গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৮

নীহার চক্রবর্তী

অযাচিত 

কুন গাঁ থেকে গা তুমরা এখানে ? 
বসিরুদ্দিন জানতে চাইলো দুই অচেনা মানুষের কাছে
তাদের একজন হেসে উত্তর দিলো,নাদুপোঁতা গাঁ সে অনেকদূর
নাদুপোঁতা ? সে আবার কুতায় ?
জামাল শেখ বলে উঠলো
দুজনের আর একজন অমায়িক-হেসে জবাব দিলো,কত যে গাঁ কটা চিনি তার আমরা ? দক্ষিণে গা অই দক্ষিণে
কথা শেষ হতেই দুজন আবার হাঁটা শুরু করলো  
পিছন থেকে বসিরুদ্দিন জানতে চাইলো কাদের বাড়ি যাচ্ছে তারা
দুজনে একসাথে বলল,হাসমত মল্লিককে চেনো ? তার বাসায় আমাদের আত্মীয় তো
বলে তারা এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না দ্রুত গ্রামের ভেতরের দিকে পা বাড়াল
হাসমত মল্লিক ?
জালাল ভ্রূ-কুঁচকে বলল বসিরুদ্দিনকে
আরে চেনো না ? সেই গো হাসমত ভাই বেশ মেজাজি কিন্তু ভালামানুষ
কিন্তু কোথায় তখন হাসমত মল্লিক ? দুজনের কারো মাথায় নেই তখন
তারপর গ্রামের মধ্যে ঢুকে ওই দুই অচেনা মানুষ দুবার গ্রামের কয়েকজন মানুষের মুখোমুখি হল তারা তাদের ঠিকানা সেই একই বলল নাদুপোঁতা
সে আবার কুতাকার গেরাম ?
জানতে চাইলে প্রায় একই উত্তর দিলো তারা দু'জায়গায়
একদলকে বলল,পুবে গো পুবে কে আর চেনে কত গেরাম
সেখানে তারা হাসমত মল্লিকের বাড়ির কথাই বলে
,আচ্ছা
বলে তারা হাসিমুখে অজান্তে তাদের এগিয়ে দিলো তাদের
আর একদলকে তারা বলল,উত্তুরে গো উত্তুরে আমরাই চিনি না অত গেরাম
সেই হাসমত মল্লিক আবার
তাই বুজি ? তাইলে আয়েন
এভাবে তারা এগোতে এগোতে সন্ধে পেরিয়ে দিলো
দেখতে দেখতে রাত এলো
রাত ক্রমশ বাড়তে থাকলো কিন্তু যারা দেখেছে ওই দুই অপরিচিত মানুষকে তাদের মনেই হল না তারা এখন কোথায় কিংবা গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে গেছে কিনা
তখন রাত বারোটা গ্রামময় চারদিক থেকে চিৎকার ভেসে আসছে তুমুল বোমার আওয়াজ যে যার প্রাণ নিয়ে ঘরে সব থরহরি কম্পিত
ওদিকে তখন চলছে আট-আটটা বাড়িতে দুঃসাহসিক ডাকাতি কি হচ্ছে আর কি হচ্ছে না কারো মালুমই হল না শুধু মনে হচ্ছে সবার,এত শান্ত গ্রামে এসব কী ? নাকি জিনের দখলে গেলো বড় সাধের গ্রাম ? 
প্রায় দশ মাইল দূরে থানা কেউ এক খবর দিলো থানায় কিন্তু পুলিশ আসতে আসতে সব শেষ কারা কোথা দিয়ে বেরিয়ে গেলো কেউ টেরটিও পেলো না
ভোরের আলো ফুটতেই গ্রাম-জোড়া হাহাকার দেহ পড়েছে দু-দুটো সেই দেহ দেখতে অনেকেই ছুটে গেলো
সে রাতেই পুলিশ আসে গ্রামে কিন্তু তাদের তখন আর কিছু করার ছিল না তাদের কাছে ক্ষোভ দেখানোর মানুষও পাওয়া গেলো না একটা  
থানার সেজোবাবু বলে গেলো,আমাদের বিস্তারিতভাবে জানা চাই তারপর তদন্ত সকালে কয়েকজন থানায় যাবেন
তা সকালে গেলো সেই বসিরুদ্দিন সেই দলে ছিল সঙ্গে আরও তিনজন
বড়বাবু বলল,''আপনারা কিছু মনে করতে পারেন ? মানে ডাকাতির আগের কোন ইঙ্গিত ? 
বসিরুদ্দিন অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলো বাকিরা তো হাঁ করে বসে শুধুই ভাবছে
হঠাৎ বসিরুউদ্দিনের মনে হল সেই দুই অপরচিত মানুষের মুখ দুটো
সে বলল,হুম কাল সন্ধের আগে দুজন মানুষ এসেছিলো আমাদের গ্রামে আমি চিনি না আরও কেউ-কেউ দেখেছে কেউই চেনে না তাদের কি এক গ্রাম বলল তাদের বাড়ি নাদুপোঁতা নামই শুনিনি কখনো
তার কথা শুনে বেশ আগ্রহ বেড়ে গেলো বড়বাবুর
সে বেশ উৎসাহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো,সে যাক কে কতটুকু জায়গা চিনি আমরা তা কোথায় এসেছিলো বলেছে কিছু ?
বসিরুদ্দিন মাথা চুলকাতে শুরু করলো তখন বাকি তিনজন তখন তার দিকে সবিস্ময়ে চেয়ে আছে বড়বাবু জলের গ্লাসে চুমুক দিয়ে শোনবার জন্য বেশ আগ্রহ নিয়ে বসলো
