গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১২ আগস্ট, ২০১৮

নীহার চক্রবর্তী

অভিনেতা 

রাতের অন্ধকারে আসগর ওর বৌ হালিমাকে খুন করে ঘরের মধ্যে পুঁতে দিয়ে তারপর দিব্যি ভোরের আলো ফোটা না পর্যন্ত পাশে শুয়ে থাকলো । ভোরের আলো ফুটতেই ঘরে তালা মেরে হাসতে হাসতে ছুটে গেলো দশ গ্রামের পরের গাম রসুলপুরে । সেখানে থাকে ওর বাল্যবন্ধু সুলেইমানের বাড়িতে ।
 
দুপুরের আগে আসগর পৌঁছে গেলো সুলেইমানের বাড়িতে । ওকে দেখে সুলেইমান আর তার বৌ মাহমুদা তো যারপরনাই অবাক । প্রায় বছর খানেক পর আসগর আবার দেখা দিয়েছে ।
তাই সুলেইমান সারা মুখে হাসি নিয়ে বিস্ময়ের সুরে ওকে বলল,''তা কী মনে করে ? এতদিন পর বুঝি বন্ধুর কথা মনে হল ? তা বেশ । থাকিস এখানে কিছুদিন । বেশ মজা হবে কিন্তু ।''

মাহমুদা এ নিয়ে দুবার আসগরকে দেখল । আগেরবার আসগরের ব্যবহারে সে খুব খুশী ।
 
তাই প্রায়ই সে স্বামী সুলেইমানকে বলতো,''আর আসে না কেন বন্ধু তোমার ? বড় ভালোমানুষ । একটু দেখা কর ।''
 
সে এবার স্মিত হেসে আসগরকে বলল,''থাকতেই হবে কিন্তু । আমরা কিন্তু ছাড়বো না আপনাকে ।''
উত্তর দিলো আসগর বেশ হেসে-হেসে,''সে কদিন থাকা যাবে । তবে ঘরে তো বৌ আছে । সে বুঝি আমাকে ছাড়বে ? বলেই এসেছি । কদিন থাকবো । আর ও এখন বাপের বাড়িতে । তাই চিন্তার কিছু নেই ।''
 
বৌয়ের প্রতি আসগরের দরদের কথা শুনে মাহমুদা একটু বিরক্তির সঙ্গে তাকাল তখন স্বামীর দিকে । মাথা নিচু হয়ে গেলো সুলেইমানের । এবার আসগরের দিকে এক পলক তাকিয়ে মাহমুদা এক-গাল হেসে ফেললো ।

তা তারপর থেকে আসগর বন্ধু সুলেইমানদের বাড়িতে থাকতে শুরু করলো । ওকে অনেকদিন পর কাছে পেয়ে সুলেইমান আর ওর বৌ বেজায় খুশী । মাহমুদা নানা পদের রান্না করে ওকে খাওয়াতে থাকলো ।
 
আবার জানতে চায়,''আপনার পছন্দের খাবারগুলোর কথা বলবেন ।''
তা আসগর বলে লাজুক-লাজুক ভাব দেখিয়ে ।

সুলেইমান বাইরে যাওয়ার সময় প্রায়ই বলে আসগরকে,''বাইরে থেকে বেরিয়ে আয় । সারাদিন ঘরে কি ভালো লাগে ? আমাদের গ্রামে অনেককিছু দেখার আছে । তোকে সব দেখাবো ।''
 
কিন্তু আসগর বলে,''এসবের দরকার নেই । বন্ধুর বাড়িই সেরা দেখা জায়গা । কতদিন আসিনি,বল তো ?''
সুলেইমান হেসে চুপ হয়ে যায় ।
মাহমুদা বেশ বিরক্তি নিয়ে তাকে বলে,''তোমার এসব বলার দরকার কী ? বন্ধু কি তোমার গ্রাম দেখতে এসেছে ? আমাদের কাছে এসেছে । থাকুক না বাড়ির ভেতর ।''
 
