তিন
পয়সার পালা
‘মহারাজা...তোমারে সেলাম !’
জন্মদিন। শুভ জন্মদিন। খোকার জন্মদিন।
খোকা নয়, বোকা নয়,
রাজা, রাজার জন্মদিন।
-ওই তো, ওই তো
আমাদের রাজামশাই !
-রাজামশাই, হাজার
সেলাম আপনাকে।
-আপনার
নব্বইতম জন্মদিন
শুভ হোক !
শুভ হোক !
শুভ হোক !
এক
‘এ এক জন্মের মতো ভোর ! ডুবো পাহাড়ের গায়ে
ধ্বসে যায় অধিকার, বোধ
আবর্তে ফেনিল ভেঙে ছুঁয়ে যায় পাহাড়ের চূড়া।’
তিনিই রাজা। আফ্রিকার ছোট্ট দেশ
টোঙ্গ। অন্ধকারের মাঝে তিনিই আলো, বিপুল আলোধারার।থলথলে চেহারার হ্যালোজেন বাল্ব। স্বৈরাচারী
রাজত্বের ঊনপঞ্চাশতম বর্ষ। পঞ্চাশ পূর্ণ করেই বড় ছেলে জোশেফ-কে সমস্ত দায়িত্ব তুলে দেবেন, আপাতত এমন ইচ্ছেটা নেই। ক্ষমতা এমনই।
--আচ্ছা,
এই নব্বইতম জন্মদিন কীভাবে পালন করা যায় বলতে পারেন ?
১.
একশোটি সদ্য ঋতুমতীদের সঙ্গে
রাত্রিযাপনে ?
২.
দেশের সবথেকে সুন্দরীদের ( বিবাহিত ও অবিবাহিত)
সঙ্গে রাত্রিযাপনে ?
৩.
ডোজকি উপজাতিদের একশোজনকে ডিহাং-এর
উদ্দেশে বলি দিয়ে (অবশ্য তার আগে সম্ভোগে) ?
--না। এসব ক্লিশে !
--ক্লিশে?
--ইয়েস! বড্ড খিদে পেয়েছে এবার। রাজার একগাল বিমান হাসি।
--কীসের খিদে মহারাজ...?
--‘বলা ভারি
শক্ত /
সব থেকে ভালো লাগে...’ হে হে হে হা হা হা...আবার হাসি, সর্বাঙ্গ
নড়ছে হাসির গমকে।
--কী...?
--গরিবের রক্ত তো রোজ খাইরে পাগলা, এবার যদি হত বুনোহাতির রক্ত !
--হাতির রক্ত !
--বুনোহাতির রক্ত !
--হোক !
--হোক !
--হোক তবে !
--মহারাজ,
একটা বুনোহাতি তো আমাদের পিলখানায় বন্দি। এদিকে এ-মাসের মধ্যেই সেটাকে মরতেই হবে, আন্তর্জাতিক সনদে আমরা স্বাক্ষর
করেছি বলে কথা।
--সব দেশ থেকেই নিকেশ করতে হবে, এ-মাসেই।
--ঠিক।
--ঠিক।
--ঠিক।
দুই
‘হাওয়ায় এত জোর! এত
ওলটপালট জোর
উলটে যায় পৃষ্ঠা উনুনের
উলটে যায় পৃষ্ঠা জ্যোৎস্না-আলোর’
--‘মহারাজা...তোমারে সেলাম !’
--আমরা বাংলাদেশেতে ফিইর্যা আইলাম !
--ওঁরা লুটেপুটে করতাছে !
--সোনার বাংলা এহন ভাইঙ্গা দুই ভাগ !
--ভাই-ভাইয়ে আইজ কত যে বাধা।
--মাঝে ইছামতী, ওইপাশে রাধা।
--আর রাম-লক্ষণ হোইচে যে আলাদা !
--এই শালা, রামের নাম নিবি না কলাম !
--তাইতো দুলাভাই!
রাম-রহিমও
কওয়ন যাবে না। কী যে দিনকাল পড়ছে কী আর কব !
আইচ্চা, কী কই কওদিন?
মুদ্রাদোষ হোই গেচে। বড্ড গেরোয় পল্লাম যে !
--কও চিচিং fuck !
--কচ্চ?
--কলাম। কও এইবার। একসাতে।
--চি চিং ফাক !!!
--ও দুলাভাই, কী এড্ডা খুইল্যা যাচ্চে যে...দরজা মুতোন...!
--এই শালারা, কারা রে তুরা ?
--কইল্যা ‘শালা’,
আবার জিগাচ্চো ক্যান? তা তুমি কন কার কিরা? কোন
দুলাভাই আবার ?
--আমি আলিবাবা।
--কার বাবা ?
--ধুর মুক্খ। এই যন্তর আমার, এই মন্তরও আমার,
আর তুমাগো ওইসব কল্পনাও আমার।
--খাইচে ! ও দুলাভাই, কচ্চ না ক্যান কিচু ?
কী কয় নতুন দুলাভাই। অ্যাঁ, আপনের
কল্পনা ? কল্পনা হইলোগে
আমাগো ! আলিবাবা কলাখাবা গাছ লাগায়ে খাও...
--চোপ শালা! যত্তসব ডিস্টার্বিং মাল !
কোনও রুচি নাই।
--যোমেরও অরুচি!
