দেশের
ছবি
দৌড়টার
মধ্যে একটা অদ্ভুত ছন্দ আছে। পেশীবহুল বাদামী শরীরটা তালে তালে দুলতে থাকে,
হাওয়ায় উড়তে থাকে অবাধ্য কেশর। খটাখট ক্ষুরের শব্দটা একটু একটু
করে তীব্র হয়। নড়বড়ে কাঠের বাক্সটার উপর উঠে দাঁড়ায় মইন। হাঁটু ভেঙে, কোমরটা পিছনদিকে ঠেলে, সামনে খানিকটা ঝুঁকে
শিকারী বেড়ালের ভঙ্গীতে ওৎ পেতে দাঁড়ায়। প্রায় সামনে এসে পড়েছে। আজ পারতেই হবে। সময়,
পজিশন বুঝে, শরীরের সমস্ত শক্তি সম্বল
করে মরণঝাঁপ দেয় সে। আপাদমস্তক একটা ঝাঁকুনি খেয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে। ক্ষুরের খটাখট
শব্দটা মিলিয়ে যেতে যেতে বুঝতে পারে – আজও পারেনি! শ্লেষ্মাজড়ানো
গলার ঘড়ঘড়ে আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় সাঈদার। তেপায়ার ওপর রাখা বোতলটা এগিয়ে ধরে
ঘুমচোখে – জল খাইবা? - আর হইল না,
বোঝলা? এক ঢোঁকে বোতলের জলটুকু শেষ করে
বিড়বিড় করে মইন। - কী হইল না? - ঘুড়াটারে
ধরা অইল না আর! দশ বাই দশের খুপচি ঘরটায় একটা অজানা ভয়, দীর্ঘশ্বাস
আর নৈঃশব্দ্য তালগোল পাকিয়ে যায়। রাত ঘন হয় আরো। ঘুম আসে না চারচোখে। এবারের
বর্ষাটা কেমন আজব যেন! টানা চারদিন বৃষ্টিতে ভেসে গেল সব। অথচ আজ সকাল থেকে
চিড়বিড়ে রোদ, গা-গতর জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। মইন দাওয়ায় বসে
হাঁফাতে হাঁফাতে একঝলক হাওয়া খোঁজে। গত কয়েকদিনের মত আজও সকাল হতেই তন্নতন্ন করে
হাটকেছে ভাঙা ট্রাঙ্ক আর তেলচিটে হয়ে যাওয়া পোঁটলাদুটো। কিছুই বেরোয়নি, কেবল ঐ হুটোপাটিতে হাঁফ ধরে গেছে তার। দাওয়ায় হাতপা ছড়িয়ে বসে মরা
বাপকে বিড়বিড় করে গাল পাড়ে সে। - পাইলা কিছু? - হুর! কুথাও কিছু নাই! একখান কাগজও রাইখ্যা যায় নাই হালার পো! - পাইবা না। ছাড়ান দাও। কইয়া দাও কিছু নাই। বলতে বলতে সাবধানে ভাতের মাড়
গেলতে থাকে সাঈদা। - হ! তুমার আর কী! চিন্তা নাই, ভাবনা নাই! ভাইত রান্ধতাছে, গিলতাছে, ঘুরতাছে! ইদিকে দ্যাশের ঠিক নাই! শরম লাগে না? মইনের সবটুকু রাগ এবার গিয়ে পড়ে বউয়ের উপর। - না
নাই! আমার দ্যাশ তো এই সংসার! তুমি আমি যেইহানে, দ্যাশ
সেইহানে! মুখ টিপে হাসে সাঈদা। ভাঙাচোরা গালে এখনও টোল পড়ে তার। মইন নির্বাক হয়ে
তাকিয়ে থাকে – বুরবাক মাইয়ামানুষ! সাহাদের পুকুর পেরিয়ে
বিশাল কদমগাছটা মইনের অনেককালের প্রিয়। হাঁটতে হাঁটতে এসে আয়েস করে বসে পড়ে
ভিজেমাটির উপরেই। বাপের সঙ্গে বসে কত গল্পগাছা করেছে এই গাছতলায়। পাশের ছোট্ট
শনিমন্দিরটা ভেঙে পড়েছে বছরদশেক আগে। সামনের মাঠটার ওপারেই হলুদরঙা বাড়িটা দাঁড়িয়ে
আছে ভূতের মত। পঞ্চায়েত অফিস। রাত পেরোলেই শিলচর থেকে এসে পৌঁছবে বাবুরা, সকাল থেকে মানুষ ভেঙে পড়বে। গোটা বাঁশকান্দি জুড়ে এ’কদিন সাজো সাজো রব। গ্রামসুদ্ধু লোক হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে
