গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৮

রত্না ঘোষ

আদর্শ স্ত্রী

               

         হ্যালো রজত বলছিস? শোন একটা  সংবাদ আছে রে! সরকার দা মারা গেছেন।
         কি বলছিস! সরকারদা,মানে আমাদের সরকার দা!
        হ্যারে। এই রজত শোন না তোর গাড়িটা নিয়ে আয় । আমি সুজিত আর পবিত্র কেও বলেছি । চল আমরা চারজন একসাথে যাই। শেষ প্রণাম করে আসি।
কোথায় যেতে হবে?"
কেন কল্যাণীতে? ওনার বাড়িতে ?
ও হো আজ তো রবিবার । উনি তো প্রায় শনিবার রাতে বাড়ি যান সোমবার সকালে আসেন।
কোথায় মীট করবো?
তুই গাড়ি নিয়ে এখানে চলে আয় সুজিত আর পবিত্র এখানেই আসবে।      
              সরকারদা বছর দুয়েক হোল ট্রান্সফার হয়ে আমাদের অফিসে এসেছেন। আমাদের থেকে একটু বড়। তবে দেখে বোঝা যায় না । আরও অল্প বয়সি লাগে । সব সময় ফিটফাট,চুল গোঁফে কলপ করা ইস্ত্রি করা জামা প্যান্ট পরে,কখনো বা কালারফুল  টি-শার্ট পরে,দামি জুতা পায়ে দিয়ে, সুগন্ধি মেখে, মোদ্দাকথা ফিটফাট হয়ে অফিসে আসতেন । ভীষণ রসিক মানুষ সরকারদা । উনি থাকা মানেইআসর জমে ক্ষীর ।
      ওনার মনটিও ছিল দরাজ। অফিস ক্যাণ্টিনে  যদি একসাথে কোনদিন টিফিন করতে যেতাম,উনি কোনদিন আমাদের টাকা দিতে দিতেন না প্যাকেট থেকে দামি সিগারেট বের করে আমাদের অফার করতেন।
           গতবার অফিস পিকনিকে প্রথম দেখি সরকার বৌদি কে। সরকারদার থেকে বেশ ছোট বয়সে । তবে দুজনার প্রেম দেখার মত ।ওদের পাঁচ বছরের মেয়ে আছে  একটা মেয়েটার আর বউদির মুখটা চোখে ভাসতেই মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল । সত্যিই ঐ রুপ ও যৌবন নিয়ে বৌদিই বা কিভাবে সারাটা জীবন চালাবেন। আর ওইটুকু বাচ্চা বাবাকে কতদিনই বা পেলো?বাচ্চাটার  মুখটা চোখের সামনে ভেসে আসতেই নিজের  ছেলের কথা মনে পড়ল । আমার ছেলেটাও তো ওর বয়সি ।আজ যদি আমার কিছু হয়ে যায় কিভাবে আমার সংসার চলবে ।
পিনাকিদা চলে এসো।"--- রজতের গলা শুনে ভাবনায় ছেদ পড়ল । 
"আসছি ।"--বলে বাড়ির ভেতরে গেলাম । তুলি মানে আমার স্ত্রীর মুখোমুখি হতেই মনটা কেমন যেনো হু হু করে উঠলো । ওর কাছে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রেখে ধরা গলায় বললাম সরকার দা হঠাৎ মারা গেছেন।  আমরা ওনার বাড়ি কল্যাণীতে যাচ্ছি । তুমি টুবাইকে নিয়ে সাবধানে থেকো ।আসতে আমার দেরি হবে "---বলে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম জানিনা কেন এক সতীর্থর মৃত্যু হয়তো আমাকেও ভাবাচ্ছে ।
রজতের পাশে সামনে আমি বসলাম ।  পেছনে সুজিত আর পবিত্র । পবিত্রই প্রথম বলল
-বড্ড ভালো মানুষ ছিলেন সরকারদা।"
-হ্যাঁ খুব আমুদেও ছিলেন  সুজিত বলল
-সবচেয়ে বড় কথা বৌদির সাথে   ওনার রসায়নটা সুন্দর ছিল বল ----রজত বলল।
