শীত বিকেলটি চেপে বসছে বুকের ভেতর। সন্ধ্যামণি ফুলের ঝোপে মশারা পাক খাচ্ছে বিনবিন সুরে। একটি লম্বা পাটখড়ি হাতে অনির্দেশ্য
চোখে তাই দেখছে রুমকি। বেগুনি হলুদ লাল
ফুলগুলো তারার চোখে চেয়ে আছে। রুমকির
বুকের ভেতর হাজারটি মায়া পাখি ডানা ঝাপ্টে ঢুকে পড়ে। কি সুন্দর দৃশ্য। বড় আপন
আপন লাগছে মনের ভেতর। কত বছর পরে ফিরে আসা
শৈশবের এই বাড়িতে!
রমজান ডাক দেয় , ও ফুফু কহন আসিছেন ? ছেলেটির বয়েস মাত্র পনের বা ষোল । তার ছেলের অনেক ছোট। সেভেন
পর্যন্ত পড়েছে। ইশকুল ড্রপ আউট । এই বাড়ির গরু ছাগল দেখাশোনার সাথে এটা সেটা খুচরো কাজ করে । এগিয়ে আসে রুমকি, তুই
নৌকা বাইতে পারিস ? তালশাঁস দাঁত বের করে হাসে রমজান, কোহানে যাবেন ফুফু ?
এক কোষা
নৌকা ধীরে ধীরে বেয়ে যায় রমজান। রুমকি
দেখে খালের পাড় ঘেঁষে দাঁড়ানো তিনটি তালগাছ । এক চিলতে সাদা রাস্তা উঠে গেছে একটি
উঁচু ভিটেতে। বাড়িটার কোণাকুণি উঠোন দেখা যাচ্ছে। --কার ভিটে জানিস ?”
--বালাম পালের ভিটে ছেলো। এহন নাই।”
-- নাই মানে? ইন্ডিয়া চলে গেছে?”
– না হেরা ত ঢাহা থাহে। চৈতন কাহা থাহে এহানে। তয় হাঁড়িকুঁড়ি আর বানায় না। ছিটকাপুড়ের দোহান দেছে বাজারে।”
পাল বাড়ির একটি ছেলেকে সে চিনত। পর পর দুবার অংকে টপার হয়ে চমকে
দিয়েছিল মডেল ইশকুলের শিক্ষকদের। তাকে
ফ্রি কোচিং দিয়ে এসএসসি তে ভাল রেজাল্ট করানোর
জন্যে স্যাররা খুব খেটেছিল। সেই রামু নিচু ক্লাশের ছেলেমেয়েদের অংক দেখে দিত। কালো ঝিকঝিকে রঙ ।
সরু সরু হাত পা। রুমকি খুব ভোগাত। অংক নিয়ে চরম বিরক্ত ছিল সে । সাড়ে, পাঁচ সিকা, দশমিক, ভগ্নাংশ, হাতে রাখা অংকের প্যাচ ও
কোনোদিন বুঝত না। রামু খুব চেষ্টা করত। “ মনে কর তোর বাবা একটা ওষুধ দুই টাকা দশ
পয়সায় বিক্রি করে। আসল দাম দুই টাকা। এক ডজনে কত হবে ?”
