গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৮

তাপসকিরণ রায়

ধারাবাহিক হ্যান্টেড কাহিনী--৩৪

কলকাতার যাদবপুর, একটি বাড়ির রহস্য


কলকাতার যাদবপুর এলাকা অনিল কর্মকারের বাড়ি অনিল কর্মকারের এক মেয়ে থাকে ব্যাঙ্গালোরে l তার নাম মল্লিকা  তার মুখে শোনা ছিল এ ঘটনাটি l ওর সঙ্গে পারিবারিক সূত্রে আমার ভাব হয়েছিল l একদিন রাতে ভূতের প্রসঙ্গ আসাতে ওর মুখ থেকে এ গল্পটা শুনেছিলাম--
আমি এত দিন বলিনি l কলকাতার যাদবপুরের ঘন বসতিতেই আমাদের বাস l
এমনি ব্যস্তসমস্ত জাগার মধ্যেও আমাদের ঘরে ভূতের উপদ্রব ছিল l মল্লিকা বলতে লাগলো, এমনটা আগে ছিল না, আমাদের বাড়িটার দোতলা তৈরি করতে গিয়ে এ ধরনের উপদ্রব শুরু হয়ে ছিল l রাতে শোয়ার পরে ছাদে ধুপধাপ আওয়াজ হতে থাকে l কেউ যেন মাঝে মধ্যে কয়েক বার দাপিয়ে লাফিয়ে যায় আমরা ভাই-বোন আর মা ভীষণ ভয় পেতে থাকি l বাবা বলেন, এ পাড়ার ছেলে-ছোকরাদের কাজ হবে এটা l
লাগোয়া বাড়ির এক ছাদ থেকে আরেক ছাদের দূরত্ব খুব সামান্যই l হতে পারে, কেউ ইচ্ছে করে আমাদের ভয় দেখাচ্ছে l তাকে তাকে থেকেও কে বা কারা ছাদে পা দাপিয়ে ঘুরে বেড়ায় তা ধরা গেল না l তত দিনে দোতালায় আমাদের দুটো ঘর উঠে গেছে l বাবা ঠিক করলেন, তিনি রাতে ছাদের একটা ঘরে শোবেনপাড়ার ছেলেদের লাফানো দাপানো অন্তত কমবে আমাদের ইচ্ছে ছিল আমরা ছাদের ঘরে থাকবো আর নিচের ঘর আমরা ভাড়ায় দিয়ে দেব l তাতে সংসারের কিছুটা হলেও সাশ্রয় হবে l যাই হোক, বাবা রাত্রে খাওয়া-দাওয়া সেরে ছাদের নতুন ঘরে শুতে গেলেন l শুতে যাবার আগে অবশ্য মা বাবাকে অনেক বার বারণ করেছিলেন, ওগো তুমি ছাদে শুইও না l আমার খুব ভয় হয়, তুমি একা শুবে?
কে কার কথা শোনে ? আমার সাহসী বাবা ওপরে একটা খাটের ব্যবস্থা করে তার ওপর রাতের ঘুমের জন্য শুয়ে পড়লেন l বাবার ঘুমটা সবে মাত্র লেগেছিল তার ঘুমের মধ্যেই মনে হল কেউ যেন তার খাট নাড়াচ্ছে ! বাবার ঘুম ভেঙে গেল, তিনি দেখলেন, হ্যাঁ খাট মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে বটে ! এমনি কিছু সময় চলার পরে তিনি এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন l
যথারীতি সকালে ঘুম ভাঙল বাবার l রাতে খাট নাড়ানোর কথা তার মনে পড়ল তিনি ধীরে ধীরে নীচে নেমে এলেন l তাঁর দিকে তাকিয়ে মা চমকে  উঠলেন, এ কি হল ? তোমার গালে লাল ওটা কিসের ছাপ দেখা যাচ্ছে ? সত্যি তাই, কারও হাতের কয়েকটা আঙুলের ছাপ--যেন কেউ বাবার গালে প্রচণ্ড জোরে চড় কষিয়েছে. আঙ্গুলের চাপে লাল ছাপ হয়ে গেছে ভয়ে শিউরে উঠলেন মা, কি হল তোমার গো ?
বাবা বললেন, কোই আমি তো বুঝিনি? তবে রাতে একবার আমার মনে হয়েছিল কারও  হাত যেন আমার গালে এসে ঠেকেছিল কিন্তু ঘুমের মাঝে আমি ভাল ভাবে টের পায়নি? বাবাকে আর ছাদে শুতে দেওয়া হল না l  বাবা নিজেও ছাদে শোবার খুব একটা আগ্রহ দেখালেন না l
