গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৮

সুবীর কুমার রায়

ভ্যাট

বড় রাস্তা থেকে বেঁকে চওড়া গলিটার ওপর দোতলা ঝকঝকে বাড়িটার ঠিক সামনেই, রাস্তার পাশে একটা লাইট পোস্ট, আর তার প্রায় গা ঘেঁষে মিউনিসিপ্যাল্ কর্পোরেশনের একটা সিমেন্ট বাঁধানো মাঝারি আকারের ভ্যাট। অনেকটা অঞ্চল জুড়ে এই একটা মাত্র ভ্যাট থাকায়, এই ভ্যাটটা প্রায় প্রতিদিনই আবর্জনায় ভর্তি হয়ে রাস্তায় উপচে পড়ে দুর্গন্ধ ছড়ায় দুএকদিন পর পর কর্পোরেশনের গাড়ি এসে আবর্জনা তুলেও নিয়ে যায়। সম্ভবত এবার কয়েকদিন কর্পোরেশনের গাড়ি জঞ্জাল তুলে নিয়ে যায়নি, তাই ভ্যাট উপচে নোংরা জঞ্জাল, রাস্তার অনেকটা অংশ দখল করে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, আর তারই ভিতর খাবারের লোভে কয়েকটা কুকুর নিজেদের ভিতর লড়াই করছে।

কুকুর তাড়িয়ে, একটা লোহার শিক দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে, কপির ডাঁটা, স্যানিটারি ন্যাপকিন, ফেলে দেওয়া পচা খাবারের অংশ, ইত্যাদি সরিয়ে সরিয়ে, একটি লোক ঠান্ডা পানীয়র বোতল, প্ল্যাস্টিক ক্যারিব্যাগ, বড় বড় থার্মোকলের টুকরো, পিচবোর্ডের বাক্স, ছেঁড়া কাপড় জামা, লোহালক্কড়, ইত্যাদি প্রচুর জিনিস তুলে, পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা ভ্যান রিক্সায় রেখে, ভ্যাট প্রায় অর্ধেক খালি করে ফেললোসম্ভবত এগুলো বিক্রি করেই তার সংসার চলে। হঠাৎ দোতলা বাড়ির বারান্দা থেকে পরপর চারটে ময়লা ও আবর্জনা ভর্তি পিচবোর্ডের তৈরি বিস্কুটের বাক্স, বোমার মতো নীচের ভ্যাটের মাঝখানে এসে আছড়ে পড়লো। লোকটি একবার ওপরের বারান্দার দিকে তাকিয়ে, লোহার শিকটা দিয়ে পিচবোর্ডের বাক্সগুলো কাছে নিয়ে এসে, ময়লা ঝেড়ে তার ভ্যান রিক্সায় রাখলো।
দোতলা বারান্দার সেই সুবেশা মহিলা ততক্ষণে নীচে নেমে এসে, এই চারটে ও অন্যান্য পিচবোর্ডের বাক্সগুলোর জন্য মূল্য চেয়ে বসলো। লোকটা অবাক হয়ে বললো, “এই বাক্সগুলোতো আমি ভ্যাট থেকে নোংরা ঘেঁটে কুড়ালাম, তাছাড়া আপনি তো মোটে চারটে বাক্স ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেললেন, অন্য বাক্সগুলোর মূল্যই বা চাইছেন কেন?
কয়েকদিন কোন কাগজওয়ালার দেখা না পেয়ে, আজ চারটে বাক্স ফেলেছি, বাকিগুলো গতকাল  ফেলেছিলাম। বাক্সগুলো তো আমি বিক্রিই করতাম, কাজেই ওগুলো নিতে গেলে কাগজওয়ালার মতোই তোমায় পয়সা দিয়ে কিনতে হবে, নাহলে নিতে দেবো না। আরে বাবা, বিনা মুলধনে কি আবার ব্যবসা হয় নাকি? তুমি আমার এই জিনিসগুলো বিক্রি করে টাকা কামাবে, আর আমি সেই টাকার কোন ভাগ পাবো না, তাই আবার হয় নাকি? লোক ঠকিয়ে এই ব্যবসা করা কতদিন চলছে?

ধীরে ধীরে কথোপকথন বিবাদের আকার নিলে, কিছু পরোপকারী সমাজসেবি যুবকের ভিড় জমে গেলো। পৃথিবীতে এমন কি কোন মূর্খ আছে, যে সুন্দরী যুবতী বধূর পক্ষ না নিয়ে, কাগজ কুড়ানো নোংরা অসভ্যের পক্ষ নেবে? এক্ষেত্রেও সকলেই যুবতী বধূর পক্ষ নিয়ে, কাগজ কুড়ানো লোকটার বিরুদ্ধে একজোট হয়ে রুখে দাঁড়ালো।

লোকটি রাগে গজগজ করতে করতে, ভ্যান রিক্সা থেকে সবকিছু আবার ভ্যাটে ফেলে দিয়ে, ভ্যান নিয়ে চলে গেল। ভ্যাট আবার আগের চেহারা নিলো। আগের মতো অন্যান্য আর সব কিছুর সাথে চকচকে ফাঁকা চারটে পিচবোর্ড বাক্সও, ভ্যাট উপচে রাস্তায় গড়াগড়ি খেতে লাগলো। যুবকরা যুদ্ধ জয় করে ফিরে গেল, কৃতজ্ঞ যুবতী বধূটিও তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে, চারটি বাক্সের শোক ভুলে, দোতলায় ফিরে গেল।

ভ্যাটের কাছে মানুষের ভিড় না থাকায়, কুকুরগুলো মনের সুখে নিশ্চিন্তে আবার আগের মতোই খাবারের আশায় ভ্যাটের জঞ্জাল মুখ দিয়ে টেনে রাস্তায় নামাতে শুরু করে দিলো।