গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১২ আগস্ট, ২০১৮

দীপলেখা মুখার্জী

সুর্মা 

সুর্মা, জন্মের পর মা বাবা নাম দিয়েছিল বটে। ময়াল সাপের মতো কালো ছিপছিপে চকচকে ভরন্ত চেহারার বছর একুশের সুর্মা।টানাটানা কাটা কাটা চোখ, মুখ। কালোর এত জৌলুষ যখন,তখন সুর্মা ছাড়া আর কিইবা নাম হতে পারত? বুকেরপাটায় সাহসও ছিল বাঘিনীর মতো। পাশ দিয়ে কেউ ফুটকাটলে, কোমড়ের উপর থেকে মাথা পর্যন্ত ঘুরিয়ে, সাদা ঝকঝকে দঁাতের ফঁাকে জিভ আটকে,"শালা, হিম্মত হ্যয় তো, সামনে আ, পিছে কিউ বোলতা হ্যায় রে?" বলে যেই ঘুরে দাঁড়াত,  ওয়াগানবেকার কোমরে চাক্কু নিয়ে ঘুরনেওয়ালা, তাজুর ও সব হিম্মত শুকিয়ে ছোট হয়ে যেত। 

কারুর দরকারে ঝঁাপিয়ে পড়ত কে?এই সুর্মা। ছাগলের জন্য তরতর করে,কাঁঠালগাছের মগ ডালে অনাযাসে উঠে যেত সুর্মা। কৌশলার বাবার রাত বিরাতে বুকে ব্যাথা উঠলে,কে ভ্যানরিক্সা চালিয়ে সদর হাসপাতালে নিয়ে গেছিল? এই সুর্মা। সারাদিন রাজমিস্ত্রির যোগার খেটে বাপ মায়ের ছোট ভাইএর পেট ভরাতো সে। কোনো মাইকে লালের হিম্মত ছিল না,ওর দিকে ফিরে তাকায়।পেছন থেকে সবারই নজর ওর উপর আছে, তা সে জানত। 

সামনের জি. আর. পি এর ব্যারাকে প্রায়ই জাম পাতা, কয়েতবেল চুরি করতে যায় সুর্মা।সকাল ১১/১২ টার সময় ব্যারাক ফাঁকা থাকে। সে দিনও গেছিল।জানতো না,মরন লেখাছিল কপালে। কয়েৎবেল গুলো কোচড়ে ভরে, লেবু গাছটার দিকে হাত বাড়াতেই একটা শক্ত হাত ওর হাতটাকে পিছমোড়া করে ধরে ফেলল, কানে এলো "শালী চোরনি,লেবু চুরি করছিস?" সুর্মা কোনরকমে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে সেই যে দেখল, সেখানেই মরল মনে হয়।টকটকে ফর্সা রং, মোটা গোঁফ, পাতলা লাল ঠোঁট  তারচেয়ে প্রায় এক হাত লম্বা পেটানো চেহারা, চোখে ঘোর লাগার জন্য এইটুকুই যথেষ্ট ছিল।মন বলল, এইভাবেই তাকে ধরে থাকুক, কোঁচড় থেকে চারটে কয়েৎবেল গড়িয়ে পড়ল। হাতটা ছাড়িয়ে সেই যে দৌড় দিল, সোজা পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে,বার তিনেক এপার ওপার সঁাতরে দম নিল সুর্মা। তারপর থেকেই কি যেন হয়েছিল গেল,  মা বলতো জিনপরী তে ধরেছে তাকে, সারাক্ষণ ওই ব্যরাকের চারপাশেই ঘুরঘুর করত মনটা। মাঝে সাঝে দেখতে পেত সেই সাহেবের, মনে হত পুলিশের এই সাজ ওকেই মানায়। হঠাৎ ই একদিন চৌকিদার তাকে ডেকে, নিয়ে গেল বলল, "তোকে বিশাল সাহিব বুলাচ্ছে, আমার সাথে চ"। চৌকিদারটা কে একদম সহ্য করতে পারে না সে। কিন্তু নামটা যখন 'বিশাল সাহেব' সুর্মার না করার জোর কোথায়?!গিয়ে দেখল, খাটিয়ায় বসে আছে সাহেব। তার সাথে,  আরো চারজন। 
তিনদিন ধরে সুরমার খোঁজ নেই, মা এক নাগাড়ে কেঁদেই চলেছে, ল্যাংড়া বাপ দাওয়ায় বসে শূন্য দৃষ্টিতে আকাশে দেবতাকে খুঁজছে বোধহয়। পুলিশে রিপোর্ট ও লিখিয়েছে। তবু কেউ কোনো  খোঁজ পেল না মেয়েটার। হঠাৎ অনেক রাতে দাওয়ায়, ধুপ করে শব্দ! দরাজা খুলে বাপ দেখে , সুরমা!!! তুই!একি অবস্থা! সারা শরীর রক্তাক্ত। ঠোঁটের কষে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত, একটা চোখ বিভৎস রকম ফুলে আছে, কাপড় জামা শতছিন্ন। ওর মা দৌড়ে এসে জড়িয়ে কেঁদে উঠল। বাপ ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে  চাদর নিয়ে এসে ঢেকে দিল।
তারপর থেকেই জিন্দা লাশ  হয়ে বেঁচে রইল সুরমা। না কাঁদে, না হাসে, না কারুর সাথে কথা বলে। খালি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। অনেক চেষ্টা করেও কি হয়েছিল, বা কারুর নাম জানা গেল না। নয় মাস পরে একটা ছেলে জন্ম দিল সে।  কয়েক ঘরে বাসন মেজে, ছেলে কে বড় করতে লাগল, সবাই বলত,ওর বাপ কে রে সুরমা? এত রহিস আদমিদের মতো তোর ছেলের চেহারা!! সেই সময়, হ্যঁা কেবল সেই সময়ই সুর্মার মনে হতো, মা হয়েও ছেলেটার গলা টিপে দি।  অতটুকু বাচ্চাও মায়ের সেই দৃষ্টিটাকে ভয় পেত। বছর সাতেক পর সেই ছেলেও গেল। সুর্মা গেছিল বাসন মাজতে, তার বেটা একটা  কুকুর ছানা পুষে ছিল। খেলতে খেলতে একদিন কুকুরটা রেলগাড়ির তলায় ঢুকে গেছিল। তাকে বের করতে গিয়েই শেষ।  সবাই সান্তনা দিতে ছুটে আসলো, সুর্মা শুধু বলল, বদ রক্ত ছিল,বয়ে গেছে, ধুয়ে গেছে। তারপর থেকে সেই কুকুরটা কে খুব আদর করত সুর্মা। অনেক রাতে ভাত আর তার ছেলের প্রিয় আলুর চোখা থালায় করে রেল লাইনের ধারে দিয়ে আসতে এখনো দেখা যায় সুর্মা কে।

