গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৮

সুদীপ ঘোষাল

বিস্ময় বালক বিশু


বিশু ছোটো থেকে বড়ো হলো। সত্যি কি বড় হলো বন্ধুরা বলতো ওর বয়স বেড়েছে,মনটা কিন্তু শিশুর মতো রয়ে গেছে। ছোটোবেলায় কেউটে সাপ ধরা,গঙ্গা সাঁতার কেটে পেরোনো,গ্রামে গিয়ে ভূত ধরা সব মনে পরে বন্ধুদের। বাউড়ি বৌকে নিজের খাবার দিয়ে দিতো বিশু। সেই বিশু আজ নিজে একমুঠো খাওয়ার জন্য ছাত্র পড়ায়।বিয়ে করেছে সে।একটা কন্যা সন্তান হয়েছে।তারা গ্রামের বাড়িতে বড়দার কাছে থাকে।বড়দাকে মাসে পাঁচশো টাকা দিয়ে আসে।বিশু বাসা ভাড়া করে থাকে শহরে।একটা বোতল আর বিছানা তার সম্পত্তি।খাওয়াটা বেড়ার সস্তার হোটেলে সেরে নেয়। একটা ট্রেনের যাত্রীর মত তার জীবন।তবু তার মনে আনন্দের অভাব ছিলো না। আনন্দের ফেরিওয়ালা সে।কারও কোনো অসুবিধা হলেই তার ডাক পড়তো আগে।এবার বিশু চললো গঙ্গার ধারে নীলুদার আশ্রমে। নীলুদা বললেন,ওই তো সামান্য রোজগার। নিজেই সব খেয়ে নিলে পরিবারকে খাওয়াবি কি?বিশু বললো,দাদা,তোমার ঘাড়ে বোঝা হয়ে যাবো আমি।তুমি সাধক মানুষ।তোমার অসুবিধা হবে না তো? নীলুদা বললেন,আমি ওসব বুঝি না।যদি আমি খেতে পাই। তোরও একমুঠো হবে।যা ওপরের ঘরে যা। রাত হোলো।বিশুর ঘুম আসে না,গঙ্গার ধারে ওপাড়ে মরা মানুষ পুড়ছে।শবদেহের পোড়া গন্ধ ভেসে আসছে।হঠাৎ বিশু শুনতে পেলো,কিঁ রেঁ,ভয় পাঁচ্ছিস? বিশু তাড়াতাড়ি নীচে নেমে এলো।নীলুদা বললেন,কি রে ঘুম আসছে না? এই নে খা। তারপর গিয়ে শুয়ে পড়।মোরোব্বা খেয়ে ঠাকুরকে প্রণাম জানিয়ে বিশু শুয়ে পড়লো।ঘুম ভাঙ্গলো একদম সকালে। সকালে হরিনাম শুনলো।মন্দিরের সিঁড়িতে জল দিয়ে ধুয়ে ফুল রাখলো।তারপর চলে গেলো ছাত্র পড়াতে।সেখানে চা বিস্কুট খেলো
পরপর বারোটা অবধি ছাত্র পড়াতো।যেসব ছাত্ররা স্কুলে যেতো না,তারা ফোন করে ডেকে নিতো বিশু মাষ্টারকে। ছাত্রদের সঙ্গ তার ভালো লাগতো।তবে দু একটি বাড়িতে ছাত্রের অভিভাবক বসে থাকতেন। পড়ানো পরখ করতেন। তারওপরই মাষ্টারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করতো।একবার এক বড়লোকের বাড়িতে মালকিনের ধমকে সে অপমানিত হয়ে পড়ানো ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলো। কারণ,ছাত্র প্রথম স্থান অধিকার করতে পারে নি।বিশু বলেছিলো,এবার পারেনি,আসছে বার পারবে নিশ্চয়।মহিলা বলেছিলেন,সরকারি চাকরি পাবে না,সেকেন্ড হলে। ফার্ষ্ট হতে হবে। আমি অন্য মাষ্টার দেখবো।বিশু ছেড়ে দিয়েছিলো পড়ানোটা।তারপর এলো সুখবর।নীলুদা বললেন,তুই মায়ের সেবা করে যা। মা তোকে দেখবেন।সত্যি,মা দেখেছিলেন।জীবনের কঠিন সময়ে মা সত্যিই একটা পার্শ্বশিক্ষকের চাকরী পাইয়ে দিয়েছিলেন। বিশুর ভাই খবর পাঠালো,দাদা গ্রামের স্কুলে দু হাজার টাকায় পার্শ্ব শিক্ষক নেবে। তুমি আ্যপ্লাই করো।