‘শালা’ কইচি বলে আমারেও দুলাভাই কয়!
--বাঙালির আর বাংলা ভাষার যখন ড্যাশ মারা যাচ্চে, তখন আর
রুচি! খাঁড়াও খাঁড়াও, গুহার ভিতর ধুঁয়া বেরোচ্চে,
মনে হচ্চে পুরো সিনিমা হল, পরদা লাগানো, চলো দেকি
কী হয়।
--চলো তালি !
--চলো চলো !
তিন
‘মৃত্যুর মতো এক উন্মাদ আলোর কামড়ে কী তেষ্টা
পেয়েছিল
তোমাকে সেকথা বলতে পারিনি’
প্রায় সবক’টা হাতিকে মেরে ফেলা হয়েছে, বেঁচে আছে কেবল মামুন আলিরটা, এমনই রিপোর্ট।আন্তর্জাতিক চুক্তি প্রতিটি রাষ্ট্রকে মানতেই হবে। প্রতিদিন একটা হাতি প্রচুর সবুজ
ধ্বংস করে। হঠাৎ করে হাতির সংখ্যা বেড়ে যাবার কারণে সবুজের অভাব দেখা দিচ্ছে দিকে
দিকে। এছাড়া
প্রতিবছর হাতি দলে দলে ঢুকে পড়ছে বনসংলগ্ন বসতিতে, বিপুল পরিমাণ ফসলের ক্ষতি হচ্ছে, হচ্ছে প্রাণহানিও। এরকম চলতে থাকলে সবুজ বনভূমি ধ্বংস হয়ে যাবে শীঘ্রই। মানুষ
বাঁচবে কীভাবে? এই
সিদ্ধান্ত, তাই। বিশ্বের সব দেশই এই চুক্তিতে সই
করেছে। থাইল্যান্ড
বা শ্রীলঙ্কার মতো কিছু দেশ প্রথমে একটু-আধটু কাঁইকুঁই করলেও আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে হয়েছে তাদের।
পরশুর ঝড়ে উপড়ে যাওয়া স্বর্গ-মর্ত্য আমগাছ এখনও মাটিতে পড়ে, ওপাশে।আর মামুন আলি মাটির
বারান্দায় উপুর হয়ে শুয়ে, গাছ
সরানোর খেয়াল বা ইচ্ছে কোনোটাই নেই। ঝড় থামলেও ঝড় বইছে, সোঁ সোঁ,
ভেতরে ভেতরে, উপড়ে যাচ্ছে হৃদয়ের চিরহরিৎ বনভূমি, নিমেষেই।
লক্ষ্মী বাইরে, বাঁধা। ওরা লক্ষ্মীকে মেরে ফেলব,
আগামীকাল। মেয়েকে মারবে, চোখের
সামনে!
কিছুতেই মেনে নিতে পারে না
মামুন।
রাবেয়া বিবির ভেতরে ভেতরে নিষিদ্ধ খুশি। চুক্তি অনুসারে এক লাখ পাওয়া যাবে যে ! পৃথিবীর সব কিছুর দাম বাড়ল, হাতির দাম যা ছিল, তাই-ই রইল শুধু--সে মৃত হোক কিংবা জীবীত !
সারারাত বড়গাছতলায় বসে কেঁদেছে মামুন। রাবেয়া সান্ত্বনা দেয়। তারাও এবার লাখপতি হবে। গরিবের ঘরে ছপ্পর ফাড়কে মুঠোমুঠো টাকা আসবে। তাদের দুঃখ-দুর্দশা
ঘুঁচে যাবে। ভাঙা টালি ভেদ করে আড়া ডিঙিয়ে আর চাঁদের আলো নয়, ঝকঝকে হলদে আলোর বাল্ব ঝুলবে এবার সেখান থেকে। কিন্তু লক্ষ্মীর মুখটা ভেসে উঠলেই মামুনের চোখে জল আসে যে বড়! সে-কান্নায় ভেসে যাবে না তো ঘর? রাবেয়া আকাশপাতাল ভাবে,
তবু সে আলোই খোঁজে।চাঁদের নয়, হলদে বাল্বের !
লক্ষ্মী। এই নামে
মামুন ডাকে। লক্ষ্মী
সাড়া দেয়। অভাবে
মামুন সবকটা হাতি বেঁচে দেয় এক সময়। তা আট-দশ বছর হবে। থাকে এই লক্ষ্মী।
লক্ষ্মী থাকলেও তাদের ঘরে মালক্ষ্মী আসেনি বহুদিন। বহুদিন দু-বেলা নিশ্চিত অন্ন জুটিয়ে ঘুমোতে পারিনি দুজনে। তবু লক্ষ্মী-কে মেয়ের
মতো জড়িয়ে রেখেছে মামুন বুকে,
শত ছিন্ন আকাশেও।
মুসলমান বাড়িতে হিঁদুদের নাম ! তাও কিনা দেবদেবীর ! অনেক মোড়লেই আপত্তি তুলেছিল। মামুন এসবে হেসেছিল খুব, বলেছিল—খালেদ
চাচা, রসিদ মিঁঞা, নির্মল চকোত্তি, মা'র কি জাত হয় কুনো? ওইডা তো
আমার মা। আমার
মাইয়া। লালন সাঁই
কি কইচিলো বড় চাচা?এভাবেই
লোকজনকে অদ্ভুত ভাবে চুপ করিয়ে রাখতে পারত মামুন। কেউ কেউ রেগে গিয়ে বলত, তা লক্কির পিঠি চড়িস ক্যান রে দামড়া ? পা'র নীচে পড়ি থাকবি! তখন দ্যাকবানি
মাইয়ার আদর কেমন ঠেহে !