বসিরুদ্দিন এবার বলে উঠলো,''হাসমত মল্লিক,স্যার
সাথে-সাথে উঠে দাঁড়ালো বড়বাবু
সে দাঁড়িয়ে মাজায় হাত দিয়ে বসিরুদ্দিনকে জিজ্ঞেস করলো,সে কোথায় এখন ? গ্রামেই কি ?
আসগর নামে গ্রামের একজন বলল,ওর সাতদিন আগে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা এক বেওয়াকে ফুঁসলেছিল শালিসিসভা ডেকে ওকে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বলা হয় জানি না গেছে কিনা
তার কথা শুনে বেশ অবাক বড়বাবু
সে বিস্ময়ের সুরে বলল,ভারী তো এইটুকু গ্রাম কে আছে আর কে নেই বোঝা যায় না ? রাবিশ
হঠাৎ গ্রামের একজন সেখানে এসে বলল,আমি দেখেছি দুদিন আগে হাসমত ওর পরিবার নিয়ে চলে যাচ্ছে কিন্তু কোথায় বলে যায়নি আমাকে চুপিচুপি কথাও হল কিন্তু গন্তব্য বলে গেলো না
রাবিশ রাবিশ তাকে না পেলে কিছুই হবে না কিচ্ছু না ছবি আছে তার ?
সরোষে বলে উঠলো বড়বাবু  
বসিরুদ্দিন ফ্যাকাসে মুখে তাকে বলল,কে আর ছবি তুলে রেখেছে ওর
হুম আমার মাথায় আসছে না কিছু
বলে বড়বাবু আবার চেয়ারে গালে হাত দিয়ে বসলো
তারপর গালে হাত দিয়ে ভাবতে ভাবতে বড়বাবু বেশ বিজ্ঞের সুরে বলল,তিরিশটা বছর পুলিশি লাইনে আছে অভিজ্ঞতা তাই আমার কম না ওই হাসমতের কাজ ওই দুজন লোক পাঠিয়েছিলো গ্রাম ঘুরে দেখতে সব বুঝতে তারাই গোপনে ফোন করে ডাকাত এনেছিল গ্রামে বুঝলে কিছু ?
তার কথা শুনে সবাই হাঁ কারো মুখে রা নেই বড়বাবু তাদের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসতে থাকলো
অনেক পরে প্রায় অস্ফুট-গলায় বসিরুদ্দিন তাকে বলল,কিন্তু গ্রামেই ওর জন্ম পড়াশোনা যা করেছে এখানেই গ্রামটাকে খুব ভালোবাসতো যে,স্যার এমন কাজ করতে পারে ?
বড়বাবু অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে উঠে দাঁড়ালো তার কথা শুনে  
সেই আগের মতো মাজায় হাত রেখে বলল,খুব আঘাত পেলে মানুষ খ্যাপা কুত্তা হয়ে যায় জানা আছে কি ?
বসিরুদ্দিন চুপ করে থেকে-থেকে বলল,এখন উপায় ?
উপায় ওই হাসমতের ঠিকানা আর গন্তব্য আমি এখন একটু বাইরে যাবো কোন ক্লু পেলে আমাকে বল  
তারপর সে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো  
তার যাওয়ার কিছু পরেই চারজন মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো
তারপর দুদিন সুজাপুর গ্রাম থমথমে থাকার পর তৃতীয়দিন সকালে ভেসে উঠতে দেখা গেলো এক ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ মোল্লা আরিফের এঁদো-পুকুরে
একে-একে অনেকেই ছুটে এলো সেই মৃতদেহ দেখতে দেখে সবাই যারপরনাই অবাক হল হাসমত মল্লিকের নিথর দেহ দেখে  
নানা মনে প্রশ্ন উঠলো হাসমত তো গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে এখানে এলো কীভাবে ? আর কে বা কারা ওকে খুন করলো    ? 
বসিরুদ্দিন সহ কয়েকজন ছুটল থানায় থানার সেই  বড়বাবু জানামাত্র ছুটে এলো সুজাপুর গ্রামে  
সে বেশ গম্ভীরভাবে হাসমতকে নিরীক্ষণ করার পর ফিক-ফিক করে হেসে বলল,হাসমত আরও বোঝাতে ডাকাত-দলের সঙ্গে এসেছিলো নির্ঘাত কিন্তু ওকে ডাকাতরা বিশ্বাস করেনি তাই ওকে ওরা মেরে গ্রামেই ফেলে গেছে ব্রিটিশদের মতো আর কি যে নিজের গ্রামের ক্ষতি করে,সে ওদের আরও বড় ক্ষতি করতে পারে এই ভেবেই বুঝি...
তার ঠিক পরেই হাসমতের মৃতদেহ একটা পাটিতে মুড়িয়ে একটা ভ্যানে চাপিয়ে থানার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হল
প্রথম থেকে সব দেখে কাঁদল শুধু হাসমতের বুড়ী পিসি তার কান্না আর থামে না কিন্তু তাকে কেউ সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে এলো না
তার কান্নার সাথে ভাব করতে এলো শুধু উত্তুরে কনকনে হাওয়া