গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৮

চন্দনকৃষ্ণ পাল

এই যে জীবন



খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যায়। শুয়ে শুয়েই জানালা খুলে দেখি বৃষ্টি থেমে গেছে। কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। রাতে ভীষন মন খারাপ ছিলো। ভাবছিলাম সকালেও বৃষ্টি থাকবে। এটা ভেবেই মন খারাপ। মন খারাপ নিয়েই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। ঝকঝকে আকাশ দেখে ভালো লাগে আমার। রোদ উঠবে নির্ঘাৎ। মশারী সরিয়ে নীচে নামি। স্যান্ডেল পায়ে গলিয়ে দরজা খুলে রুমের বাইরে আসি। কামিনীর ঝোঁপ থেকে গত রাতের বৃষ্টির ফোঁটা ঝরছে। অনেক দিন পরে এসেছি বাড়ীতে। সব কিছু কেমন নূতন লাগছে।






গাছপালাগুলো নিজেদের সাজিয়েছে দারুন। ঢল ঢল করছে সবুজ পাতা। কাঞ্চন গাছে সাদা ফুল। ব্রাশে পেষ্ট লাগিয়ে ধীর পায়ে এদিক ওদিক হাঁটি। পুকুর পাড়ে এসে অবাক হয়। রক্ত শাপলা নেই। গত বছরও দেখেছি টকটকে লাল ফুলে পুকুর আলো করে রেখেছে। এবার একটা ফুলও নেই। খারাপ লাগে। বড়দার লাগানো নারকেল গাছগুলো অনেক বড় হয়েছে।






আমি ঘাটের শেষ সিঁড়িতে গিয়ে বসি। এক দঙ্গল তেলাপিয়া ঠোঁট ভাসিয়ে পানি খাচ্ছে সিঁড়ির খুব কাছে এসে। ছোট ছোট ঢেউ উঠছে পানিতে।


কাল রাতে হঠাৎ করেই শংকরের সাথে দেখা। শংকর আমাদের গ্রামেরই ছেলে। ভালো ছেলে। গ্রামের কমন ‘মেজদা’ আমি। ছোটবেলা থেকেই শংকরকে ভালোবাসি আমি। খুব ধীর স্থির আর বুদ্ধিমান ছেলে শংকর। আমাকে পেয়ে খুব খুশী ও।


- মেজদা তোমার সাথে আমার অনেক কথা।


- কি কথারে পাগল। বাড়ীর সবার কথা আগে বল। তারপর অন্য সব কথা শুনা যাবে।


- আগামী কাল সকালে তুমি আমাদের বাড়ীতে এসো। সত্যি খুব জরুরী আলাপ।


- আচ্ছা ঠিক আছে। এবার বল মাসীমা, স্বপ্না, সীমারা কেমন।


- ভালো। বলেই থেমে যায় শংকর। আমার মনে হয় শংকর যেন হঠাৎ খুব বিষন্ন হয়ে পড়ে। আমি ওর বিষন্নতার কারন বুঝতে পারিনা। অনেকদিন গ্রামের সাথে সম্পর্ক নেই আমার।


আমার মনে পড়ে আজ আমার শংকরদের বাড়ীতে যাওয়ার কথা।






- কাকু। দোলা এসে পাশে দাড়ায়।


- কি মামনি।


- কি দেখছো।


- এইতো বাড়ী, গাছ-পালা এসব।


- বা, এসব আবার দেখার কি হলো।


- আমি যে অনেক দিন এসব দেখিনি মা। এই গ্রামের প্রতি ধুলিকনায় আমার অনেক স্মৃতি।


- কাকু তুমি কদিন থাকবে?


- চারদিন।


- মাত্র। কাজ নাই চারদিন থাকার। আজই চলে যাও। বাবাও বাড়ী নেই। তুমিও এসেই বলো যাই। অভিমানে ঠোঁট ফোলায় দোলা। দোলার বাবা আমার বড়দা বাইরে অনেকদিন। এই সংসারের স্বচ্ছলতা আনার জন্য দুভাই ই বাইরে আছি। আমি দেশে থাকলেও নানান ঝামেলায় আসা হয়ে উঠে না। মেয়েটা খুব ফিল করে ওর বাবাকে। আমি বুঝি। কিন্তু কিছুই করার থাকে না। আমি হাত বুলাই দোলার মাথায়। মেয়েটা গায়ের সাথে লেপটে থাকে।


