গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৮

জয়িতা ভট্টাচার্য

মুক্তিপ্রাণা

মন্দিরা কষ্ট করে চোখ মেলে। দূরাগত ধ্বনি আরতির।ঘন্টা বাজে । সন্ধ্যা হয়ে গেছে,নাকি মঙ্গলাচরণ।আবছা ।
     এভাবেই আবছা হয়ে থাকে দিনভর। দিন রাত বোঝা যায়না। ঘাড় বেঁকিয়ে দেখে অনেক ওপরে।একটা ঘুলধুলি ।অস্পষ্ট আলো।এক আলোকবর্ষ পেরিয়ে অন্য আলোকবর্ষে ভেসে যাওয়া।
এখানে চার।তিনটি মসিলিপ্ত দেওয়াল ,একটা ছেঁড়া মাদুর। এক ঘটি জল ।দুর্গন্ধ ,পোকা ভাসে।
   মন্দিরার প্রস্রাব পায়। কোণের দিকটা সরে যায় বুকে হেঁটে। পৌঁছতে সময় লাগে। চাপতে পারেনা আজকাল। হরহর করে করে ফেলে । ঘটিটা গড়িয়ে জল। তবু হাইড্রোক্লোরিক এ্যাসিডের বাষ্প পাক খায়। মন্দিরা একটা সরীসৃপ। মানুষ ছিলো অনেকদিন আগে। ঠং করে আওয়াজ।
উর্দিপড়া মেয়ে মানুষগুলো তার ব্যাপারে ঢিলে ঢালা। মুক্তির সব পথ রুদ্ধ হয়েছে তার।
_____" মন্দিরাদি খেয়ে নাও "
রোজকার মতো সে থুতু ছিটিয়ে দেয় ওদের দিকে।ওরা হাসতে হাসতে চলে যায়।
মুখ বদলে যায়।উষা,বিপাশা,মালতি ----পুষ্পা বা সোমা।ওরা একটাই মানুষ। উর্দি প্রজাতি।
মাছি তাড়ায় মন্দিরা। কোমড়ের নীচে থেকে অসাড় আজকাল।মন্দিরা ন্যাড়া হয়ে থাকে। কামানো ।ওরা আর চুলের মুঠি ধরে না আজকাল।দিন পাল্টেছে।তবু পোকা হয়।
সেল নং ১০৬তার ঠিকানা শেষ কুড়ি বছর।পরিবর্তন তারও হয়েছে এত কবছরে ।বছর পাঁচেক আগের কথা।
___" দিদি কাল মানবাধিকার কমিশনের লোক আসবে তোমাকে দেখতে ।"
এসেছিলো চার পাঁচজন ।
মালবিকা গুপ্তা ,রেশমি খাণ্ডেলওয়াল,দিপীকা সেনগুপ্ত ।তখন কোমড়ে চেন পড়ানো থাকত ,পা দুটো একেবারে অবশ হয়ে যায়নি ,তলপেট ধ্বংসস্তুপ। পূর্বতন  সরকারের দান।
___"আপনার কী কী কমপ্লেন আছে বলতে পারেন"
_____" আয়্যাম এ্যাবসোলিউটলি পারফেক্ট ম্যাম্"
আগুন চোখে তাকিয়ে জবাব দিয়েছিলো মন্দিরা ।ছ্যাঁকা লেগেছিলো গলার স্বরে ওদের।
         গভীর জঙ্গল .........একটার পর একটা ল্যান্ডমাইন পোঁতা ............এনকাউন্টার দৈনিক........দীপঙ্কর,গোম্শ .....পার করে দিচ্ছে সুমন ,তাকেও......ঠেলে পাঠিয়ে দিয়েছিল সুমনকে জোর করে .......গাছের শেকড়ে আটকে গেল পা ....শম্পা সায়নাইড, রয়ে গেল সে সময়ের ভগ্নাংশে...আবছা স্বপ্নের মতো ছবি।
           পরদিন নতুন সরকারের তরফে মোটা মোটা শেকল খুলে নেওয়া হলো ,নগ্ন গায়ে মোটা জামা ছবি উঠল মহান সরকারের বদান্যতায়।
মহানুভব এসি সুজিত মুখার্জীর কল্যাণে কলম কাগজ।
       দেওয়ালে নখ দিয়ে আঁক় কেটে কেটে লেখে ,আঁকে। মাঝে মাঝে শোনে তার মুক্তির আদেশ হবে। ভয় পায়।এসব জীর্ণ দেওয়াল ,গায়ে জলছাপ আর ফাটলের কারুকাজ,এই অন্ধকার গর্তে ই সে অভ্যস্ত ।ভালো আছে সে। বাইরে আর যেতে চায়না  এই দ্বীপ তার আত্মরক্ষার খোলোস।
      ডায়রির পাতা ভরে যায় অসংখ্য দলিলে।
      ভিজে ঘাস আর শেকড়ের দড়িতে আছড়ে পড়ে থাকে মরার মতো।
বুট পরা পা উল্টে দেয়। কেউ নেই। শালবনের অন্ধকারে ঘিরে ফেলে ওরা।ভারত সরকারের ছাপকাটা ইউনিফর্ম। থাই ঘষে দেয় জুতো দিয়ে। পালাতে যায়। একবার দুবার তিনবার.......সপাট চড়।
নিম্নাঙ্গ উন্মুক্ত করে ফেলে ওরা দশ। বেয়োনেটের নল .......গুঁজে দেয় ,প্রতিরোধের সঙ্গে যন্ত্রণা। চলতে থাকে দশটি পুংলিঙ্গের তাণ্ডব।রক্তাপ্লুত হয়ে অচেতন শেষবার গুলি চলে।পড়ে যায় একটা পিশাচ।
মেদনীপুর জেলে চাবুক আর ধর্ষণ পারেনি কথা বার করে নিতে।
পিটিয়ে পিটিয়ে ভেঙে দিয়েছে কোমরের হাড়। বিনা চিকিত্সায়। রক্ত বমি।পেটের ঘা। যৌনাঙ্গ রক্তাশ্রাবের নদী.............
"আহা ভালো থাক। বেঁচে থাক জাগরনের দল। বেঁচে থাক আমার সুমন।"
সেরাতে শেষবার রাত হলো রাতেরই মতো।বানমুড়ি র জঙ্গলে অস্থায়ী শিবিরে সুমন নেকড়ে হ়য়ে গেল আর মন্দিরা নাগিনী। দুজনে উন্মত্ত প্লাবন ডেকে আনলো তৃষ্ণার্ত ফকিরের মতো সারা রাত,চারবার.... ভোর তিনটেয় প্রথম এনকাউন্টার.........
এবছর স্বাধীনতা দিবসে যথারীতি কিছু বন্দীমুক্তি হবে। কিভাবে যেন মন্দিরা ব্যানার্জীর নামটা উঠে গেল লিষ্টে।
মন্দিরা অসহায় বোধ করে।বাইরের পৃথিবীটা কেমন তার জানা নেই। পঙ্গু মাথা কামানো ডিগডিগে জরাগ্রস্থ মানুষটা কী করবে কোথায় যাবে ভেবে কুঁকড়ে যায় সে।
তবু তাকে চান করিয়ে নতুন পোষাক পরানো হলো আর কারা যেন বহূদিনের কোন চেনা গ্রহ থেকে নিতে এলো।
শহর গ্রাম ছাড়িয়ে দূরান্তের এক ঝিকমিক সরু নদীর ধারে নির্জন আশ্রমে তাকে নিয়ে এলো প্রায় বিস্মৃত হয়ে আসা সাথীরা।
              