--পিঠি কি চড়ি চাচা, আমি তো মাইয়ার কোলে চড়ি গো! এই বলে বাঁশের সাঁকো থেকে চাঁদবিবি খালে ঝাঁপ দেয়। সাঁতার দিয়ে চলে যায় দূরে। কিংবা গান ধরে। গান করতে করতে লক্ষ্মীর পিঠে চড়ে চলে যায় জঙ্গলের দিকে,
আর ফিরে আসে শুকনো ডালপালা-ফলমূল নিয়ে। মামুন মাঝে মাঝে লোকের জমিতে জন দেয়। কিছু আয় হয় তাতে। রাবেয়াও অন্যের বাড়ি বাড়ি কাজ করে যৎসামান্য উপার্জন করে।
তারা গরিব। তবু সুখে। সুখ তাদের ভাঙা ঘরে জোছনার মতো
টালি ভেদ করে এসে পড়ে। বৃষ্টিও পড়ে। তখন এক-টুকরো
ভাঙা কাচ লাগিয়ে দেয়। ঘরে বৃষ্টি ভেজা জোছনা তখন শিশু হয়ে খেলা করে বিছানায়। নকশিকাঁথায় এক টুকরো অপত্যঅরণ্য। রাবেয়ার মুখ ভার হয়,
নিচু হয়, তার পর কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীরে বলে, আমাগো যদি এটটা ছোয়াল-টোয়াল থাকতো!
হৃদয়অরণ্যে
বৃষ্টি নামে নীরবে, বেহালা
কাঁদে মহাকাশে চড়ে। দীর্ঘ নীরবতার পর মামুন চোখ মোছে,
বলে, ক্যান,
মাইয়া কি অপরাধ করল?
রাবেয়ার
মুখ গোমড়া, হ , মাইয়া দিয়া কি হইবো ? গরিব ঘরে মাইয়া মানে তো ঘটি বেচোরে বাটি বেচোরে !
--হা হা হা!
--ওইরম হাসবানা। পিত্তি জ্বলি যায় কলাম।
--শোনো রাবু, মাইয়াই হইল গে ঘরের লক্কি। যেমন তুমি। আর আমাগো
তো লক্কি আছেই। তালি আর
চিন্তা কি? যাও এইবার তামাক সাজো।
রাবেয়া মুখ ভেঙিয়ে গজরাতে গজরাতে
বেরিয়ে যায়। তামাক
নিয়ে ফিরে আসে। মামুন
সুখটান দেয়।
রাতে স্বপ্ন আসে রাবেয়ার কাছে, অনেক টাকা তাদের ঘরে। তার কানের-নাকের
হয়েছে। একটা পাকাবাড়ি হয়েছে, দোতলা। কত
টুকরো স্বপ্ন, স্বপ্নের
খেওলা জালে পড়ে লাফাচ্ছে খালি। মামুন স্বপ্ন দেখে লক্ষ্মী পেছনের গর্তে পড়ে গোঙাচ্ছে খুব। গর্তের মুখে বসে
হাউমাউ করে কাঁদছে সে। বনদপ্তর থেকে লোকগুলো এল, বলল, আমাদের কাজ কমে গেল স্যার। আজ-কালের মধ্যেই কাম খতম। লক্ষ্মীর গোঙানী কাঁপিয়ে দিচ্ছে পাড়া,
কাঁপিয়ে দিচ্ছে হৃদয়! ঘামছে সে। ঘুম ভাঙে। হাঁপাতে
থাকে, ভীষণ। বাইরে আসে। লক্ষ্মীর ঘরে যায়। দেখে দূর থেকে। মাটিতে বসে পড়ে মামুন। লক্ষ্মীর শুঁড়ে হাত রেখে হাউহাউ
করে কাঁদে। রাবেয়া
উঠে আসে ঘুম ফেলে। কাঁধে হাত রাখে মামুন মিয়াঁর। রাবেয়ার হাতটা ধরে মামুন বাঁধ ভেঙে ফেলে।মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় রাবেয়া,
শক্ত হও কলাম, না-হলি মাজায় দড়ি বেঁধি নে যাবে কইচে ! শক্ত হও, সব ঠিক হোয়ে যাবেনে।
চার
‘বিছানায় শুয়ে ভাবো কাকে কাকে খুন করেছিলে
কার ঘড়ি কেড়েছিলে? কার দিকে
তুলেছ আঙুল?