-মেড ফর ইচ আদার  সুজিত বলল।
আগেরবার পিকনিকে সরকারদা বৌদির কোমর ধরে কি সুন্দর বল ডান্স করছিল! বৌদি কি সুন্দর সাবলীল ভাবে অংশগ্রহণ করলেন !আমাদের গুলো তো লজ্জায় মরে । রজত বলল-
                এই তোরা চুপ কর আর ভালো লাগছেনা। বলে  ওদের থামিয়ে দিলাম। সবাই চুপচাপ আমি মাথাটা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলাম ।কিন্তু ভাবনারা কিছুতেই সরকার দার উপর থেকেই যাচ্ছে না ।
            সরকারদা কলকাতায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকেন । ওনার বাড়ি কল্যাণীতে। কোনদিন জিজ্ঞাসা করিনি কে কে আছে বাড়িতে?তবে মাসে একবার কি দুবার কল্যানী যান ।যে যে সপ্তাহে উনি কল্যানী যান না সেই সপ্তাহে  শনিবার রাতে ওনার বাড়িতে মজলিস বসে । আমি কয়েকবার গিয়েছি । সরকারদা ফূর্তিবাজ লোক হওয়ায় ওনার সান্নিধ্য আমাদের বেশ ভালো লাগত। দামি ফরেন লিকার আমরা খেতাম বৌদি চা বানিয়ে দিত । বৌদি কিন্তু বেশ সেজেগুজে সরকারদার কোল ঘেঁসে বসত। সরকারদা আমাদের সামনেই বৌদিকে মাঝে মাঝে হাল্কা আদর করতো। আমরা  ঈর্ষা করতাম সরকার দার স্ত্রী ভাগ্যকে । আর রাগ হত নিজের জীবন সাথীর উপর । দু ঘন্টা ওখানে কাটিয়ে ঘরে ফিরে  মিলত গঞ্জনা আর অপমান ।কোন দিন নেশার ঘোরে তুলিকে বলেও ফেলেছি ---"দেখে এসো সরকার বৌদিকে কিভাবে স্বামীকে সাথ দিতে হয়। নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে তো কোনদিন মানসিকতার পরিবর্তন হলো না ।".  তুলি রাগে লজ্জায় ঘৃণায় পাশের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিত।
                 আমাদের সাথে একসাথে চাকরি করেও ব্যয়বহুল জীবন সরকার দা কিভাবে কাটাতো সে বিষয়ে আমাদের সবারই মনে প্রশ্ন ছিল । তবে আমরা এটাই ভেবেছি উনি ধনী ঘরের ছেলে । প্রচুর সম্পত্তির অধিকারী তাই ওনার জীবন যাপন অনেক স্বচ্ছল । জিজ্ঞেস করিনি আদার ব্যাপারির জাহাজের খবর নিয়ে কি দরকার?
               আমাদের গাড়িটা এখন কল্যাণী রোড ধরে চলছে। রাস্তার দু দিকে শ্যামলীমায় পরিপূর্ণ ।বড় বড় জলাশয় আর পাটক্ষেত। ইট কাঠ পাথরের জঙ্গলে বসে ভাবতেই পারি না । কয়েক বছর আগেও বাইপাস দিয়ে গাড়ি করে গেলে যে সবুজ দেখা যেত এখন তা মেট্রোর লাইনের  কংকাল আর ধুলো কাঁদা ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। রাস্তার দুদিকটা ভীষণ ভাল লাগছে । কোমর জলে দাঁড়িয়ে চাষীরা  পানিফল তুলছে। জায়গায় জায়গায় পাট জাগ দেয়া রয়েছে দেখলাম ।বেশ ভালো লাগছে।
               কল্যানী শহর টা বেশ সাজানো ।সরকারদার বাড়ী শহর ছাড়িয়ে অনেকটা ভেতরে। লোককে জিজ্ঞেস করতে করতে যখন বাড়ির সামনে এলাম তখন বেলা এগারোটা । ওনার বাড়ির সামনে এসে থমকে গেলাম । চারজন চারজনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে । কিছু  কি ভুল হল ?
