গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৬

তাপস মৌলিক /দুটি অনুগল্প

হ্যালো

এম ডি ফরমান জারি করলেন ফোন তুলে আর ‘হ্যালো’ বলা চলবে না। ওতে নাকি ফালতু সময় নষ্ট হয়। ‘- হ্যালো।’ ‘- কে বলছেন?’ ‘- আপনার কাকে দরকার?’ ‘– চক্রবর্তী আছেন?’ ‘- চক্রবর্তীই তো বলছি।’ ...ইত্যাদির বদলে ফোন তুলেই বলতে হবে ‘চক্রবর্তী’। মানে ‘হ্যালো’র বদলে প্রথমেই নাম কিম্বা পদবী, যে যেভাবে অফিসে পরিচিত।
তখনও মোবাইল আসেনি। এক ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট এম ডির মাথায় ঢুকিয়েছিল, কিভাবে শুধু ‘হ্যালো’ বলার বদভ্যাসে কোম্পানির কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা জলে যাচ্ছে। সে এক বিচিত্র হিসেব – একজন এমপ্লয়ী দিনে গড়ে কতবার ‘হ্যালো’ বলেন, তাহলে মোট সাড়ে আটশো লোক বছরে কবার বলবেন, তাতে কত মূল্যবান সময়ের অপচয় হয়, সেই সময়কে কনস্ট্রাকটিভ কাজে লাগালে কোম্পানির রেভেনিউ কত বাড়ে, প্রফিট মার্জিন কত চড়ে, ইত্যাদি ইত্যাদি। সুতরাং সার্কুলার বেরিয়ে গেল - ‘টেলিফোন ম্যানারস’।
আমরাও কষ্টেসৃষ্টে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করলাম।
আমাদের কোয়ালিটি কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্ট সরাসরি রিপোর্ট করত এম ডিকে। সেখানে সিনিয়ার ম্যানেজার ছিলেন অংশুমান বল।
দিন পনের পরের এক সকাল। অংশুমানবাবুর বস তখন ট্যুরে। টেবিলে একটা ফোন এল। উনি রিসিভার তুলেই বললেন, “বল”।
“মাজুমদার স্পিকিং”, ওপারে এম ডির গম্ভীর গলা।
“হ্যাঁ, বল।”
“হু ইজ ইট?”
“বলছি তো, বল।”
“হাউ ডু ইউ ডেয়ার টু টক টু মি লাইক দিস? ইউ ..."
অংশুমানবাবুর চাকরিটা কোনওমতে বেঁচেছিল, ইনক্রিমেন্টটা আটকে গেল।

যুক্তি-তক্কো-গপ্পো

মা’কে অনেকবার বলেছিলাম, “মা, চন্দ্রবাবু ডাক্তারের বয়েস হয়েছে। আশি তো হবেই। কী দরকার ওঁর কাছে গিয়ে? কত ভাল দাঁতের ডাক্তার আছে কলকাতায়!” মা’র সেই এক কথা, কুমিল্লার লোক ছাড়া কেউ নাকি দাঁত তুলতে পারে না।
ঝুম্পাও বলল, “থাক দাদা, মা যখন চন্দ্রবাবুর কাছে কমফর্টেবল..। লোকাল ডাক্তার, দৌড়োদৌড়ি নেই, আমাদের চেনেন।”
“আরে তুই জানিস, উনি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে গাইতে দাঁত তোলেন!”
“জানি, কথা তো সব উল্টোপাল্টা গান, তাছাড়া গলায় সুরও নেই, তুই চিন্তা করিস না।”
বোঝো!
কাল দাঁত তোলার পর সব ঠিকঠাকই ছিল। আজ সকালেই মা’র গলা, “রাণা, এইদিকে আইয়া দ্যাখ সে একটু। যেই দাঁতটা ফালাইল কাইল, তার পাশেরডাও তো নড়তাসে।”
যা ভেবেছি তাই। নড়া দাঁতটা না তুলে চন্দ্র ডাক্তার পাশেরটা নিখুঁত তুলেছেন।
ঠিক তখনই কলিং বেলের আওয়াজ। দরজা খুলে দেখি চন্দ্র ডাক্তারের কম্পাউন্ডার, হাতে একটা চশমা, “ডাক্তারবাবু আপনার মায়ের চশমাটা পাঠিয়ে দিলেন, ওনারটা চেয়েছেন।”
চমকে মা’র দিকে তাকালাম, “ও কী! তুমি কার চশমা পরেছ? ওটা তো মনে হচ্ছে ডাক্তারবাবুর। আমি খেয়ালই করিনি!”
নিজের চশমা পরে মা বললেন, “অ, তাই ক, আমি ভাবতাসি আশ্বিন মাসের সকালে এইরকম কুয়াশা পড়সে ক্যান?”
ফোনে ধরলাম চন্দ্র ডাক্তারকে, “ডাক্তারবাবু, রাণা বলছি।”
“ও, হ্যাঁ, রাণা, বলো। মা ঠিক আছেন তো?”
“আরে আপনি করেছেন কী? মা’র যে দাঁতটা তোলার কথা ছিল, তার পাশেরটা তুলে দিয়েছেন!”
“তাই নাকি? যাব্বাবা! তোমার মায়ের চশমা পরেই তুললাম তো। আমার কী দোষ ?”