যাদের ধাক্কা দিয়ে সিঁড়ি থেকে নীচে নামিয়েছ
সেইসব ধাপ ধরে তুমিই প্রত্যহ নেমে যাও’
অসমের
বুনোহাতিটা নদীর জলে ভাসতে ভাসতে চলে এসেছে বাংলাদেশ। কুড়িগ্রাম,
গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া হয়ে
সিরাজগঞ্জের সিন্নার চরে। এই দেশেই চারশো কিলোমিটার ঘুরেছে। চরের মানুষজন আতঙ্কিত,
কখন যে আক্রমণ করে ! এখানে সে উদ্বাস্তু। মাঠের পর মাঠ ধানগাছ খেয়ে ফেলছে নিমেষে। বিশাল চর, বড় বড়
ঘাসে ঘেরা জলাভূমি, সেখানেই
হাতি আছে বেশ।যদিও থাকার জায়গা এটা নয়, সে থাকে বড় বড় বৃক্ষের মাঝে, ঘন জঙ্গলে, দলবল
নিয়ে। দলবল? সে দলও
নাই, বলও নাই?
জোর যার, মুলুক তার ! এ-মুলুক এখন
আর হাতিগো নাই! হয়তো পালাতে পালাতে যখন সে তৃষ্ণার্ত, যখন স্রোতের পাশে দাঁড়িয়ে
খুঁজেছে জীবন, আর ঠিক
তখনই সেই স্রোত তাকে নিয়ে এসেছে এখানে, অনেক দূরে, ধরা পড়তে
পড়তেও বেঁচে গেছে মৃত্যুর কান ঘেঁষে।
যমুনার তীরে বিপুলা চর। বর্ষায় অনেকটাই ডুবে যায়। তবু যেসব গরিব ভূমিহীন মানুষ
অনেক আশা বুকে নিয়ে নৌকো নিয়ে এখানে এসেছিল, আজও আসছে একে-একে, খুঁজে
বেড়াচ্ছে নিজ জীবন, এখানেই। যেন সাগরের মাঝে ছোট্ট এক
পিঁপড়ের বাসা ভেসে এসেছে জলে। আর পিঁপড়েগুলো বাঁচার চেষ্টা করছে খুব শুধু
প্রকৃতির সঙ্গে লড়ে। ঝড়-বৃষ্টি-তুফান
এলেই আতঙ্কে থাকে তারা। এগুলোর নিত্য আনাগোনা এখানে, খাবারের যদিও নয়। চরার মানুষেরা খড় দিয়ে কিংবা দূর ভূমি থেকে টালি-টিন-বাঁশ এনে বানিয়েছে ছোট্ট গ্রাম। এখানে কোনও বাজার নাই, স্কুল নাই, ডাক্তার
নাই। এসবের খোঁজে যেতে হয় বহুদূর, নৌকোয়। এইসব মানুষের কান্না শোনার কেউ নেই, বলারও কেউ নেই। বিপুল ভোটে জেতা মেম্বার আছে, মন্ত্রী আছে দূর চেম্বারে, জনগণের টাকা আসে জনকল্যাণে, কল্যাণ হয় অন্য কারও। বুলেটবাড়ি ক্ষেপে উঠেছে আজ হাতিদের নির্মূল করতে,
রোহিঙ্গাদের খতম করতে সু চি-র উদাসীনতা, আর এইসব নিকারীদের জন্য আছে বাছাই বাছাই মেম্বার। আবু হানিফ,
এখানের রাজা।
--রাজা?
--রাজা মানেই তো জন্মদিন, তাই না দুলাভাই?
--হয়।
--আর জন্মদিন মানেই...
--গরিবের রক্ত !
--চুপ চুপ, দ্যাখ কী হয়।
--আইচ্চা আলিবাবা।
পিঁপড়েদের
দেশে গালিভার।
চৌদিকের অনন্ত জল থেকে উঠে আসা সূর্য কিংবা ডুবন্ত সময়,
জলে পাকা আমের ছায়া-কায়া-মায়া, লালে মাখামাখি নীল রং, আকাশে,
সেখান থেকে পাখির শব্দে অনন্ত বাদামি পাতার পতনে রাক্ষসও
দেবতা হয়ে যায় বুঝি প্রকৃতিমোহে। এরই মাঝে সবুজ ঘাসের মাদুর জলের গোপনতা ঢেকে
রেখেছে আদরে।
আজ হাতিটি দূর থেকে ভেসে এসেছে তাদের আরও কাঁদাতে। ফসল খেয়ে ফেলছে রোজ,
পায়ে পায়ে নষ্টও করছে অনেক।
‘বুলবুলিতে ধান খেয়েছে/ খাজনা
দেবে কীসে?’
চারিদিকে ভয়, বুনোহাতি
কখন যে ঘরগুলোকে পিষে দেয় পায়ের চাপে, গায়ের ধাক্কায়।
রাতে ঘুম আসে না কারও।
পাঁচ
‘হাওয়াকে বলিনি, তাই
পরবর্তী হাওয়া ছুটে আসে...
জলের মহিমা এই---
সে অনিয়ন্ত্রিত...’