বেলা বাড়ছে। আমার এখন বের হওয়া দরকার।






বাড়ীর সামানের রাস্তায় এসেই কিছু দূরে বড় পুকুরের দিকে চোখ পড়ে আমার। পুকুরটা তেমনি আছে। শে^ত পদ্মে ভরে আছে সারা শরীর। শুধু পাড়ের আম আর জাম গাছগুলি নেই । আমার খুব কষ্ট হয়। আমি শৈশবের সোনার জলে লেখা দিনগুলির স্মৃতি তো এই পুকুর, আম জাম গাছের সাথেই থাকার কথা। বাঁশ ঝাড়টা এখনও আছে। বাঁশ কমে গেছে। ছোটরা এখন নিশ্চয় ভূতের ভয় পায় না আর। পুকুর পাড়ে একটু জায়গা উচু হয়ে আছে। এখানেই প্রভাসের মায়ের শ্মশান। প্রভাসের মা যেদিন মারা যান, প্রভাস সেদিন ওর মামা বাড়ীতে। ছোট প্রভাস ফিরে এসে ওর মায়ের মুখ দেখতে পায়নি। তার আগেই গ্রামের মাথাওলারা দাহ এর কাজ শেষ করেছেন। প্রভাস শুধু কিছু ছাই এসে দেখেছিল। আমি কৈশোরের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে এই ঘটনা দেখলেও কিছুই করতে পারিনি। কারন একজন কিশোরের পক্ষে একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের দাহ করা সম্ভব নয়। কিন্তু সেদিন থেকে গ্রামের মাথাগুলোকে ঘৃণা করি আমি।






উত্তর মুখী রাস্তাটা শহরে চলে গেছে। এক সময়ের ছোট আল পথটা এখন সড়ক। আমের সারি তখনও ছিলো কিন্তু এখন গাছগুলো অনেক বড়ো, পুরো রাস্তাটাই এখন ছায়াময়।






আমি রেল সড়কে উঠে পশ্চিমমুখী হাঁটতে থাকি। উত্তরসুর কুল চন্দ্র প্রাইমারী স্কুলের কাছে এসে থমকে দাড়াই আমি। স্কুলের সামনে বিরাট একটা হিমাগার ! দেখে ভীষণ খারাপ লাগে আমার। স্কুল যেন গ্রাস করার জন্য তৈরী হয়ে আছে। শুনেছি স্কুলের নাম পরিবর্তনের জন্য অনেক রাজাকার শ্রেনীর লোক উঠে পড়ে লেগেছে। অথচ এ স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করে দীর্ঘ দিন অনেক টাকা খরচ করে স্কুলটিকে টিকিয়ে রেখেছিলেন কুলচন্দ্র। অথচ এই জারজ গুলো মহৎ মানুষটার স্মৃতিকে মুছে ফেলতে চাইছে। এদের প্রতি ঘৃণা জানানোর ভাষা আমার নেই।






স্কুল চত্তরে বটগাছ দুটি অনেক বড় হয়েছে। আমার শৈশবের অনেক দিন এ গুলোর ডালে কেটেছে। স্কুলে প্রতিদিন এক দুবার গাছগুলোর ডালে ঝুলতাম। এ ডাল ওডালে বানরের মতো লাফালাফি না করলে ভাত হজম হতো না। বাজারে এসে অবাক হয় আমি। আরব আলীর টং দোকানটা তেমনি আছে। নূতন কিছু পাঁকা ঘর হয়েছে। তবে আগের মতো জমজমাট নেই। লোকজন সবাই কেনাকাটা করতে শহরে যায়।






রেল সড়কের পাশের তমালতলাটা কে জানি সিমেন্ট দিয়ে বাধিয়ে দিয়েছে। বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। রাস্তার দুপাশে অনেক পাঁকা বাড়ি। নূতন মুখ অনেক। আমি সামনে এগোই। পল্লী বিদ্যুতের কল্যানে বিদ্যুৎ এসেছে অনেক বাড়ীতে। বাঁশ গাছের ফাঁকে মাঝে মাঝে টি.ভি এন্টেনা।






সোমবাড়ীর সামনের জোড়া পুকুরটা কচুরীপানার দখলে। প্রাইমারী স্কুলের সব সাঁতার প্রতিযোগীতা তখন এখানেই হতো। আজ সব কিছুই আগাছা, পরগাছা আর কচুরী পানার দখলে। এ থেকে মুক্তি কবে কে জানে।






শংকরদের বাড়ীতে পৌছে যাই। শংকর খুব খুশী হয়। সীমা অনেক খানি লম্বা হয়ে গেছে। স্বপ্নাকে দেখি না, মাসীমা ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করেন। স্বপ্নার কথা জিজ্ঞেস করলে শংকর যা জানায়, আমি তা ভাবতেও পারিনা। বুকের ভেতরটায় কে যেন খামছে ধরে আমার। স্বপনার মুখটা চোখের সামনে ভাসে আমার। এতো লক্ষী মেয়েটার কপালে সুখ সইলো না।






