঁচের জানালার ও
প্রান্তে। জানালার সাটারটা সরিয়ে দিয়ে হু হু করে আসা একরাশ ঠাণ্ডা বাতাস নিতে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় রিনি। এমন সময় খুব আস্তে অরিন ডেকে ওঠে তার নাম ধরে “রিনি”।
রুমাল
উমনো আর
ঝুমনো,পিঠোপিঠী দুই বোন। একই স্কুলে এক জন ক্লাস সেভেন আর একজন ক্লাস এইট। উমনো যেমন
দুষ্টু ঝুমনো ঠিক তার উল্টো। শান্ত ,সব কাজ পরিপাটী।উমনো বড় হলেও
এখনো স্কুল যাবার সময় মা কে খাইয়ে দিতে হয়,বই এর ব্যাগ গুছিয়ে দিতে
হয়।ঝুমনোর জন্য মাকে কিচ্ছুটি দেখতে হয় না।
এবার
স্কুলে ওদের দুজনার ক্লাশেই
আক্টিভিটী ম্যাম একই কাজ দিয়েছেন, চারটে করে রুমান বানাতে হবে,ম্যাম ক্লাশে এসে চার পিস করে সাদা কাপড় প্রত্যেকের হাতে দিয়ে শিখিয়ে দিলেন কি
ভাবে চারপাশটা হেম করে নিতে হবে প্রথমে, তারপর নেট থেকে কোন সাইটে ডিজাইন
পাওয়া যাবে তা ও বলে দিলেন,ডিজাইন এর প্রিন্ট আউট বের করে তার উপর রুমাল রেখে কি ভাবে ট্রেস করে নিতে হবে
তাও বুজিয়ে দিলেন।সেই ডিজাইন রঙিন সুতো দিয়ে ভরাট কি ভাবে করতে হরে ম্যাম পরের
ক্লাশে শেখাবেন।স্কুল
থেকে ফিরে সবটাই ঝুমনো এসে তার মা কে জানলো।উমনো পাশে দাঁড়িয়ে সবটা শুনলো। “আমি এত
কিছু করতে পারবো না”
“তাহলে কে করবে?”
“কেন তুমি”
“বার বার তোর সব কাজ আমি করে দেবো?”
পরের
ক্লাশে ঝুমনো হেম করে ডিজাইন তুলে আনা রুমালে সুতো দিয়ে ভরাট করা শিখে গেল।উমনো
টেরাবেঁকা হেম করা রুমালে সুতোর কাজতো দুরের কথা ছুঁচে সুতো পরাতে গিয়ে আঙুলে ছুঁচ
ফুটে ব্যাথা পেল ভীষন।
দুই মাস
পর রমাল জমা দেবার দিন ঝুমনো সুন্দর
করে ফাইলে সাজিয়ে নিয়ে গেল সব কটা রুমাল। সবাই সবারটা দেখাদেখি করছে,উমনো
কিছুতেই কাউকে দেখাবে না তার রুমাল,একেবারে ম্যামের সামনে ফাইলাটা
খুলবে সে,ম্যাম তো কিছু বলবেন না ,দেখে নম্বর দিয়ে দেবেন। কিন্তু যেই ফাইল খুলল ঝুমনো তো হতবাক,কোথায় তার
সেই টেরাবেঁকা সেলাই করা বিচ্ছরি রুমাল?এতো সুন্দর করে ভরাঠ করা,ফাইলে
সাজানো চারটে রুমাল।