যে
পিঁপড়েগুলো ছানাপোনা সমেত ‘সকল দেশের
সেরা’ ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’
থেকে ঘোর বিচ্ছিন্ন, মূল ব্যথা-বেদনা-যন্ত্রণা-রক্তচাপ থেকে বঞ্চিত, তা যেন মুহূর্তেই ভিন্ন মাত্রা
পেয়ে গেল দূরবর্তী হাতির আগমনে, আর তার খবরগন্ধে চলে আসা একটি স্যাটেলাইট চ্যানেলের দুই সাংবাদিকের। সারাদিন
ছোটে তারা হাতির পিছু পিছু, আর তাদের
পিছু পিছু বিপুল জনগণ।হাতি বিরক্ত হয়, পালায়
অন্য জায়গায়, তেড়েও আসে
পথের খোঁজে, ভয়ে তখন
ছত্রভঙ্গ এক অক্ষোহিনী সেনা ! কাদায় লুটোপুটি সজল আলো,
প্রযত্নে: তরুণ সাংবাদিক, ইউ টিভি।
খবর পেয়ে দূর-দূরান্ত
থেকে ট্রলার চেপে লোক আসে,
রাতারাতি ছোটখাটো মেলা বসে যায় চরের মাঠে,
মানুষের পায়ে-পায়ে ফসল নষ্ট হয়। গাছে গাছে বড়-মেজো-সেজো-নুয়া-ছোট-বুড়ো-জোয়ান বাঁদরের মতো ঝুলে থাকে হাতি কিংবা মানুষের তামাশা দেখার লোভে। রাতের
বেলা ছোট টিভি চালিয়ে দুই জাদুকর দেখায় হাতি, দেখায় হাতির পেছনে লেগে থাকা
পিপীলিকাদের, যারা টিভি
দূরে থাক, কস্মিনকালেও ভাল ভাবে আয়নায়
নিজেদের মুখ দেখার সুযোগ পাইনি খুব একটা।গালিভারের পেছনে নিজেদের ছোট পরদায় দেখতে
পেয়ে সে কী আহ্লাদিত! রহমত
চাচার তো বত্রিশ খান ভাঙা চাঁদ বেরিয়ে এল!
তাদের জীবনে চাঞ্চল্য এল, রোমাঞ্চ
এল এতদিন পর তবে।
ছয়
‘বনানীকে মাঝে মাঝে সমুদ্রের মতো মনে হয়। সবুজ জলরাশির গভীর
থেকে
কেবলই সারিবদ্ধ শব্দগুলি উঠে আসে। আর চোখের সামনে কেবলই
একটি একটি
করে শব্দের মৃত্যু হতে দেখি।’
ঘুম ভাঙে। এক দল লোক আসে। প্রায় পঞ্চাশ জন বন্দুকধারী। সঙ্গে অফিসার। জিজ্ঞাসা করে,
মামুন কোথায়? রাবেয়া মাথা নাড়ে। মামুন নাই! এ-ওর মুখ
চায়। রাবেয়া শুধু জঙ্গলের দিকে ইশারা করে। মহিলা রেঞ্জার সপাটে গালে চড় কষায়। ছিটকে পড়ে রাবেয়া।
ঘন জঙ্গল।
রাবেয়াকে সঙ্গে নিয়ে নেমে পড়ে আধাসেনা ও বনবিভাগের রেঞ্জার। খোঁজ খোঁজ আর খোঁজ। একটা পথহীন
ঘন জঙ্গলে খোঁজ। দিনের আলোও ঘন সবজে-কালো। হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত দল, ক্লান্ত রাবেয়া বিবি। মাঝে মাঝেই পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু ব্যথাটা মনে পড়লেই গালে হাত দিয়ে উঠে পড়ছে ঠিক। এই ওঠার ফাঁকেই চোখে-চোখ সেই রেঞ্জারের। ভয়ে বুক শুকিয়ে আসে।
তিনদিন খোঁজার পরও টিকি খুঁজে পাওয়া যায় না মামুনদের। সেনাবাহিনীর সাহায্য চাওয়া হল
শেষে। হেলিকপ্টার
আসে, সেনা আসে,
টহল দিতে থাকে আকাশপথ। আকাশ জুড়ে এখন শুধু যন্ত্রমেঘ,
গর্জায় ভীষণ, একটু পর বর্ষাবে।
এ জঙ্গল মুখস্থ মামুন মিয়াঁর। বাঘ-সিংহ-চিতার ভয় পেরিয়ে ঘন থেকে আরও ঘন জঙ্গলে ক্রমশ এগিয়ে চলেছে। গাছে-গাছে হনুমান-পাখি-সাপ সতর্ক হয়ে দেখে কারা আসে, উপরের দিকে চায়,
মাথা নাড়ে। কোটরে বসে পেঁচাগুলো ভয়ে কাঁপে।
যন্ত্রমেঘ গর্জায়, বর্ষাবে
কিছু পরে।
রাবেয়া জানে কোথায় যেতে পারে মামুন। সেই সূত্র ধরে একটা ফাঁকা জায়গা ঘিরে ফেলে সেনাবাহিনী। না,
কোথাও চিহ্ন নেই তাদের। কয়েক ঘন্টা এলাকাটা তছনছ করার পর
ফিয়ে যাবে, ঠিক তখনই
রাবেয়া ফিরল, পেছনে। একটা সবুজ ঢিবির দিকে আঙুল তুলে
বলল, ওই ওই!
সবার হাতে রাইফেল। ফটাফটা ঘিরে ফেলল ঢিবিটা। ফায়ারিং হবে, এক্ষুনি !
হঠাৎ কোথা থেকে মামুন লাফিয়ে পড়ে সাহেবের পা জড়িয়ে ধরে। ‘বাবু, আমার মাইয়াডারে মারবেন না! বাবু...’