খালি তাকে সুর্মা নামটা আর মানায় না, সে এখন কালি, কলঙ্ক এর অন্যরূপ,শখ করে আর কেউ চোখে পড়ে না।


সুর্মা 
দীপলেখা মুখার্জী।
সুর্মা, জন্মের পর মা বাবা নাম দিয়েছিল বটে। ময়াল সাপের মতো কালো ছিপছিপে চকচকে ভরন্ত চেহারার বছর একুশের সুর্মা।টানাটানা কাটা কাটা চোখ, মুখ। কালোর এত জৌলুষ যখন,তখন সুর্মা ছাড়া আর কিইবা নাম হতে পারত? বুকেরপাটায় সাহসও ছিল বাঘিনীর মতো। পাশ দিয়ে কেউ ফুটকাটলে, কোমড়ের উপর থেকে মাথা পর্যন্ত ঘুরিয়ে, সাদা ঝকঝকে দঁাতের ফঁাকে জিভ আটকে,"শালা, হিম্মত হ্যয় তো, সামনে আ, পিছে কিউ বোলতা হ্যায় রে?" বলে যেই ঘুরে দাঁড়াত,  ওয়াগানবেকার কোমরে চাক্কু নিয়ে ঘুরনেওয়ালা, তাজুর ও সব হিম্মত শুকিয়ে ছোট হয়ে যেত। 

কারুর দরকারে ঝঁাপিয়ে পড়ত কে?এই সুর্মা। ছাগলের জন্য তরতর করে,কাঁঠালগাছের মগ ডালে অনাযাসে উঠে যেত সুর্মা। কৌশলার বাবার রাত বিরাতে বুকে ব্যাথা উঠলে,কে ভ্যানরিক্সা চালিয়ে সদর হাসপাতালে নিয়ে গেছিল? এই সুর্মা। সারাদিন রাজমিস্ত্রির যোগার খেটে বাপ মায়ের ছোট ভাইএর পেট ভরাতো সে। কোনো মাইকে লালের হিম্মত ছিল না,ওর দিকে ফিরে তাকায়।পেছন থেকে সবারই নজর ওর উপর আছে, তা সে জানত। 