তবে বাড়ির পরিবেশ ও লোকজনের উদ্ভ্রান্ত চোখমুখ বলে দিচ্ছিল এখানে কিছু অঘটন অর্থাৎ  কারো মৃত্যু হয়েছে ।
              পায়ে পায়ে টালির চালের মাটির বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম । ভালো করে  দেখতে মৃতব্যক্তি সরকারদা কিনা। দেখি হ্যা সরকারদাই যেন  টানটান হয়ে ঘুমিয়ে আছেন তক্তপোশের উপর । গায়ে অবশ্য দামি টি-শার্ট আর লুঙ্গি । কোন প্রশ্ন না করে ঘর থেকে বেরিয়ে যেখানে পুরুষদের জটলা সেখানে গেলাম । জানলাম ঘুমের মধ্যেই মারা গেছে ন ।
             বৌদিকে খুঁজলাম ।তখন একজন বছর পঁচিশেক মহিলা যার চোখ অধিক ক্রন্দনে ফুলে গেছে । তিনি এসে আমাদের পরিচয় জেনে নমস্কার করে বললেন "আমি ওনার মেয়ে । মা মানসিকভাবে বিধ্বস্ত ।মায়ের সাথে দেখা করবেন? এই বলে ঘরের পেছনের বারান্দায় নিয়ে গেল ।
              সেখানে গিয়ে দেখি মধ্য বয়সী এক মহিলাকে পাড়ার মহিলারা ঘিরে বসে আছে।  সবাই বলল মহিলা বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন ।
              সমস্ত কিছু দেখে আমরা চারজন যে মানসিকতা নিয়ে এখানে এসেছিলাম তা আর রইল না ।হৃদয়ে শোকের লেশমাত্র নেই।  অজস্র প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে ।ওই মহিলা যদি ওনার স্ত্রী তবে কলকাতার উনি কে?
                চারজনে চাপাস্বরে এসব নিয়ে যখন আলোচনা করছি তখন দেখি ওই পাড়ার কয়েকজন লোক আমাদের কাছে এসে স্বপ্রণোদিতভাবে জিজ্ঞেস করল,
আপনারা তো অফিসের লোক । বলতে পারেন  মেয়েটি চাকরি পাবে কিনা? আপনাদের অফিসে? না হলে তো মা বেটিতে  না খেয়ে মরবে।
দেখুন পাওয়াতো উচিত । কিন্তু সরকারদা স্ত্রী হিসাবে কাকে দেখিয়েছিলন অফিসে  তা তো জানিনা । সুজিত বললো
 মানে?
 মানে  আর কিছু নয়সরকারদা অফিসে অন্য এক মহিলাকে স্ত্রী পরিচয় দিয়েছেন । সেখানে একটি পাঁচ  বছরের মেয়েও আছে । কাগজে কলমে কাকে  দেখানো হচ্ছে তা  তো জানিনা.....

 আমরা তিনজন ইশারা করে  সুজিতকে থামালাম । তারপর বললাম,----" আগে সৎ কার হোক শ্রাদ্ধ শান্তি মিটুক  তারপর বৌদিকে আর মেয়েটিকে নিয়ে আপনারা অফিসে আসুন।। কাগজপত্র ঘেঁটে দেখতে হবে।।"
 নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সরকারদার মেয়ের হাতে দু হাজার টাকা দিয়ে ওখান থেকে চলে এলাম । শ্মশানে যাবার ইচ্ছেটা মরে গেছে । যত ওখানে থাকতাম ততই সকলের প্রশ্নে জর্জরিত  হতাম ।তার থেকে পলায়নই শ্রেষ্ঠ উপায় মনে করলাম ।
বাড়ি এসে স্নান করে ফ্রেস হয়ে তুলিকে  কাছে ডাকলাম । বুকের কাছে জড়িয়ে বললাম,--“সরকার দার স্ত্রী সত্যই আদর্শ স্ত্রী । স্বামীর মৃত্যুতে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন।"