রুমকি দশ পয়সার ঘাপলা মেটাতে না পেরে বলে দিত, তুই শচিন কম্পাউন্ডারকে জিগ্যেস করে জেনে নিস রামুদাদা।” হাসির ধুম পড়ে যেত আর রামুদাদা করুন
মুখ করে বলত, পড়াশুনা করতি হলি পাত্থনা করতি হয়। তুই অংকে ফাঁকিবাজ রুমকি।”
একদিন কোচিং
এ গিয়ে শোনে রামু চলে গেছে যাত্রার দলে। পড়াশুনা করবে না। রামুর এক মামা যাত্রাদলে
হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গায়। ভাল বেতন। খাওয়া
থাকা ফ্রী। সেই নিয়ে গেছে। খবরটি জানতেই ছুটে গেছিল অংকের দুই স্যার। রামুর মা মাটির চুলোয় ধিকি ধিকি জ্বলা
আগুনের দিকে তাকিয়ে স্যারদের বলেছিল, প্যাডে ভাত নাই । বচ্ছরের আধেক সুমায় খাতি
পাই না জানেন তো মাস্টারমশাই । লেহাপড়া করি কবে কি হবি তার জন্যি তো এতগুলান প্যাড বসি
থাকপে নানে।”
আজাহার আর দিলীপ স্যার
শহরের শ্রেষ্ঠ অংক শিক্ষক, যে কোন ছাত্রকে তারা পড়ান না। মুখ নিচু করে সেদিন ফিরে এসেছিলেন দুজনে।
রমজানকে
পালবাড়ির ঘাটে থামতে বলে রুমকি। “চল তো ঘুরে আসি। কত বছর এরকম ঘরবাড়ি দেখি না।” তাল গাছে নৌকা বেঁধে
রমজান আগে আগে হেঁটে উঠোনে পা দিয়েই হাঁক
পাড়ে, ও কাকী কোহানে আছ বারুয়ে আসো। দেহ কিডা আইছে।”
বাড়ির উঠোনে
ছোটখাট ভিড় জমে যায়। প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে আসে কেউ। “কিডা গো? হেলতের আপা নাহি।”
রমজান পরিচয় দেয়, আরে না কাকি! অই যে বুড়ো ডাক্তারদাদুর মাইয়ে ।
আমিরিকায় থাহে হেই জন।”
একজন নীল পাড় সাদা শাড়ি পরা রুগ্ন মহিলা রুমকির হাত ধরে , চিনতে
পাতিছিস ? কিলাশ এইট, রোল বাহান্ন।”
চমকে উঠে
রুমকি। এই বুড়ি মত মহিলা তার ক্লাশমেট ছিল ? শুচিস্মিতা পাল। অংকে টপার ছিল। কেউ
ওকে হারাতে পারেনি কোনোদিন । কেন যেন খুব ভাল লাগে রুমকির। শুচিস্মিতার শুকনো খালি হাত ধরে বোকার মত বলে
বসে, কেমন আছ সূচি ? রামুদাদার কি খবর ?
রুমকির হাত
বুলিয়ে আদর করতে করতে শুচিস্মিতা জানায় সে অনেক গল্প রে। কত বছর পরে আসলি নিজের
গ্রামে কতি পারিস? এই দ্যাখ আমার ছেলের বউ, কোলে ওইটা নাতি।”
বউমার কোলের
বাচ্চাটিকে টেনে নেয় রুমকি। বাচ্চাটি একটু অবাক হলেও কাঁদে না। খুব সুখি সুখি লাগে
রুমকির। এই সাততাল্লিশে শুচিস্মিতা দাদি আর সে কেবল একটি তেইশ বছরের
ছেলের মা। তার যখন নাতি হবে সে কি তাকে দেখতে পাবে? কোলে নিয়ে এমন বেড়াল আদরে ভরে
নিতে পারবে বুকের জমিন? বাস্তবে কি কখনো
তার কোনো নাতি হবে? তার ছেলেটি কি ফিরে আসবে নর্মাল পুরুষ জীবনে ?