সুলেইমান এরপর আর কি বলে ।
মৃদু হেসে বলে তখন,''বেশ । তাই হোক ।''
মাহমুদা খুশী হয় স্বামীর কথা শুনে । আসগর দুজনের কথা শুনে অমায়িক হেসে দেয় তখন ।

এভাবে দু'সপ্তাহ গেলো ।
 
একদিন সুলেইমান তার বৌ মাহমুদার সামনে আসগরকে বলল,''তা বাড়ির খবর কিছু জানিস ? মানে তোর বৌয়ের ? ফোনটা তো সঙ্গে আনিসনি ।''
 
একটু আমতা আমতা করতে করতে আসগর হেসে ফেলে বলল,''আরে,তোকে তো বলাই হয়নি । আমার বৌয়ের বাচ্চা হবে । আসলে লজ্জা পেয়েছিলাম খুব । এখন ও বাপের বাড়িতে আছে । সেখানে বেশ থাকে । পরে খবর নিলেই হবে ।''

শুনে সুলেইমান আর মাহমুদা বেশ খুশী । তবে মাহমুদার মুখ নিমেষে কালো হয়ে গেলো । মুখভার করে সুলেইমানের দিক তাকাল ।
 
সুলেইমান তখন মাথা নিচু করে বেশ মন-ভাঙা গলায় বলল,''আমাদের যে কবে হবে কে জানে । সাতবছর তো এমন করেই গেলো ।''
তবে আসগর হেসে প্রবোধ দিলো ।
বলল,''আর একটু অপেক্ষা করতে হবে । আল্লাহ্‌ এখনো তোদের দিকে মুখ তুলে তাকানোর বুঝি সময় পাননি ।''

এরপরেই সুলেইমান মুখ তুলল ।
এবার আসগরকে বলল,''তোর বাড়িতে তো কেউ থাকে না । কোন সমস্যা হবে না ? ''
আসগর শুনে একচোট হেসে উত্তর দিলো,''তুই একটা পাগল । আমাকে চিনিস না ? পাড়ার সবাই আমাকে ভালোবাসে । পাড়ার মানুষ দেখে রাখছে আমার বাড়ি । চিন্তা নেই । গিয়ে সব ঠিকঠাকই দেখবো ।''
তারপরেই আসগর কি এক ভেবে উঠোনে নেমে এলো ।

ও চলে যাওয়ার পর মাহমুদা বেশ রাগের সঙ্গে সুলেইমানকে বলল,''নিজের কথা ভাবো । বন্ধুর কথা ভেবে লাভ নেই । তুমি পাগলই বটে । তোমার সব মুরোদ আমার জানা আছে ।''
 
কথা শেষ করেই হনহন করে মাহমুদা উঠোনের দিকে পা বাড়াল । সুলেইমান এক পা ফেলেও আবার নিজের জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো । দেখে মনে হল বেশ ভাবছে তখন ।

ক্রমশ অন্তরঙ্গতা বাড়তে থাকলো আসগরের সঙ্গে মাহমুদার । সুলেইমান যখন মাঠে যায়,তখন দুজন মিলে সারা বেলা হেসে-হেসে কথা বলে । সে কত কথা । বুঝি ফুরানোর নয় ।
 
কিন্তু একদিন মাহমুদার দু'চোখ জলে ভরে উঠলো । দেখে বেশ অবাক আসগর ।
সহসা তার হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো,''কষ্টটা কি তোমার জানতে পারি ?''
আপনি থেকে তুমি সেই প্রথম । মাহমুদাও আসগরকে তুমিই বলল ।
চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলতে থাকলো,''সে তুমি বুঝবে না গো । পুরুষ এসব বোঝে না । বাদ দাও । নিজের কষ্ট নিজেই বইতে থাকি ।''
কিন্তু আসগর একমুখ হেসে বলল,''আমি অন্যরকম পুরুষ গো । সবাইকে এক পাল্লায় মাপতে যেও না । বলে ফেলো এখুনি ।''
আসগরের কথায় তখন মাহমুদা এক চিলতে কষ্টের হাসি হেসে প্রথম নতুন কথা শোনাতে শুরু করলো ।