এ ঘটনার পর ঘরে পূজার ব্যবস্থা হল অভিজ্ঞ ব্রাহ্মণ পূজা মন্ত্রপাঠ করে সমস্ত বাড়ি শুদ্ধ করে গেলেন l কদিন যাবত সত্যি ছাদে আর দাপানোর শব্দ নেই, বাবা উৎসাহ ভরে আবার ছাদে শুতে গেলেন আরও কটা রাত স্বাভাবিক কাটলো, এক দিন রাতে বাবার মনে হল, কেউ যেন তার মাথার কাছে মুখ এনে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছে ! কিছু দেখা যাচ্ছে না বটে কিন্তু দস্তুর মত কারও শ্বাস এসে বাবার মুখ স্পর্শ করছে l এমনি ভাবে এক সময় মাঝরাতে বাবা ঘুমিয়ে পড়লেন হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে গেলl তিনি স্পষ্ট শুনতে পেলেন, তাঁর কানের কাছে কেউ ফিসফিস শব্দ করে কিছু বলছে
--কে? কে?? বলে বাবা চমকে উঠলেন l চুপ, তারপর সব চুপচাপ আবার বাবার ঘুম লেগে গেল আবার বাবা চমকে উঠলেন, তার কানে কিছু তো কেউ বলার চেষ্টা করছে কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না !
এসব ঘটনার পরে এবার এক জন তান্ত্রিককে আনা হল l ধুমধাম করে পূজা, মন্ত্রপাঠ হল, তারপর বেশ কিছুদিন অলৌকিকতার কোন রকম আভাস আর পাওয়া গেল না l আমরা সবাই ভাবলাম, আমরা এবার ভৌতিকতা থেকে বুঝি মুক্ত হয়েছি l আমরা গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে ফাস্ট ফ্লোরে সিপ্ট করে গেলাম l নিচের তলা ভাড়ায় দেওয়া হবে ঠিক হল
ভাড়াটেরা এস গেল l মাস তিনেক আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে বাস করতে লাগলাম l ভাড়াটেরা কোন প্রকার অভিযোগ করলো না কিন্তু তিনটে মাস পার হতে না হতেই আবার শুরু হল ভৌতিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি l এখন ছাদে দাপাদাপির শব্দ নেই বটে আমরা দোতালায় নিশ্চিন্ত ছিলাম কিন্তু ভাড়াটেরা ভয় পেতে লাগলো l ভাড়াটে ঘরের ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা একদিন আমাদের কাছে এসে বললেন, আপনাদের ঘরে আর থাকতে পারব না--
--কি হল ? মা প্রশ্ন করলেন l
ভদ্র মহিলা বললেন--আমরা রাতে তিন দিন ধরে ঘুমাতে পারছি না l ঘুম লেগে আসলেই কারা যেন কানের কাছে এসে ফিসফিস করে শব্দ করছে !
--ওসব কিছু না--বাতাসের শব্দ হবে, বাবা বলে উঠলেন l
--না না--বোঝা না গেলেও কথার শব্দ স্পষ্ট হয়, ভদ্রলোক বললেন, আবার কারও শ্বাস এসে নাকে-মুখে লাগে! নিশ্চয়ই এ বাড়িতে ভূত আছে l
--কোই আপনারা তো এতদিন আছেন--, বাবা বোঝাতে চাইলেন l
--তা জানি না, আমরা অন্য বাড়ি দেখছি l এই বলে ভাড়াটেরা চলে গেলেন l তারপর আবার পূজা করানো হল, আবার কিছুদিন ভালো তারপর আবার যেই কে সেই l মাঝে দু-এক পরিবার ভাড়াটে এসে ভয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেছে l ভাড়াটেদের সবারই অভিযোগ, ঘরে ভুত আছে, রাতে ঘুম ভাঙিয়ে সে ভূত কিছু না কিছু বলতে চায়--
আমাদের কিছু করার ছিল না, নিজেদের ঘর ছেড়ে তো আর কোথাও পালানো যায় না আমরা সহ্য করে থেকে যাই, ভুতের ফিসফিসানি অনেকটা যেন আমাদের  সহ্য হয়ে গেছে l বর্তমানে আমাদের বাড়ির ভৌতিক বড় কিছু লক্ষণ নেই, শুধু বেশী রাতে কানের কাছে কেউ বা কারা এসে যেন ফিসফিসিয়ে কথা বলতে চায় l
সমাপ্ত