রাত নামছে।
জঙ্গল থেকে দ্রুত বেরোনো দরকার।
সাত
‘মৃত মানুষের স্তূপ সরিয়ে খুঁজি সেই স্নানাগার
যার গভীরতা তুমি সবিস্ময়ে উন্মোচন করেছ মধ্যরাতে।’
পিলখানার
হাতিটিকে নিয়ে আসা হল অন্য ঘরে। চারটি পা বাঁধা হল থামের সঙ্গে। পিঠে-ঘাড়ে ছোট-ছোট ধাতব হাত, আদর করবে যেন। বড় ক্লিপের মতো
কিছু একটা মুখটা আটকে দিল। ব্যস।
রাজামশাই সিংহাসনে। নব্বইতম জন্মদিনের আয়োজন চলছে দেশে। শহরের পথে পথে গ্রামের
পথে পথে মোড়ে মোড়ে বড় বড় ফানুস, বড় বড় মোমবাতি, মহারাজার
ছবি, পেল্লাই সাইজের কেক। দেশে খাবার
নেই, কেক আছে,
ক্যান্ডেল আছে, কাতারে কাতারে মানুষের জন্ম আছে, আর রাজার জন্মদিন আছে। পানীয় জল নেই, গরিবের রক্ত আছে। কলম নেই, বন্দুক আছে, ত্রাস আছে,
সন্ত্রাস আছে। হাসপাতাল নেই কাছে-পিঠে, এইড্স
আছে, ইবোলা আছে,
জিকা আছে, অনাহার আছে, স্কুলের
শিশুদের ভিক্ষার জন্য লম্বা লাইন আছে। গরিবের বের-করা ক’খানি হাড় আছে, হাড়খাটুনি
আছে। টাকা নাই,
বেতন নাই। আদেশ না-পালনে
মৃত্যু আছে।কবর নাই, শকুন নাই।
ভিক্ষার লাইন থেকে উঠে এল মারিও টিকোলো, সঙ্গে বন্ধু ডেভিড, গালভরা
নাম তাদের। উঁকি
মারছিল ঘরখানায়, গাছে উঠে।
সুইচ অন হতেই ধাতব হাতগুলো তবলা বাজানোর মতো বাজাতে লাগল ধাঁই ধাঁই ধাঁই! মিনিট পাঁচেকের মধ্যে নেতিয়ে পড়ল হাতিটা। মারিও কান্না
রুখতে পারল না আর। যে পিঠে চুমু খেত আদরে, সেখানে শত শত খুনে হাত নেমে আসছে মুহুর্মুহু। গাছ থেকে নেমে উন্মাদের মতো
ছুটতে থাকে সমুদ্রের দিকে। পেছনে ডেভিড। বিকেলের অর্ধমৃত আলো মানুষের আশা- আকাঙ্ক্ষা-ভালবাসার শবদেহ ঢেকে দেয় অজান্তে। হলুদ কান্নাও তখন চিরন্তন
রবিশংকর হয়ে যায়!
আট
‘এ বড় বিষম দিন ! আর্তনাদ
ঘিরে থাকে তাঁকে
চূড়া ছুঁয়ে আছে জল
তিনি ডুবো পাহাড়ের নীচে।’
নৌকোটা
ডুবে যাচ্ছে লতিফের, ঝড়ে।
ফিরছে সিন্নার চড়ে, হাট করে।
টাল খাচ্ছে, প্রবল
ঢেউয়ে।
তখন সন্ধ্যা হয় হয়।
আকাশ রক্তের মতো লাল, শিরার মতো
নীল দাগে ভরা, তার উপর
এলোমেলো তুলি, জীবনের,
আকাশ ও জলে। ঘাসের উপর এসে লাগে শেষ রৌদ্রকণা। ফিরতি পাখির
ডাকে কাঁপে অনন্ত জলধারা।
সন্ধ্যা হারিয়ে যায় অন্ধকারে।
আকাশে আলকাতরা মাখাচ্ছিল কারা? আকাশ থেকে কোন দৈত্য (দেবতা?) ফুঁ
দিচ্ছে জোরে? চরের
পিঁপড়েজীবন টলমল! হায়
আল্লাহ্ হায় ঈশ্বর! বিশাল ঘাসবনের পাশেই বুঝি সলিল সমাধি হবে আজ। পাড়ে যাবারো সাধ্যি নেই। লতিফ তো
আর একা না, সঙ্গে আছে রুকু আর তাঁদের ছোট্ট ছেলে মারুফ, বছর সাতেকের।
নৌকোটা তো ডুবেই যায়, কিন্তু এক
সময় সেটা স্থির হয়ে গেল জাদুবলে ! টলে না, নড়ে না! কী কাণ্ড! লতিফ দেখে
বিশাল অন্ধকারবপু নিয়ে কে যেন টেনে ধরেছে। রাক্ষস? তাহলে মৃত্যু অনিবার্য!
নৌকো ঘাসবনে রেখে তিনজনে ফিরল ঘরে, হাতির পিঠে, ভয়ে ভয়ে।
‘ভয় কীরে বাছা আমি তো আছি?’
প্রথমে মারুফ-কে শুঁড়
দিয়ে তোলে। রুকু বিবি জ্ঞান হারায় সে-দৃশ্য। শুঁড় তুলে জল ছিটিয়ে দেয় চোখেমুখে। রুকুর জ্ঞান ফেরে। শেষে একে-একে তুলে নেয় লতিফ ও রুকু-কে।
--হায় আল্লাহ, ফেরেস্তা পাঠালে তুমি !