''কি আর বলি তোমাকে । তোমার বন্ধু না দিলো আমাকে সন্তান । না দিলো অর্থ-সুখ । আর...''
'আর' বলেই মাহমুদা মাথা নিচু করে নিলো ।
আসগর মাহমুদার হাতটা বেশ চেপে ধরে সহাস্যে জিজ্ঞেস করলো,''আরটা কী তোমার ? আমি কি জানতে পারি না ? সুলেইমান কি এখানে আছে ? লজ্জা দূর করে বলে ফেলো ।''
মাহমুদা এবার লজ্জা দূর করেই দিলো ।

বেশ ঘেন্না-ঘেন্না মুখে বলতে থাকলো,''শুধু ভালোবাসা দিয়ে একটা মেয়ের মন জয় করা যায় ? কামনা বলে কিছু আছে না তার ? তোমার বন্ধু সে দিতে পারে আমাকে ? বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই... বুঝে নাও তুমি । আর বলছি না ।''
 
মাহমুদার কথা শুনে আসগর অবাক হল না একটুও । হাসলও না ।
বেশ বলিষ্ঠ-গলায় জিজ্ঞেস করলো,''তা আমাকে দেখে কী মনে হয় তোমার ? আমি কি ওর মতো ? আমার বৌয়ের কিন্তু বাচ্চা হবে মনে রেখো । এবার তুমি ভাবো ।''
কথা শেষ করেই আসগর ইঙ্গিতপূর্ণ হেসে সেই উঠোনের দিকে পা বাড়াল । ওকে অনুসরণ করলো মাহমুদা ।

সে সুযোগ নিলো আসগর ।
 
পরেরদিন দুপুরের পর মাহমুদার সঙ্গে শারীরিকভাবে মিলিত হল ও । খুব তৃপ্ত মাহমুদা । অনেক মেঘলাদিনের পর সারা শরীর তার যেন কামজলে ভেসে গেলো ।
তখুনি আসগর মাহমুদাকে বলল,''চুলোয় যাক আমার সংসার । আর ভালো লাগে না । আমাকে বোঝেই না । সংসারে বিবাদ লেগেই আছে । এবার তুমি কি করবে বল ।''
মাহমুদা মুখভরা হাসি নিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে গেলো । ওর কথার অপেক্ষা করতে থাকলো আসগর । ওর সারা মুখে তখন আসন্ন জয়ের হাসি ।
শেষপর্যন্ত মাহমুদা বলেই ফেললো,''আমাকে তুমি সুযোগ করে দাও । আমি রাজী ।''
কিন্তু সে আসগরের সংসারের কোন কথাই বিশেষ জানতে চাইলো না তখন ।

'সুযোগ আছে । খুবই আছে । দুই মন আর শরীর যখন মেতেছে কে আর বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে আমাদের । আজ রাতেই আমরা এ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়বো । সুলেইমান বেঘোরে ঘুমোতেই আমাদের বেরোনোর পথ সহজ হয়ে যাবে ।''
আসগর এমন কথা বলার পর মাহমুদা বেশ ক্ষোভের সঙ্গে বলতে থাকলো,''বেশ । তাই হবে । অনেক সয়েছি এ সংসার আর নয় । শুধু ভয় আবার ফিরে আসতে হয় কিনা । ফিরবো না তো মোটেই । তুমি সরে গেলে আমি সরে যাবো একেবারে ।''
 
একথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে আসগর প্রায় উল্লাসে ফেটে পড়ে মাহমুদাকে ওকে কেশ-শোভিত বুকে চেপে ধরল । অনেকক্ষণ ধরে মুখে-ঠোঁটে-গালে চুমু খেলো ।
 
শুধু বলল,''এ পুরুষ সে পুরুষ নয় যে প্রেমের মিথ্যা অভিনয় করে ।''
শুনে পরম তৃপ্তির হাসি হাসল মাহমুদা ।

এলো সে রাত ।
 
আসগর আর মাহমুদা অনেক হাসি-মস্করা করে সুলেইমানকে ঘুম পাড়িয়ে দিলো । সারাদিনের পরিশ্রমের ফলে সুলেইমান প্রতি রাতের মতো একটু সময় যেতেই বেঘোরে ঘুমিয়ে পড়লো সে রাতে ।
আর অপেক্ষা নয় । কীসের জন্য অপেক্ষা ? আমাদের আবার ঘর কোথায় ? এবার নিজের বলে কিছু হবে ।
এসব কথা ভেবে ঘুমন্ত পল্লীর পথে নেমে পড়লো আসগর আর মাহমুদা । নাকি মাহমুদা আর আসগর ?

