যে প্রশ্নের উত্তর জানা নেই
দেখতে দেখতে আরণ্যক ছাড়া সাতটা মাস
কেটে গেল। অবশ্য সেটা একসাথে সহাবস্থান ও শারীরিক সংযোগের ক্ষেত্রে। কিন্তু মনের
অন্দরমহলে?
সেখানে প্রতি নিয়ত
আরন্যকের অশরীরী উপস্থিতি। কাছেই একটা মন্টেসারি স্কুলে শিক্ষিকার কাজ পেয়ে
যাওয়াতে রুমঝুমের কিছুটা সময় কাটে। মর্নিং স্কুলটা ক্লাস ফোর
পর্যন্ত। চার প্লাসের গুড্ডুকে চোখের সামনে রাখার ভাবনা থেকে আপাতত নিজের স্কুলেই
ভর্তি করিয়েছে।
টিভি খুললেই এক ঘেয়ে খবর- খুন খারাপি,
ধর্ষণ, তানাহলে
কলেজে ছাত্র সংঘর্ষ। সোফায় বসে গুড্ডু ড্রইং খাতায় হিজিবিজি এঁকে চলেছে। এটা ওর
একটা প্রিয় খেলা। ওর কল্পনাকে নানা
রঙের পেন্সিলের আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলে, তারপরে হাতের কাছে যাকে পাবে ডেকে দেখাবে এটা বাচ্চা পাখী
খেলছে, বাবা পাখী আর মা পাখী গাছে বসে দেখছে, এটা
তিন্নিদিদিদের খোঁড়া কুকুরটা, এমন আরও কতো। খুশিতে ডগমগ আরণ্যক বলত, “তোমার ছেলে একদিন মকবুল ফিদা হুসেন হবে”। তোমার ছেলে!
হাহ! সত্যিই
গুড্ডু এখন শুধু ওর ছেলে। একরাশ মন খারাপি আর এক কাপ ব্ল্যাক কফি নিয়ে ব্যাল্কনিতে
এসে বসল রুমঝুম। ডিসেম্বর মাস পড়ে গেল। বেলা ছোট হয়ে গেছে অথচ শীত সেভাবে কোথায়
এলো? চারদিকে একটা ধূসর ভাব।
ও তখন শান্ত দীঘির চোখ আর মাথায় এলোমেলো অরণ্য চুলের আরণ্যকের প্রেমে
দিশেহারা। বিভিন্ন সময়ে ছোট ছোট ঘটনায় রুমঝুম দেখেছে পরের উপকার করার জন্য যেন
মুখিয়ে থাকে ওই ছেলে। আজ রক্তদান শিবির তো কাল বন্যাত্রাণে কোন এনজিওর সাথে দিন
কয়েকের জন্য উধাও। আজন্ম ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া বড়লোকের আদুরী মেয়ে শহুরে কৃত্রিমতা
বিবর্জিত জিলা স্কুলের সেরা ছাত্রের এইসব গুণাবলী দেখেই মুগ্ধ হয়েছিল। আরণ্যক
ব্যাঙ্কের চাকুরীটা পেতে বাবার জোরাল আপত্তি সত্ত্বেও বিয়ে। বিয়ের বছর দেড়েক পরে
গুড্ডু আসার পরে সুখের সাগরে জোয়ার এলো। বেশ ছিল দিনগুলো। তারপরে? কমার্শিয়াল ফিল্মের কাহিনীর মতো এক সুনামি
ঝড়ে সব লণ্ডভণ্ড। মাঝে মাঝে অফিসের পরে এনজিওর কাজ সেরে রাত করে ফিরত। রুমঝুম মেনে
নিয়েছিল। এক দুপুরে স্কুলের বন্ধু দীপশিখার ফোন। অনেক ভূমিকা, ভণিতার পরে জানাল ওর বর নাকি আরণ্যককে চেতলা ব্রিজের কাছে
এক পতিতালয় থেকে বের হতে দেখেছে। নিঃশব্দে মনের ঘরে কি সন্দেহের কেউটে সাপ ঢুকে
পড়ল? প্রশ্নবাণে জর্জরিত আহত, অপমানিত
আরণ্যক বলেছিল, “অকারণে সন্দেহ করে নিজেকে ছোট কোর না রুম। এতো অল্পে অবিশ্বাস ঠিক নয়। আমি কোন
অন্যায় করছি না”। ক্রমশ অবিশ্বাসের চোরাবালিতে ডুবতে থাকা
রুমঝুমের কাছে এই উত্তর বড় ঠুনকো মনে হল। আরণ্যকের ফিরতে রাত হলে অশান্তি, কথা বন্ধ। আরণ্যক কাছে টানতে উদ্যোগী হয়ে বরফ
শীতল অবহেলায় প্রত্যাখাত হয়েছে। আসলে ততদিনে সন্দেহের চারাগাছটা ডালপালা মেলে শেকড়
প্রথিত করে ফেলেছে। সেই গাছ সম্পর্কের ভিতকে ফাটিয়ে দিল যখন ওর মা ধরা গলায় জানাল
রুমঝুমের বাবার এক কর্মচারী ওকে বউবাজারের কাছে এক পতিতালয়ে দেখেছে।
মালিককে দেখাবে বলে সে তার সেলফোনে ছবিও তুলে এনেছে। আরণ্যক সেদিন অফিসে, গুড্ডুকে নিয়ে সোজা বাপের বাড়ি। আরণ্যক
এসেছিল বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ে যেতে। অনড় থেকেছে রুমঝুম। আরণ্যককে অপমান করে পুরনো
ঝাল মিটিয়েছেন রুমঝুমের বাবা।
গুড্ডুর চিৎকারে অতীতের রোমন্থন থেকে সম্বিৎ ফিরল। “মাম্মি, মাম্মি। বাবাই টিভিতে, দ্যাখো”।
ছুটে ঘরে গেল রুমঝুম। এক পতিতালয়ের সামনে সাংবাদিক বলে চলেছে, “এনজিও ‘ভালবাসা’র উদ্যোগে দেহোপজীবিনীদের সন্তানদের জন্য
স্কুল স্থাপিত হতে চলেছে। সরকার জমি,
অর্থ দিয়ে এই স্কুল
প্রতিষ্ঠা
করবে। এনজিওর কর্ণধার আরণ্যক সান্যালের নিরলস...” রুমঝুমের বুকের ভেতরে একটা ঢেউ সবেগে মাথা তুলছে। আরণ্যককে ঘিরে দাঁড়িয়ে কিছু
মহিলা সমস্বরে বলে চলেছে, “এই দাদাভাই আমাদের ভগবান। আমাদের অনেকদিনের
স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। আমরা চাই আমাদের ছেলে মেয়েরা এই নরকের...”। মাথা উঁচু করে নিষ্পাপ অথচ
ভাবলেশহীন মুখে আরণ্যক দাঁড়িয়ে। গুড্ডু মায়ের হাত ধরে ঝাঁকাচ্ছে আর বলছে, “মাম্মি বাবাইর কাছে কবে যাব?”। সব কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। সেপারেশনে থাকা কালীন ডিভোর্সের মামলা কি তুলে নেওয়া
যায় না?
আচমকা এই প্রশ্ন
তড়িৎ গতিতে ওর মস্তিষ্কের অনু পরমাণুতে আঘাত করতে উন্মাদিনীর
মতো সেলফোন তুলে ওদের অ্যাডভোকেট আঙ্কলের নাম্বার ডায়াল করতে লাগল রুমঝুম।