বিশু পেয়ে গিয়েছিলো চাকরীটা।টিউশানির থেকে ভালো।মাইনে কম হলেও নিশ্চয়তা আছে।বিশু বন্ধুদের বললো।বন্ধুরা বললো,তুই সকলকে সাহায্য করিস। তোর কোনোদিন অভাব হবে না। মানুষের আশীর্বাদ তোর সঙ্গে আছে। তারপর নীলুদার আশীর্বাদে বিশুর নিজস্ব বাড়ি হোলো।আর বাসা বাড়ি নয়।নিজের বাড়িতে নিয়ে এলো মেয়ে আর বৌকে।  চারদিকে বাঁশের বেড়া। কাছেই একটা গরীব পাড়া আর একটা পুকুর।সাপের রাজত্ব।সেখানে ঘর বাঁধলো বিশু। একবার রাতে বিরাট এক গোখরো ঢুকে পড়লো বিশুর ঘরে।ফণা তুলে ফোঁস ফোঁস করছে সাপটা।মশারির ভেতরে বৌ আর ঘুমন্ত কন্যা। বিশু এক হাতে লাঠি নিয়ে ফণা চেপে ধরলো সাপটার। আর অন্য হাতে সাপের লেজ ধরে ঝুলিয়ে নিয়ে এলো বাইরে।
তারপর বনের ভিতর ছেড়ে দিলো সাপটা। রাত হলেই তার উঠোন দিয়ে চলাচল করতো নানারকম সাপ।ডোমনা চিতি,শাঁখামুটি,চন্দ্রবোড়া,গোখরো কিছুই বাদ ছিলো না। সকলে বলতো মাঝমাঠে বাড়ি করলে ওইরকমই হয়। বিশু কি করে বোঝাবে,সে প্রকৃতির সন্তান। এই বন,জঙ্গল,সাপ তার বড় প্রিয়। সে সবাইকে নিয়ে আনন্দে থাকতে চায় না। কিন্তু মানুষ, সবাইতো আর সমান হয় না। প্রতিবেশিদের একজন তাকে শিক্ষা দিতে চায়,গাড়ি,বাড়ি আর নারী, ভেবেচিন্তে নিতে হয়। বড় নিষ্ঠুর কিছু মানুষ। গাড়ি,বাড়ি জড় পদার্থের সঙ্গে মায়ের তুলনা করে।বিড়বিড় করে সে। মনে ভাবে,আমি বিশু, আমার সামনে যা তা কথা বলে পার পেয়ে যায় এখন মানুষ।কিন্তু জানে না,এই বিশু ওদের শায়েস্তা করতে পারে এক মিনিটে।কিন্তু সময় বড় বিচারক।সে আজ বিশুকে কঠিন লড়াইয়ে নামিয়ে দিয়েছে। জীবনে টিকে থাকার লড়াই। এই যুদ্ধে ক্রোধের জায়গা নেই। ক্রোধকে জয় করার লড়াইয়ে জিততে হবে। তবেই হবে তার জয়।

সে এখন তার বাড়িতে অনেক ফুল গাছ লাগায়।আর অনেক ফুলের মাঝে সে সহজ হয়ে যায়।
ভাটফুল,ঢোল কলমি,পাহাড়ি কলমি র ফুলের ঘ্রাণে, প্রাণে ভারতবর্ষের নির্মল সুন্দর গন্ধ ভেসে ওঠে।সুবাসে মন মাতোয়ারা। বসন্তের রঙ বাহারি ফুলের গানে হৃদয় দুলে ওঠে বিশুর। ফল গাছের মাঝে বসে সে ভাবে পুরোনো দিনের কথা।
বিশু ভাবছে পুরোনো দিনের কথা, শীতকালে বন্ধুরা গোল হয়ে বসতাম। মাঝখানে জ্বলতো আগুন। পাতা চোতা কুড়িয়ে দিতাম আগুনে। আগুন নিভতো না। সেই আগুনে সেঁকে নিতাম হাত পা। আবার বাড়িতে গিয়ে মায়ের রান্নাঘরে মাটির তৈরি উনুনে সেঁকে নিতাম শীতল হাত,পা। মা সরজুগুলি,পিঠে বানাতেন। উনুনের ধারে বসে নলেন গুড়ের সঙ্গে আয়েস করে খেতাম। পায়েস খেতাম শেষ পাতে। রকমারি খাবারের সুগন্ধে মৌ মৌ করতো মায়ের হেঁসেল ঘর। পালো, বলে একরকমের খাবার মা বানাতেন যত্ন করে। সকালে