ওঁদের চরার পথে নামিয়ে দিলে মারুফ শুঁড় ধরে টেনে নিয়ে যায় বাড়ি। চরের লোকজন
জড়ো হয়। হাততালি দেয়। কেউ কেউ এটাকে বাড়াবাড়িও ভাবে।
খবর যায় আবু হানিফের কাছে। ছুটে আসে।
খবর যায় ইউ টিভির কাছে। ছুটে আসে।
ওলটানো ছাতার মতো অ্যান্টেনা লাগানো হয় খোলা আকাশের নীচে। জ্বালা হয় ইলেকট্রিক আলো। ভটভট
করে বেজে ওঠে জেনারেটার। দুই জাদুকর নেমে পড়েছে ভেলকি দেখাতে।
লতিফ কলাগাছ কেটে খাওয়ায়। একটা শেকল নিয়ে আসে ঘর থেকে। মারুফ বাঁধা দেয়।
কিন্তু হাতিটি নিজে এগিয়ে এসে শেকলটি পরে নিতে চায় পায়ে। সে কি তবে থাকবে মারুফদের সঙ্গে?
হয়তো।
দুই তরুণ এবার জনগণ নিয়ে আসর বসিয়েছে। বুম নিয়ে এগিয়ে যায় একজন। চরবাসীরা মুখ
খোলে। মুখ দিয়ে হাওয়া বেরোয় শুধু, কথা বেরোয় না কিছুতেই। লতিফ এগিয়ে আসে, চিৎকার
করে বলে, ভাইসব,
হাতি আমাগো বাঁচাইচে, আপনাগেও বাঁচাবে। প্রাণের দায়ে আমাগো ধান খাইচে। হেইডা আমাগো শত্রু না। শত্রু
হইলো গিয়া আমাগো মেম্বার আবু হানিফ। আইজ শহরে গিয়া জানতি পারলাম আমাগো চরের
উন্নয়নে কত ট্যাকা পাডানো হইচিলো গেলো তিন বচ্ছর। বেবাক মেরি খাইচে হালার পো হালা।
হেইডা জাত শত্রু, কালসাপ! থ্যাঁতলা কোরি দিতি হবে কলাম !
এই প্রথম জনগণ বুঝতে পারল তাঁদের অধিকার। এই প্রথম বিদ্রোহ হল চরে। কাল সকালেই
সবাই মিলে দরবার করবে মেম্বারের বাড়ি গিয়ে। জবাব তাকে দিতেই হবে। সবাই লতিফের
পাশে। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে চরের খবর। চরের বর্তমান অবস্থার কথা,
উপেক্ষা-বঞ্চনার কথা। প্রশাসন নড়ে-চড়ে বসে।
নয়
‘শিকল দেখে আবার মনে পড়ল শব্দের কথা
শিকল
রূপান্তরিত জল, সব দর্শক
যখন অতীত
তখনও অনেক ভূমিকা থেকে যাবে
এই জল প্রকৃত শ্মশানবন্ধু,
এই জল রামপ্রসাদ সেন।’
শুভ জন্মদিন।
মাংস খেয়ে রাজা ঢেকুর তোলেন।
পানীয়
তুলে নেন ঠোঁটে।
নামিয়ে
রাখেন।
ঠোঁট টকটকে লাল।
রক্ত লেগে আছে।
শুভ
জন্মদিন।
রাত ন’টা।
লক্ষ্মীকে নিয়ে যাওয়া হল নদীর পাশে, বালুভূমিতে, বনপ্রান্তে।
আশেপাশের গ্রাম থেকে লোকজনও জড়ো হয়েছে বেশ। আলো জ্বেলে খাওয়ানো হল। স্নান করানো হল সাবান ঘষে। গোল
বাধল কোরান না গীতা পড়া হবে। একজন ঠাকুরমশাই আর একজন মৌলবিসাহেব এলেন। লক্ষ্মী,
অতএব হিন্দু। মামুন-রাবেয়ার মেয়ে, অতএব মুসলিম।
--কোরান পড়ো, গীতা পড়ো,
যদি পারো মাইয়াডারে বাঁচানোর মন্তর পড়ো,
বেহেস্তে পাঠানোর কিছু পড়ো। মাইয়ার আবার জাত
কী? যদি পারো পাখির গান ধরো,
পাতার গান ধরো, নদীর গান বিষ্টির গান ধরো! বলতে বলতেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে মামুন।
কালো কাপড় বেঁধে দেওয়া হল লক্ষ্মীর চোখে। রাবেয়া ও নাদেরের চোখেও কালো কাপড়। দশটা বন্ধুক লাফিয়ে উঠল একসঙ্গে।
রুমাল হাতে একজন।
ঘড়ির কাঁটার দিকে চোখ।
একটু পরে ফায়ার...
ধাঁ ধাঁ
ধাঁ...
এমন সময় লক্ষ্মী ভূপতিত। সবাই ছুটল সেদিকে। মামুন রাবেয়া চোখ খুলে দেখে লক্ষ্মী পড়ে আছে। ভাবল মারা গেছে। তাই ঠায় দাঁড়িয়ে দূরে।
ডাক্তার এগিয়ে আসে। কিছুক্ষন পরীক্ষার পর বলে, প্রেগন্যান্ট!