সামনের জি. আর. পি এর ব্যারাকে প্রায়ই জাম পাতা, কয়েতবেল চুরি করতে যায় সুর্মা।সকাল ১১/১২ টার সময় ব্যারাক ফাঁকা থাকে। সে দিনও গেছিল।জানতো না,মরন লেখাছিল কপালে। কয়েৎবেল গুলো কোচড়ে ভরে, লেবু গাছটার দিকে হাত বাড়াতেই একটা শক্ত হাত ওর হাতটাকে পিছমোড়া করে ধরে ফেলল, কানে এলো "শালী চোরনি,লেবু চুরি করছিস?" সুর্মা কোনরকমে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে সেই যে দেখল, সেখানেই মরল মনে হয়।টকটকে ফর্সা রং, মোটা গোঁফ, পাতলা লাল ঠোঁট  তারচেয়ে প্রায় এক হাত লম্বা পেটানো চেহারা, চোখে ঘোর লাগার জন্য এইটুকুই যথেষ্ট ছিল।মন বলল, এইভাবেই তাকে ধরে থাকুক, কোঁচড় থেকে চারটে কয়েৎবেল গড়িয়ে পড়ল। হাতটা ছাড়িয়ে সেই যে দৌড় দিল, সোজা পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে,বার তিনেক এপার ওপার সঁাতরে দম নিল সুর্মা। তারপর থেকেই কি যেন হয়েছিল গেল,  মা বলতো জিনপরী তে ধরেছে তাকে, সারাক্ষণ ওই ব্যরাকের চারপাশেই ঘুরঘুর করত মনটা। মাঝে সাঝে দেখতে পেত সেই সাহেবের, মনে হত পুলিশের এই সাজ ওকেই মানায়। হঠাৎ ই একদিন চৌকিদার তাকে ডেকে, নিয়ে গেল বলল, "তোকে বিশাল সাহিব বুলাচ্ছে, আমার সাথে চ"। চৌকিদারটা কে একদম সহ্য করতে পারে না সে। কিন্তু নামটা যখন 'বিশাল সাহেব' সুর্মার না করার জোর কোথায়?!গিয়ে দেখল, খাটিয়ায় বসে আছে সাহেব। তার সাথে,  আরো চারজন। 
তিনদিন ধরে সুরমার খোঁজ নেই, মা এক নাগাড়ে কেঁদেই চলেছে, ল্যাংড়া বাপ দাওয়ায় বসে শূন্য দৃষ্টিতে আকাশে দেবতাকে খুঁজছে বোধহয়। পুলিশে রিপোর্ট ও লিখিয়েছে। তবু কেউ কোনো  খোঁজ পেল না মেয়েটার। হঠাৎ অনেক রাতে দাওয়ায়, ধুপ করে শব্দ! দরাজা খুলে বাপ দেখে , সুরমা!!! তুই!একি অবস্থা! সারা শরীর রক্তাক্ত। ঠোঁটের কষে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত, একটা চোখ বিভৎস রকম ফুলে আছে, কাপড় জামা শতছিন্ন। ওর মা দৌড়ে এসে জড়িয়ে কেঁদে উঠল। বাপ ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে  চাদর নিয়ে এসে ঢেকে দিল।
তারপর থেকেই জিন্দা লাশ  হয়ে বেঁচে রইল সুরমা। না কাঁদে, না হাসে, না কারুর সাথে কথা বলে। খালি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। অনেক চেষ্টা করেও কি হয়েছিল, বা কারুর নাম জানা গেল না। নয় মাস পরে একটা ছেলে জন্ম দিল সে।  কয়েক ঘরে বাসন মেজে, ছেলে কে বড় করতে লাগল, সবাই বলত,ওর বাপ কে রে সুরমা? এত রহিস আদমিদের মতো তোর ছেলের চেহারা!! সেই সময়, হ্যঁা কেবল সেই সময়ই সুর্মার মনে হতো, মা হয়েও ছেলেটার গলা টিপে দি।  অতটুকু বাচ্চাও মায়ের সেই দৃষ্টিটাকে ভয় পেত। বছর সাতেক পর সেই ছেলেও গেল। সুর্মা গেছিল বাসন মাজতে, তার বেটা একটা  কুকুর ছানা পুষে ছিল। খেলতে খেলতে একদিন কুকুরটা রেলগাড়ির তলায় ঢুকে গেছিল। তাকে বের করতে গিয়েই শেষ।  সবাই সান্তনা দিতে ছুটে আসলো, সুর্মা শুধু বলল, বদ রক্ত ছিল,বয়ে গেছে, ধুয়ে গেছে। তারপর থেকে সেই কুকুরটা কে খুব আদর করত সুর্মা। অনেক রাতে ভাত আর তার ছেলের প্রিয় আলুর চোখা থালায় করে রেল লাইনের ধারে দিয়ে আসতে এখনো দেখা যায় সুর্মা কে।

খালি তাকে সুর্মা নামটা আর মানায় না, সে এখন কালি, কলঙ্ক এর অন্যরূপ,শখ করে আর কেউ চোখে পড়ে না।