উঠেই পালো খেয়ে ভুরিভোজ সারতাম। তারপর পিঠে রোদ লাগিয়ে  সরব পড়া। বোঝার থেকে চিৎকার হতো বেশি। আনন্দ পেতাম সরব পড়ার প্রতিযোগিতায়। পাশের বাড়ির বন্ধুদের সরব পাঠের আওয়াজ পেলেই,ততোধিক জোরে শুরু করতাম পাঠ। স্কুলে গিয়ে তার আলোচনা হতো ক্লাসে। আরও জোরে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রতিযোগিতা চলতো মাসের পর মাস। কোনো দুঃখ,কষ্ট আমাদের মনে রেখাপাত করতে পারতো না। জীবনের আনন্দ ছড়ানো থাকতো ধুলো জোড়া  পথে। এই ধুলো,মাটির সুগন্ধ আমার দেশমায়ের আশীর্বাদ।
বিশু তার মেয়েকে বাল্যকালের ঘটনাগুলো গল্পের মত করে বলে।পৌষালা বা পোষলা করতাম পৌষ মাসে। নবগ্রামে অজয় নদী বাঁক নিয়েছে ইংরাজী অক্ষর এসের মতো। সেখানে বন্ধু,বান্ধবীরা একসাথে পোষলা করতে যেতাম শীতকালে পৌষ মাসে। নদীতে চান করতাম। বাড়িতে শুধু নিষেধের বেড়া। বাঁধা গরু ছাড়া পেলে যেমন পাগলের মতো ছুটে ছুটে বেড়ায় স্বাধীনতার আনন্দে। ঠিক তেমনই আমরাও কি করবো ভেবে পেতাম না। শুধু খেলা,ছোটা আর উল্টোপাল্টা চিৎকার, চেঁচামেচিতে নদী উচ্ছল হতো। প্রতিধ্বনি ফিরে ফিরে আসতো বারে বারে। এত খোলা জায়গা,এত আকাশ,নদী,জল আমরা সহজে তো পাই না। তাই মুহূর্তের আনন্দ আজও হৃদয়ে রং ধরায়,চোখ ভেজায় নব আনন্দে। স্মৃতি রোমন্থনেও অনেক সুখ। এইসব শুনে তার মেয়ে বলে,বাবা,আমিও পোষোলা করবো।বিশু বলে,এখন আর পোষলা বলে না মা।বলে পিকনিক,ফিষ্টি এইসব। বিশু আবার বলে, শোন আমাদের গ্রামের কথা,আগে গ্রামে থাকলে দেওয়া নেওয়ার পালা চলতো।পাশের বাড়ির সজনে ডাঁটা।কুমড়োর শাক,বেগুন চলে আসতো সকালবেলায়।আবার আমাদের বাড়ির কাঁচা লঙ্কা,কাঁচা আম, লাউডগা চলে যেতো তাদের বাড়ি।কোনো অভাব ছিলো না তার কারণ চাহিদা কম ছিলো।মাছ,মাংস না হলে খেতেই পারবো না, এইরকম কোনো ব্যাপারই ছিলো না।এখনও গ্রামে অভুক্ত কেউ থাকে না।এ বাড়ি ও বাড়ির খাবার নিয়ে অসহায় অনেক বুড়ো বুড়ি জীবন যাপন করে। রাজনৈতিক প্রভাব সামান্য থাকে। তবে তা কখনই মাত্রা ছাড়িয়ে কাউকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে না।বিশু এইসব ভাবতে ভাবতে কাজ করে যায়।বাড়িতে থাকলে কোদাল নিয়ে সে ঘাস পরিষ্কার করে,গাছ লাগায়।গাছে জল দেয়। মেয়ে স্কুলে গেছে মায়ের সঙ্গেতার ফাঁকে সে লিখে ফেলে পুরোনো ভালো মন্দ স্মৃতির কথা। তার মনে পড়ে, পাঁচ বছর বয়সে অভাগীর মা মারা যায়। আজ দশ বছর পরেও মা কে খুঁজে পায় বাড়ির আম গাছে।এই আমগাছেই  গলায় দড়ি বেঁধে আত্মহত্যা করে তার মা। মন খারাপ হলেই আমগাছেটাকে অন্তরের কথা বলতো।আজ ঘুম থেকে উঠে দেখলো গাছটা ঝড়ে পড়ে গেছে।দ্বিতীয়বার মাতৃহারা হয়েছিলো মেয়েটা।এইরকম কতশত স্মৃতি তার মনে আসে তার ইয়ত্তা নেই।