হেঁটে চলেছে দুজন নিশুথ রাতে । বেশ দ্রুত হাঁটছে ওরা । পাছে কেউ না দেখে ফেলে । তাই হাঁটছে তো হাঁটছে দুই অস্থির প্রাণ ।
আর আধ মেইল । তারপরেই নকীবপুর । সেখানে ভোরের ট্রেন ধরে সব ছাড়িয়ে হারিয়ে যাওয়া যাবে ।
কিন্তু না । হল না । লক্ষ্য ভ্রষ্ট আসগর । মধ্য-রাতে ঘেরাও হল খুব দ্রুত ভ্যান থেকে নেমে আসা একদল পুলিশের । সাথে-সাথে আসগরের পালানোর চেষ্টা ।
কিন্তু না । নাহ ।

পুলিশ পাছায় লাথি মেরে আসগরকে ভ্যানে তুলে নিলো । মাহমুদার দিকে তারা বেশ কড়া চোখে তাকাল ।
সে বুঝি দারোগাই ।
বলল,''এই মাগীকেও তোল । কে বুঝতে হবে না ? একে ফুঁসলে পালাচ্ছিল বুঝি হারামিটা ।''
 
তা মাহমুদাকে একরকম জোর করে ভ্যানে তোলার চেষ্টা করা হল । কিন্তু পারলো না তারা । মাহমুদা শেষ শক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে সামনের দিকে দৌড় দিলো । সেকি দৌড় ! হাওয়ার মতো বেগ । নিমেষে সে সব নজর এড়িয়ে কখন যেন নকীবপুর স্টেশনে পৌঁছে গেলো ।
 
শেষবারের মতো রেলে-কাটা মাহমুদার দেহটা নিজের বাড়িতে ফিরতে পারতো ।
কিন্তু সুলেইমান কঠোর-গলায় বলল পুলিশকে,''আপনারা যা করার করুন । আমি এসবের মধ্যে নেই । আমার কোন ঘর ছিল না । সংসার ছিল না । তাই বৌ থাকার কোন প্রশ্নই নেই । একে নিয়ে কি করবেন আপনারাই ভাবুন ।''
সুলেইমানের একথা শুনে অনেকের চোখ সজল হয়ে ওঠে ।
নকীবপুরের বড় দারোগা ছলছল চোখে সুলেইমানের পিঠে হাত রেখে বলে,''আমাকে আর বুঝতে হবে না । মানুষ চিনি আমি । তুমি সজ্জন । তাই তোমার বৌয়ের অসম্মান হবে না একথা বলতে পারি ।''

তারপর কি হয়েছিলো আর কারো সেভাবে জানা নেই ।
সুলেইমান নিজেও জানার চেষ্টা করেনি । ঘরের মধ্যে একাকী বসে দিনের পর দিন হেসে গেছে । তারপর দু'চোখ থেকে নেমেছে অঝোর-কান্না । গ্রামের বা পাড়ার কেউ তখন সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পায়নি ।
আসগরের কথা কি আর বলা যায় । ধর্মের কল যতই ভারী হোক । বাতাসে তো নড়ে । ওর খবর আর কেউ রাখে না । সুলেইমান একদিন চোখ মুছে পাড়ার একজনের কাছে আসগরের খবর জানতে চায় ।
তখন সে বেশ ঝাপট দিয়ে বলে ওঠে,''তুই মানুষ হবি কবে রে ?''
সেইথেকে সুলেইমান একদম চুপ ।
 
তারপর থেকে আসগর ফিরতেও চেয়েছে নিত্যদিনের ঘাম-ঝরা কর্মে । শুধু ভাবতে চায়নি নতুন করে ঘর বাঁধার কথা ।