কোল
নীলিমার আপত্তি ছিল। বিভূতি বলে 'শেষ পাতের ভাত কুকুরকে দুটো দিতে হয় জানো,
তাতে স্বর্গবাস হয়। জানো যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে…………" নীলিমা খিঁচিয়ে ওঠে " মরণ নাই ঢুকো, কুকুরকে ভাত দিয়ে
বাবু স্বর্গে যাবেন। তার উপর পেনি কুকুর। বাড়িতে খাবে,
হাগবে,বাচ্ছা পাড়বে, ভাগার আনবে। তোমাকে তখন সব ঘোচানো করাব।" বিভূতির প্রায় পাকা গোঁফ,
সামনে অদৃশ্য হয়ে আসা চুল,
ঠায় রোদে দাঁড়িয়ে দেখে লেজ নাড়তে নাড়তে পরম
তৃপ্তির খাওয়া। মনে মনে ভাবে, কত অল্প সন্তুষ্ট। বাড়ির দুয়োরে জবাগাছের তলাতেই সারাদিন পা
ছড়িয়ে শুয়ে থাকে। মাঝে মাঝে অন্য কুকুর এলে ভুক ভুক।
বেশ ডাগর-ডোগর হয়ে গেছে দু'এক মাসেই। ক্রমে ভাদ্র হল,
আনাগোনা শুরু হল পুরুষ সঙ্গীর। বিভূতিকেও
অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে। সে ঢিল মারে। কিন্তু পাড়া সরগরম হল যেদিন সকালে দুয়োরে জল
দিতে গিয়ে নীলিমা আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলল, "কই গো, দেখে যাও তোমার পেনির কীর্তি। সক্কালবেলা,
ঠাকুর দেবতার নাম করব তা না……………, ছি ছি ছি ছি ছিঃ।বারো বছরের মুড়ো ঝেঁটা মেরে দূর করতে হয়।" বিভূতি উঠে আসে। কোনক্রমে চোখ আড়াল করে। চা
খেতে খেতে শান্ত করে নীলিমাকে "ওরাও তো আমাদের মতই জীব,…………"। কিন্ত নীলিমার মুখের তোড়ে চুপ করে যায়। পৌষের এক দুপুরে পেনি ভাত খেল না। নধর শরীরটা নিয়ে নড়তে পারছে না।
জবাতলায় শুয়ে হাঁফাচ্ছে। রাতে বিভূতির ডাকে সাড়া দিল বাড়ির পিছন থেকে। কিন্তু এল
না। শোবার আগে বাড়ির পিছনে বাঁশতলায় প্রস্রাব করতে গিয়ে বিভূতি দেখল,
সারকুরে অনেকটা খাল করে তার ভিতর শুয়ে। পরদিন সকালে
নীলিমাকে রাগানোর জন্য বিভূতি বলে "তোমার চারটে নাতি-নাতনি হয়েছে গো।" আজ আর নীলিমা কিছু
বলল না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস। রোদ চড়া হলেও প্রথম মাঘের দুপুরটায় বেশ ঠান্ডা। নীলিমা একটা
শতরঞ্চি আর বালিশ এনে পশ্চিমে মাথা করে চুলটা এলিয়ে দিয়ে রোদে শোয়। চোখ লেগে
এসেছে। পাড়ার বুড়োর মা গল্প করতে এসে দেখে নীলিমার বুকের কাছে শুয়ে ছোট্ট ফুটফুটে
পেনির একটা বাচ্ছা। মাথার অদূরে পেনি। বুড়োর মা চিৎকার করে বলে "ও দিদি,
কেমন ঘুম ঘুমোচ্ছো?
বলি তোমার পাশে কুকুরের ছানা এসে শুয়েছে,
সে খেয়ালও নেই?" ধড়মড় করে উঠে বসে নীলিমা। পরম মমতায়
বাচ্ছাটাকে কোলে নিয়ে বলে "এজন্মে
আমার কোলে তো কেউ এল না, তাই……………"
একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীলিমা।
মগডাল
গাছের একটা ডাল সব ডাল ছাড়িয়ে আকাশে উঁকি মারল। কচি পাতা,
কচি দেহ যেন নব্য যৌবন। নিজেকে তারিয়ে তারিয়ে
উপভোগ করে সে। অন্য ডালগুলো কেমন কালচে সবুজ বুড়োটে। জৌলুসহীন ডালগুলো দেখে নিজের
মনে অহংকার এল তার। আজ তার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। সব সীমা ছাড়িয়ে পৃথিবীর
অধীশ্বর ভাবল নিজেকে। সে স্বজাতির খোঁজ নেয় না। নীচের ডালগুলো বন্ধু ভাবতে চাইলে
বলে "
আমার যোগ্য নও তোমরা, বন্ধু পাতাতে এস না।" মগডাল মেঘকে উড়ে যেতে
দেখে উড়তে চাইল। মেঘ বলল " নিজের
যোগ্যতায় ওড়ো। তোমার নিজের ক্ষমতা কোথায়? মূলের ভরসায় এতদূর
এসেছো। তাই বলে আমাদের সঙ্গে পাঙ্গা নিতে এস না। আমরা অনেক উঁচুতে থাকি।" মগডাল রেগে গেল,"এত সাহস? আমার মুখের উপর কথা? কে পাত্তা দ্যায় তোদের?" আকাশের তারাকে হেঁকে বলল "কি ভায়া,কেমন আছো?
আমি তোমাদের নতুন বন্ধু"।তারারা
শুনতেই পেল না, নাকি শুনে মিটমিট করে হাসতে লাগল কে জানে?
মগডালের ভীষণ দুঃখ হয়। তবে কি সে বন্ধু পাবে
না? এদিকে তার কচি সবুজ
রং ঘন হতে শুরু করেছে, কচি ডাল লাবণ্য হারাচ্ছে। নিজের সৌন্দর্যের অধঃপতন দেখে কান্না পেল তার। হায়
রে জীবন। এত অল্প সময় তোমার আয়ু? একদিন তার মাথা ঝুঁকে গেল। নিচের দিকে তাকিয়ে স্বজাতিকে
ডাকল। কেউ সাড়া দিল না। সবাই মাথা নত করে রইল। মগডাল কান্নাভেজা চোখে চারপাশ
তাকিয়ে দেখল আরো কিছু কচি ডাল তাদের যৌবনের উন্মাদনায় উঠে আসছে। সে বুঝল তার দিন
শেষ। বন্ধুহীন হয়েই কেটে গেল জীবন। আজ সে পুরনোর দলে।
সেই মগডাল একা হয়েই রয়ে গেল।