সে ভাবে,ঈশ্বর যদি কোনোদিন ক্ষমতা দেন,তাহলে গরীব, দুখি, অনাথ শিশুদের সে মানুষ করে তুলবে।এক গন্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থেকে তার মন হাঁপিয়ে উঠেছে।জন্মালাম মানুষ হয়ে অথচ মানুষের কিছু করতে পারলাম না,এই শোকে বিশু মনে মনে কাঁদে।  মনে পড়ে বিশুর তার বন্ধু অলকেশকে। সে বিশুর খুব প্রিয় ছিলো। অলকেশ শান্ত ভদ্র ছেলে।লেখাপড়ায় খুব ভালো।পরোপকারী।ভালো চাকরী করে। তার ভাই নিখিলেশ আরও ভালো চাকরী করে।বাবা পেনশন ভোগী।অলকেশের কাছেই বাবা,মা থাকেন।তারও এক কন্যা। আর আছে তার স্ত্রী।সেও স্কুল শিক্ষিকা।এই অবধি সব ভালো।হঠাৎ মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়লো।ধনেপ্রাণে মারার রোগ।পৃথিবীটা অলকেশের কাছে বড় শূণ্য হয়ে ঘুরতে লাগলো।জীবন অর্থহীন মনে হোলো।মাসে দুলক্ষ টাকা খরচ। তাহলে কিছুদিন মাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে। এখন কোন দিকে যাবে অলকেশ।সব আয় এক করেও তো মাসে দুলক্ষ হবে না। অলকেশের মা বললেন, আমাকে বাড়ি নিয়ে চ।আমার কিছুই হয় নি।মনের জোরের কাছে ক্যান্সার হেরে গেলো...
আজ দশ বছর পরেও অলকেশের মা জীবিত। বিশুর মুখে সত্য ঘটনা শুনতাম গল্প শোনার আগ্রহে। একবার বিশু তার মামার বাড়ি নিয়ে গেলো আমাদের।বিলের ধারে বনভোজনের জন্য বসেছি।এমন সময়ে,মুর্শিদাবাদের বিলে সত্তরজন লোক নিয়ে বাসটি জলে পরলো সেদিন ঠিক সেই সময়ে বিলের পাড়ে এসেছিলো প্রকৃতির সন্তান বিশু।তার মামার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে,বন্ধুদের নিয়ে।
বাসটা জলে পরা মাত্র পাড়ে বাঁধা নৌকো খুলে মাঝিকে পাঠালো মাঝ বিলে। আর নিজে ডুব সাঁতারে প্রায় তিরিশ ফুট নিচে নেমে তুলে আনলো প্রাণ। আবার ডুব দিলো। এইভাবে প্রায় দশজনের প্রাণ বাঁচালো বিশু।নৌকায় তুলে, নিয়ে এলো বিলের পাড়ে। তাদের মধ্যে একজন মারা গেলো। আর বাকি নয়জনকে পাঠিয়ে দিলো হাসপাতালে।
জনতা রেগে আগুন ধরিয়ে দিলো আর একটি বাসে।
বিশু বললো,এসো আমরা সবাই প্রাণ বাঁচাই। আগুন ধরিয়ে কোনো সুরাহা হবে না। তার কথায় কাজ হলো। সবাই একত্রে বাঁচালো আরও প্রাণ। আর বাকি মানুষগুলো মরে ভাসতে থকলো চোখের সামনে,মরা মাছের মতো। বিশুর চোখ থেকে কয়েকফোঁটা জল পরলো শান্ত বিলের জলে। জলের ভাষা পড়তে জানে বিশু। সে শুনতে পেলো,একটা পাগল বলছে, আমার তো অপরাধ নেই। শান্ত বুকে আছাড় মেরে মানুষ মারার দল টাকার লোভে আইন মানে না।রাস্তায় চলার নিয়ম জানে না।  তবু তোমাকে আমি শ্রদ্ধা জানাই বিশু।তুমি প্রকৃতির  সন্তান। এই পাগলটা বিশুকে খুব ভালোবাসতো।সে তাকে বলতো,তুই আমার ভগবান বিশু।বিশু বলতো,আমি মানুষ।মানুষের জন্য তাই আমার হৃদয় কাঁদে।