দলিল-দস্তাবেজ। যা পাচ্ছে তাই নিয়ে ছুটছে সদরে। নজরুলের জেরক্সের দোকানে দিনরাত
লেগে আছে ভীড়। - কই গো মাস্টারচাচা? খপর কী? বইয়া আছো যে! কাগজ রেডি? হাঁকডাকে ঘোর কেটে যায়। সাহাবাড়ির ছোটছেলে, দিবাকর।
- ন্নাহ্। তগো খবর কী? মুখ না তুলেই
প্রশ্ন করে মইন। - হ হ! পাইছি খুইজ্যা। পোস্টাপিসের রসিদ,
বাপের নামে! লিস্টির পোঙা মারুম কাইল। তোমার ইস্কুলের কুনো কাগজ
নাই, চাচা? - আছে রে বাপ,
পঁচাত্তরের। কাম হইব না। দিবাকর দাঁড়িয়ে ভাবে কিছু, তারপর দুদিকে মাথা ঝাঁকিয়ে হাঁটা দেয়। বাড়ি ঢোকার মুখে থমকে দাঁড়ায়
সাঈদা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল প্রায়। মানুষটার দেখা নেই। কদমতলা পেরিয়ে খুঁজতে
খুঁজতে সোনাইয়ের ঘাটতক দেখে এসেছে। কোথাও নেই! পাগল পাগল হয়ে গেছে লোকটা! নাওয়া
নেই, খাওয়া নেই, সারাদিন আদাড়ে
বাদাড়ে ঘোরে। স্কুলটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর, দুবেলা বাড়িতে
পড়াতো। সে সব চুকেবুকে গেছে কবে! চুয়াল্লিশ বছর ধরে ঘর করছে, অথচ এমনটা দেখেনি সে আগে। কে জানে কী আছে খোদার মনে! উঠোনের এককোণে
একটা খাম পড়ে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল সাঈদা। তুলে নিয়ে খুলতেই হায় হায় করে
উঠে কপালে ছোঁয়ালো একবার। - দ্যাখছো কান্ড! এইডারে
ফ্যালায়ে থুইছে! দাওয়ায় বসে ভালো করে দেখতে থাকে এবার। প্রায় ধূসর হয়ে যাওয়া ছবি,
তবু সবার মুখ চেনা যায়। সাহাবাড়ির সামনে তোলা বোধহয়। একজন ছাড়া
কেউ বেঁচে নেই আর। ছবিটাকে বুকে চেপে ধরে পার্ব্বতী। চেনা, খুব চেনা গন্ধ এসে লাগে নাকে। এই উনষাটেও বুক কাঁপে, তিরতির করে। মইনকে গুটিগুটি পায়ে ঢুকতে দেখেই ছুটে যায় সে। ছবিখানা
বাড়িয়ে ধরে দুহাতে। - এইডা ফ্যালায়ে দিছিলা ক্যান?
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মইন। অধৈর্য হয় সাঈদা। - কী হইল? কথা কওনা ক্যান? এইডায় কাম হইব না? ছবিটা হাতে নিয়ে চোখের খুব
কাছে আনে মইন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, আঙুলে ঘষে তুলতে
থাকে অদৃশ্য ধূলো। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মাথার ভিতর বেজে চলা ঝিঁঝির শব্দ থেমে গিয়ে
একটা চেনা শব্দ ফিরে আসে আবার। খটাখট খটাখট ক্ষুরের শব্দটা এগিয়ে আসছে ক্রমশঃ।
পারবে মইন? ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ জড়ো হয়েছে অফিসের সামনে।
দুদুটো গ্রাম ভেঙে পড়েছে আজ যেন! লম্বা সাপের মত দুটো লাইন এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে
সামনের দিকে। গায়ে গায়ে লেপ্টে আছে আরো কিছু মানুষ। হইহল্লা, শোরগোলে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়। সাঈদাকে মহিলা লাইনে দাঁড় করিয়ে
মাথা গোনার ব্যর্থ চেষ্টা করে মইন। কয়েকটা ছোকরা মতন ছেলে মাতব্বরি করে লাইন ঠিক
রাখার চেষ্টা করছে। - তাড়াহুড়া কইরেন না। হক্কলরে ডাকা