ফিকে আলোর রেখা তখনও ফোটে না।আকাশে একই সাথে ডুবন্ত চাঁদ আর বিদায়ী রবির আলো।একটা পাখি এসময় ডাকে।শিস।মৃদু হাওয়া ঠাণ্ডা , শান্ত ছবির মতো দিনের আগমনী।এক বৃদ্ধ শ্বেত শুভ্র।দাড়ি,গোঁফ বসন কুঞ্চিত চামড়া সবই শুভ্র সুন্দর।গ্রামের লোক বাবা বলে।কেউ বলে সুফি বাউল কেউ সাধু।একা থাকেন।সাধন ভজন নেই।গান হয়।কথা হয়।কখনো টুকটাক জ্বর জারি,কাটা ছেঁড়ার চিকিত্সা,কুচোদের লাঠি খেলা ,আর উদ্দাত্ত গলার গান।
আজ দিনটা অন্য। আজ অনেক ফুল তুলছেন বৃদ্ধ।কবিও বটে।আজ ওরা ওকে নিয়ে আসবে।তাঁর জীবন প্রতিমা।
        
                সুমন নিজেকে নির্মোহ ভেবেছিলেন।আর কেন....তবুও অস্থির লাগছে।এত বিলম্ব কেন!
এত বিলম্ব.....প্রায় বিশ বছর বা আরো বেশি ঠিক ঠাহর হয়না পূর্বাশ্রমের কথা।শুধু একচিলতে বেদনার কাঁটা।বর্ষণমুখর রাত,গভীর অরণ্যানি আবছা হয়ে আছে ছবিটা। মন্দিরা মরতে পারলো না।পড়ে গেলো লতা গুল্মে পা আটকে......না তিনি যান নি একবার ও।দু তিন জন আরো যারা পালাতে পেরেছিলো রয়ে গেল সেবক হয়ে।
তারাও ফিরতে চাইলো না পুরোনো জীবনে।এই এখানে পণ্য সভ্যতা থেকে বহূ দূর দূরে নদীর পাড়ে ছোট্ট কুটিরে।
উষার প্রথম কিরণের মতো সাদা এ্যাম্বুলেন্স নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে। ওরা,তাপস,সুবিমল বাদল আর অঞ্জলি যত্ন করে নামিয়ে নিচ্ছে ওকে। তিনি সমুখের  একমাত্র ঘরটি তে সাদা চাদর বিছিয়ে রেখেছেন।
তিনি গ্রামের পথে শান্ত সমাধিস্ত মন,
"হ্ৃদয়নন্দন বনে নিভৃত এ নিকেতনে....."
এখন একটু মাধুকরীর সময়। ওর কাছে আসার আগে আরেকটু সময় চাই।

            __"এসো" ,দরজায় দাঁড়িয়ে কবি। মানবতার পূজারী ,বিপ্লবী। বিমুঢ়। দেখছেন চোখ ভরে। প্রতীক্ষার অবসান।
নেড়া মাথা,শিশুকন্যার মতো জ্বলজ্বলে মুখ বড়ো বড়ো চোখে সারল্য। কোমর অবধি চাদর টানা। দুহাত বাড়িয়ে ডাকছে সে।
পাশে বসেন। সময় স্তব্ধ হয়। চোখে চোখ।
গোমুখ থেকে গঙ্গাসাগর যাত্রা শেষ।
চিবুকটা ধরে এই প্রথম গাঢ় স্বরে উচ্চারিত হয় , "মুক্তিপ্রাণা",
মন্দিরা শিহরিত হয়।
অস্ফুটে বলেন __"সুমন",
__"আজ থেকে তোমার নাম মুক্তিপ্রাণা"

নদীর ওপার থেকে একদল বক পাখি উড়ে যাচ্ছে আকাশে।শীর্ণ একটি হাত আরেকটি হাতকে আঁকড়ে ধরে।