মরিচ
জবা গাছের পাশ ধরে হাঁটতে হাঁটতে শুচিস্মিতা গল্প করে রামুদাদার। যাত্রার দলে ভালই
ছিল। গান শিখেছিল। হারমোনিয়মে যে কোন হিন্দি গান তুলে নিতে পারত। গ্রাম গঞ্জের মানুষ হিন্দি গান খুব
ভালবাসে। দাদার দাম বাড়ছিল দলে। রামুদাদা
বছরে একবার আসত গ্রামে। শুচিস্মিতাকে বলেছিল কিছু কাজ শিখে নে। সারা জীবন হাতের
উপর হাত রেখে চালাবি কেমন করে? শুচিস্মিতা ধাত্রীর কাজ শিখে নিয়েছিল । এক বিকেলে রামুদাদা একজন সুন্দরী মহিলাকে নিয়ে
হাসপাতেলে আসে। যাত্রা দলের মালিকের রক্ষিতা
সোহিনী । সূচিকে ডেকে বলেছিল, যে করে হোক খালাস করে দে। ও আমাদের নায়িকা। এই
মরসুমে কিছুতেই ওর ছেলে বিয়ানো চলবে না।”
শবনম এইট
পর্যন্ত পড়েছিল। অংকে মাথা ছিল দারুণ। রামু আর শবনম অবসরে অংক করত । যাত্রাপালার
মালিক থেকে সকলের প্রথমে সন্দেহ হলেও পরে অবাক মানে । কেবলই অংকের সম্পর্ক। সেই
সময় খুব সুখে ছিল রামু। কাঁধ পর্যন্ত বাবরি চুল। নিয়মিত খেয়ে পরে সুন্দর নরম
চেহারা হয়েছিল। ভারী ভাল লাগত দেখতে। কিন্তু এর দু বছর পরেই রামুর লাশ পাওয়া যায় মিউজিশিয়ানদের
তাবুতে। পুলিশ আর যাত্রাপালার কেউ কেউ বলে আত্মহত্যা। আবার অনেকেই বলে খুন।
যাত্রাদলের মালিক এসেছিল সাহায্য নিয়ে। সূচিকে গোপনে ডেকে বলেছিল, শোন খুন করলি
অনেক আগিই করতি পারতাম। আমার লুম্বাও তোরা
ধরতি পারতি না। তোগের মা কালির কিরে শবনমের সাথি রামুর অতিরিক্ত ভাব দেখি
খুনের ইচ্ছাও হইছিল। পরে জানলাম রামু নারীসঙ্গ পছন্দ করত না। শালা পুরুষ ভালবাসত।
পুরুষের সাথি শুতি আরাম পাতো। ওরে খুন করি কি সুখ আমার ক দেহি !”
শুচিস্মিতা
পরম যত্নে চায়ের কাপ তুলে দিয়ে নিচু গলায় জানায়, রামুদাদা মরি যাবার দু মাস পরি
যাত্রাদলে বাঁশিওয়ালা হুমদো শামসু আত্মহত্যা করে। বুঝলি এবার!”
রুমকি বুঝে
গেছিল। ছেলে রাতুল যখন তার লেবানিজ বন্ধু রাকিবকে বিয়ে করে চলে যায় ওর মাথায় বাজ
ভেঙ্গে পড়েছিল। কি করে সে বলবে তার ছেলে সমকামী ? পরিবার সমাজ সংসারের
কোনকিছুরই ধার ধারেনি ওরা। ভেঙ্গে পড়েছিল রুমকি। তখন মনে হয়েছিল, মরে যাক রাতুল।
আবার কখনো কখনো নিজেও সুইসাইড করার কথা ভেবেছে। আমেরিকায় থাকলেও সেখানেও তো বাঙালি
আছে, সমাজ আছে। তারা ফিসফাস থেকে ক্রমশ সরাসরি কথা শুনাতে শুরু করেছিল ঠারে ঠারে ।
রাকিবের বাবা মা এসেছিল। তারাই অনেকটা সাহায্য করেছে রুমকিকে। দুঃখ দু পরিবারেই
সমানভাবে বেজেছে। কিন্তু মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কি !
মনকে
সান্ত্বনা দিতেই বহুবছর পরে দেশে এসেছে সে। মনের ভেতর দ্বন্দ্ব ছিল হয়ত একা মা
হিসেবে সে রাতুলকে ভাল শিক্ষা দিতে পারেনি। ওখানকার অনেকেও তাই বলেছিল। রাতুলের
বাবা থাকলে নাকি এরকম হতে পারত না ছেলে। আবার ভাবছিল, এখানে এই দেশে থাকলে হয়ত
রাতুল এরকম হত না! রামুদাদার জীবন রুমকির সব ভাবনাকে চুরমার করে দিয়েছে। এখন মনে
হচ্ছে মৃত্যুর চেয়ে ভয়ংকর আর কি আছে এই
জীবনে ?
রামুদাদা এই সমাজে নিজের মত বাঁচতে পারেনি তাই নিজেকে
মেরে নিঃশেষ করে দিয়েছে। কিন্তু তার ছেলে পেরেছে।
হোক সে সমকামি। রুমকির এবার যথেষ্ট হালকা লাগে। ছেলেটি তবু বেঁচে থাকুক।