হইব। কুনো চিন্তা নাই। বুকে হলদেটে হয়ে যাওয়া একটা খাম চেপে ধরে গুটিগুটি পায়ে
লাইনে দাঁড়ায় মইন। চেনামুখগুলো খুঁজতে থাকে এদিকওদিক। ঠিক তখনই এগিয়ে আসে আদিনাথ।
একই ইস্কুলে ছত্রিশ বছর মাস্টারি করেছে দুজন। বাঁশকান্দি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেই
ইস্কুল ভেঙে তৈরী হল এই পঞ্চায়েত অফিস। নতুন ইস্কুল তৈরী হল বাজারের পিছনে। নতুন
মাস্টাররা এল শহর থেকে। বাতিল হয়ে গেল বুড়ো মইন, আদিনাথরা।
সেই আদিনাথ এখন পঞ্চায়েতে উপপ্রধান। - আরে মইনভাই! এই লাইনে
দাঁড়াইছো ক্যান? বুড়া মানুষদের অন্য লাইন। আইসো আমার লগে।
হাতটা চেপে ধরে টানতে থাকে আদিনাথ। টেবিলের ওপারে তিনটে লোক। একটা জাবদা খাতা আর
একতাড়া কাগজ নিয়ে বসে আছে। আদিনাথ টেনেহিঁচড়ে সামনে এনে দাঁড় করায় মইনকে। -
নাম? - মইনুদ্দিন কিবরিয়া। - বয়স? - ছয়ষট্টি হইব বুধয়। - ঠিকানা? - বাঁশকান্দি পয়েন্ট টু। - দেখি কী এনেছেন? কাঁপা হাতে খামটা বাড়িয়ে ধরে
দাঁড়িয়ে থাকে মইন। মাথার ভেতর খটাখট শব্দটা তীব্র হয়ে ঘা মারতে থাকে বুকে।
- এটা কী? খামটা খুলে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে
থাকে তিনজন। - ছুবি! ভালো কইরা দ্যাহেন! উত্তেজনায় টেবিলের
ওপর ঝুঁকে পড়ে মইন। ঘোলাটে চোখদুটো চকচক করে। - কীসের ছবি?
- এইডা আমার বাপ, গুলাম কিবরিয়া,
এই হইলাম আমি, ছুডো দুইটা দুইবোন।
তেরাশির দাঙ্গায় মাইরা ফ্যালাইছে ওগো। আর ঐডা আমাগো মা আমিনা কিবরিয়া! - তো? এতে কী হল? খেঁকিয়ে
ওঠে টাকমাথার লোকটা। - মা মারা গিছেন আটষট্টি সনে। ঐ
বৎসরেই উঠাইছিল ছবিডা। - এতে কী প্রমাণ হল চাচা? গুঁফো লোকটা হেসে ফেলে এবার। - পিছুনে দ্যাহেন
কত্তা, পিছুনে! হুই কদমতলা আমাগো দ্যাশ, হুই শনিমন্দির আমাগো দ্যাশ! হুই সাহাবাড়ির দালান, ঐডার পিছুনে আমাগো ঘর, আমাগো দ্যাশ! এইবার কন
কত্তা! - ধুর বাল! তারিখ কই? প্রমাণ
কই? কাগজ কই? কাগজ? টোকা মেরে খামসুদ্ধ ছবিটা ফেলে দেয় লোকটা। এগিয়ে এসে কাঁধটা ধরে
আদিনাথ। - চিন্তা কইরো না মইনভাই! কিচ্ছু হইবো না। সব ঠিক
হইয়া যাইবো গিয়া। চলো, বাইরিয়া যাই। বাইরে এসে অফিসটার
দিকে ঘুরে দাঁড়ায় মইন। একদিক দিয়ে পিলপিল করে ঢুকছে মানুষ, অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে আসছে। মাথা আর মাথা। খুঁড়ে মরছে সব অথচ দেশ খুঁজে
পাচ্ছে না কেউ। একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে মুখে। লাইন থেকে ইশারায় ডেকে নেয়
সাঈদাকে। - কী হইল? যাও কই?
ঘামে ভেজা মুখে ফুটে ওঠা উৎকন্ঠাটুকু চোখ এড়ায় না মইনের। হাতটা
নিজের হাতের মধ্যে টেনে নেয়। - চলো! আমাগো দ্যাশে যাই
আমরা। - সেইডা আবার কুনখানে? অবাক
হয় সাঈদা। - হুই যে! দ্যাহো না? তুমার
দ্যাশ, আমারও দ্যাশ। ভাঙাচোরা গালে টোল পড়ে এবার। হেসে
ওঠে দুজনেই। চলতে চলতে লজ্জার মাথা খেয়ে শুধোয় মইন – বউ!
আইজ ভাইত রাইন্ধছনি?