--হোয়াট?
--ইয়েস, অ্যান্ড অ্যাকরডিং টু দ্যা পলিসি,
উই কান্ট কিল আ প্রেগন্যান্ট এলিফ্যান্ট।
--ও সিট!
মামুন আলি
এর কিছুই বোঝে না। দেখে রাবেয়ার মুখ ভার। এক লাখ পাওয়া যাবে না কথা বলে বুঝল। বন্দুকধারিরা ফিরে যায়। লোকজনও। মামুন
দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে লক্ষ্মীকে।লক্ষ্মী শুঁর বুলিয়ে দেয় মামুনের সারা শরীরে।
লতিফের বাড়ি ঘিরে ফেলেছে হাজার হাজার লোকজন। হুলাপার্টি। হাতে মশাল।
--এই লতিফ বেইরা হারামির ছাওয়াল, বুনোহাতি পুইষা লুকের ধান খাওয়াও! দে আগুন লাগায়ে দে ঘরে। হাতি-লতিফ
বেবাক মরুক আইজ!
--উস্তাদ,
মোছলমানেরে পুড়ায় মারবা?
--হারামির আবার জাইত আছে নাকি? আগুন লাগা বেজাতরে।
লতিফ-রুকু মারুফ-কে কোলে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে আসে। হাত জোর করে কিছু একটা বলতে
যায়। তার আগেই আগুনের গোলা এসে পড়ে ঘরে, গোলায়। আবু হানিফের তখন দশটি
মাথা, হা হা হা করে হাসতে থাকে আর
ক্রমশ বড় হতে থাকে অবয়ব। চারিদিকে রাক্ষস সেনা। হাতে মশাল,
ছুঁড়ছে বৃষ্টিধারায়।
হাতিটি হ্যাঁচকা টান দিয়ে শেকল ছিঁড়ে আকাশভাঙা চিৎকার দিয়ে রাক্ষসদের
মুহূর্তেই ছিটকে দূরে সরিয়ে দেয়। শুঁড় বাগিয়ে ছুটে যায় ঘরের দিকে,
গোলার দিকে। পাশের জলা থেকে শুঁড় দিয়ে জল তুলে নেভায়।
আগুনের গোলাগুলো শুঁড় দিয়ে ধরে ছুঁড়ে মারে রাক্ষসদের। শেষে আগুন নিভে গেলে উন্মাদের মতো ছুটে যায়
দশাননের দিকে। দশ মাথা খসে যায় আকাট ভয়ে। বিপুল রাক্ষসসেনা মুহূর্তেই ছত্রভঙ্গ।
দূর থেকে রে রে করে লাঠিসোঁটা নিয়ে তেড়ে আসে চরের শুভ মানুষেরা,
তাঁদের লফিত রাক্ষস-আক্রান্ত !
যুদ্ধ, তুমুল
যুদ্ধ !
পিছু হঠে হুলাপার্টি।
নৌকো করে আসে, নৌকো করেই
পালায়। সঙ্গে আবু হানিফ।
হাতিটি ছোট্ট মারুফের সামনে উবু হয়ে বসে আদর করে খুব। মারুফ ছুঁয়ে দেখে পুড়ে
গেছে শুঁড়। চোখে জল, বিপুল
প্রাণীটির ক্ষুদ্র দুটি চোখে, মামুনের, লতিফের,
রুকুরও। শুভ চরবাসী দূরে দাঁড়িয়ে কেড়ে নেওয়া মশাল হাতে নিয়ে। হইহট্টগোল এখনওকিছুটা,
যুদ্ধ জয়ের।
হাতিটি উঠে পড়ে। সামনে দাঁড়ায় মারুফ। কাঁদে। শুঁড় দিয়ে সরিয়ে দেয় একপাশে। চরা
ছেড়ে দেয় দ্রুত। জলে নামে। সমুদ্রের দিকের জলপথ ধরে।
সমুদ্র?
পেছনে দাঁড়িয়ে শিশুটি। কান্নায় ভেসে যায় চরাচর।
পেছনে দাঁড়িয়ে লতিফ-রুকু-আর বিপুল
মানুষ। চোখে জল।
ঘুম থেকে দূর থেকে উঠে কাদা ভেঙে চলে এসেছে দুই তরুণ সাংবাদিক। চোখে জল।
হাত তুলে টাটা দেয় মারুফ।
শুঁড় তুলে ধরে হাতিটি।
লতিফ-রুকু-শুভ চরবাসীরাও, তুলে ধরে তাঁদের বিজয় মশাল।
কবি অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত
‘হৃৎপিন্ড’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় । লেখক ঋণ স্বীকার করেছেন -
১. যেসব কবিদের বিভিন্ন কবিতার পঙ্ক্তি এখানে ব্যবহার করা হয়েছে।
২. গল্পটির নামকরণ বের্টোল্ট ব্রেখটের ‘দ্য থ্রি পেনি অপেরা’ থেকে নেওয়া।
১. যেসব কবিদের বিভিন্ন কবিতার পঙ্ক্তি এখানে ব্যবহার করা হয়েছে।
২. গল্পটির নামকরণ বের্টোল্ট ব্রেখটের ‘দ্য থ্রি পেনি অপেরা’ থেকে নেওয়া।
৩. অবশ্যই 'হৃৎপিণ্ড'।