বাবার রেখে যাওয়া সামান্য জমিটুকু বিক্রি করে বোনের বিয়ে দিয়েছিলো শংকর। যকটুকু সম্ভব যৌতুক দিয়েছে। নিজেকে নিঃস্ব করেও চেয়েছিল বোনের সুখ। হলো না। গরীবের কপালে সুখ সয় না। কয়েক মাস পরেই সেই মানুষরূপী পশুটার স্বরূপ উন্মোচিত হলো। একে একে স্বপনার সমস্ত সোনা-দানা শেষ হয়ে গেলো। চাপ পড়লো বাপের বাড়ী থেকে টাকা আনার। স্বপ্না কি করবে। প্রিয়তম স্বামী একদিন হাত তুললো গায়ে। অত্যাচার বাড়লো ক্রমে। এক সময় তাড়িয়ে দেয়া হলো স্বপ্নাকে। স্বপ্না ফিরে এলো ভাইয়ের সংসারে। ভাইয়ের পায়ের কাছে বসে চোখের জল ফেললো।


- তুই আইনের আশ্রয় নিতে পারতে শংকর।


- আইন তো আমাদের জন্য না মেজদা। পিয়ন থেকে মেজিষ্ট্রেট পর্যন্ত পয়সা ঢালার ক্ষমতা ভগবান আমাকে দেননি। থাক, আমি নিজে খেলে বোনও একমুঠো খাবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ঝরে শংকরের কন্ঠ চিরে। ঘরের মাঝে একরাশ বিষন্নতা খেলা করে।


- স্বপ্না এখন কোথায়? স্বব্ধতা ভাঙ্গি আমি।


- মাতৃমঙ্গলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি। ভালোই করেছিস। নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখুক।


- সীমা চা নিয়ে ঘরে ঢুকে।


- চা খাও মেজদা। টেবিলের উপর চা রেখে বেরিয়ে যায় সীমা। অনেক বড় হয়ে গেছে সীমা। কে জানে ওর কপালে কি লিখা আছে। এ দেশের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েগুলোর কপালে কি কখনই সুখ আসবে না?


আমি চায়ের কাপে চুমুক দেই।






শংকরদের বাড়ী থেকে বেরিয়ে আমার মনে পড়ে আমাদের প্রাইমারী স্কুলের হেড স্যার গোপেশ আচার্যের বাড়ী এখানে। আমি আগে কখনও স্যারের বাড়ীতে যাইনি। স্যারের রাগী মুখটা খুব মনে পড়ে আমার। পড়া না পারলে বেত ঝলসে উঠতো স্যারের হাতে। অনেকে হয় তো বিশ্বাস করবে না, কিন্তু আমরা ৭২-৭৩ এ কলাপাতায় অ, আ লিখেছি এক বিশেষ গাছের রস দিয়ে। শিমের বীজ দিয়ে অক্ষর সাজিয়েছি। সুর করে নামতা পড়েছি। স্যারের বেতের ভয়ে কাঁদেনি এম ছেলে ছিলো না। স্যার মারতেন খুব কম। কিন্তু বেত দোলাতেন ভীষন। আমরা ভাবতাম এই বুঝি কারো পিঠে পড়ে।






শংকরকে বলতে শংকর স্যারের বাড়ীতে নিয়ে যায়। স্যারের তিন ছেলের দুজন এখন আলাদা সংসার পেতেছে। ছোট জনের কাছেই স্যার থাকেন। অবস্থা মোটেও ভালো না। একটা চৌকিতে ময়লা বিছানায় স্যার শুয়ে ছিলেন। আমি দেখা করতে এসেছি শুনে উঠে বসলেন। আমি দেখলাম শীর্ণ এক বৃদ্ধ। শুধু চেহারায় কিছুটা পুরনো ছাপ। সব চুল সাদা হয়ে গেছে। বললেন-


- কে? কে এসেছে। আমি প্রণাম করে বল্লাম-


- স্যার, আমি চন্দন।


- পাল পাড়ার?


- হ্যাঁ স্যার।


- কি করছিস? চোখে ভালো দেখি না। বাড়ীর সবাই ভালো।


আমি বল্লাম সব কথা।


- তোর খোঁজ আমি রাখি। অনেক কষ্ট করেছিস। কাজ করে যা, ঠাকুর চালিয়ে নেবেন।


কিছুক্ষণ বসে, স্যারকে প্রণাম করে বেরিয়ে আসি। কিসের এক ব্যাথায় জানি মনটা হাহাকার করে উঠে।