গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

অসিত বরন চট্টোপাধ্যায়

রুখা মাটিতে সোঁদা গন্ধ
                    [ প্রথম পর্ব ]

এ এক পলাশের দেশ। বিস্তির্ণ ধূ ধূ মাঠ। সবুজের লেশ বলতে ন্যাড়া পলাশের কিছু বিবর্ণ আধশুখনো ঝরা পাতা। পলাশের অভাব নেই। পেট ভর্তি থাকলেই পলাশ ফোটে। পাশে মহাকাল উল্টানো বাটির মত ন্যাড়া পাহাড়। নামটি ভারী সুন্দর। গৌরাঙ্গী। গৌরাঙ্গী নাম কেন হয়েছিল কে জানে। কেননা পাহাড়ে উঠতে গিয়ে দেখেছিলাম, মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের হাড়, করোটি, দু একটা পুর্ণ নরকঙ্কাল। বাতাসে চাপা গন্ধ। হাওয়ায় দীর্ঘশ্বাস।
পাহাড়ের কোল বেয়ে তিরতির করে বয়ে গেছে মুরাড্ডি নদী। আমি আদর করে নাম দিয়েছিলাম কাজলী নদী। যৌবনচ্ছল কাজলী বয়ে যেত আপনমনে। যে যায়গাটার কথা বলছি,সে যায়গায় খুব একটা কেউ আসতো না। গা ছমছমে পরিবেশ। দু একটা চিল শকুন ছাড়া অন্য পাখীরও দেখা মিলতো না। একটা আধিভৌতিক পরিবেশ।
এ হেন রুখা শুখা ভৌতিক পরিবেশে আমাকে পাঠানো হলো প্রোজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। কারণটা হল চঞ্চলা কাজলীকে বাঁধতে হবে অর্থাৎ কাজলীর বুকে বাঁধ দিতে হবে। অগত্যা রওয়ানা দিলাম জীপগাড়ীতে চড়ে। কিছু ইঞ্জিনীয়ারিং ইনস্ট্রুমেন্টস  নিয়ে ওখানে পৌছে চক্ষু চড়কগাছ। এ কোথায় পৌঁছালাম! ধূ ধূ মাঠ ইতি উতি পলাশের জঙ্গল।এক দেড় কিলোমিটার ব্যাসার্ধে কোন জনবসতি নেই। সকাল দশটায় গা ছমছম করা পরিবেশ। কিন্তু উপায় নেই। চাকরী রক্ষার দায় বড় দায়।
প্রাথমিক কাজ ছিল সার্ভে করা। দুজন রাখাল ছেলেকে দৈনিক মজুরীর কড়ারে সঙ্গে নিলাম যন্ত্রপাতি ধরা আর বওয়ার জন্য। ওরা প্রথমেই ভয় খাওয়ালো,
----বাবু যায়গাট ভাল লহে। যে কোন সময় যা কিছু ঘটে যাতে পারে। ইখানে দিনের বেলিও ভুত বাহিরায়।
ওদের কথা শুনে হাসলাম। বললাম
----যা তবে ঘরের খুঁধিতে ঢুকিন থাক ভুতের ডরে।
এসব কথার মধ্যেই আমি থিওডোলাইট বসিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছি। কাজ করা পাঁচ মিনিটও হয়নি হঠাৎ দেখি ফুট তিরিশেক দুরে একটা বোমা ব্লাস্ট হলো। আচমকা এই ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেলাম। ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া। ড্রাইভার বিজনকে বললাম, 'প্যাক আপ, চল ফিরে যাই।' তড়িঘড়ি সবকিছু নিয়ে সোজা হে'ড অফিস। ভাগ্যিস ঐ বোমায় স্প্লিন্টার ছিল না,থাকলে কি হত ভেবে শিউরে উঠলাম।
[ দ্বিতীয় পর্ব ]
অফিসের বড়সাহেবকে বলতেই উনি বলে বসলেন 
----প্রোজেক্ট তো শুরু করতেই হবে। ভয় পেলে তো চলবে না। যদি রিভলবারের লাইসেন্স চান ডি এম কে লিখে ব্যাবস্থা করতে পারি।
বললাম,
----সে কি? আমি কি যুদ্ধ করবো নাকি?
 
---- যদি কিছু হয় তাহলে পুলিশে খবর দেবেন।
----বেঁচে থাকলে তো দেবো।
---- তা বললে হবে না।
ভাবলাম ছুটি নিয়ে বসে থাকবো। তাও সম্ভব না। কেননা আর্ণড লিভ প্রায় শেষের মুখে। বাড়ীতে গেলাম। কাউকে কিচ্ছু বলিনি। পরদিন সন্ধ্যায় মামাদাদুর বাড়ী গিয়ে নানা গল্পের মাঝে দাদুকে এই ঘটনা খুলে বললাম। দাদু পেশায় এডভোকেট।
  সব শুনে বললেন,
----তুই তিনদিন পরে আয়। তারপর বলে দেব কি করতে হবে।
তিনদিন পর দাদুর কাছে গেলাম। দেখি দাদুর কাছে বসে আছে গাঁট্টাগোঁট্টা এক লোক। নাম দুগাই। দাদু আমাকে বললেন, 
----এই দেখে রাখ। এর নাম দুগাই বাউরী। এদের যে সর্দার তার নাম ভোলা চার আর বীরু চার। ওরা ওই যায়গার মালিক। তুই কাল থেকে যেতে পারিস তবে শর্ত একটাই, তা হলো ওই হলুদ রঙা ১০২১ জীপ ছাড়া যাবিনা,দ্বিতীয়ত কোন রকম পুলিশের কাছে এদের নিয়ে কিছু বলবি না,তৃতীয়ত প্রতিদিন সন্ধ্যে হওয়ার আগেই মাঠ ছাড়তে হবে।
দুগাই বলে উঠলো,
----ঠাকুরবাবা আপনি লিভঃয়ে যাবেন আর কুছু হবেক নাই। হামি আপনার থোবড়াটা দেখিন লিলি। আর কেউ কিছু কইরবেক নাই। কেউ কিছু ব'ল্ল্যে হামকে বলিন দিবেন। উয়াকে তুলিন লিব। আজ হামি তাহিলে চল্লি।
দাদুকে 'পন্নাম ঠাকুর' বলেই দুগাই চলে গেলো। দাদুর কাছে, পরে জানতে পারলাম ওরা দুস্কৃতীর দল। ডাকাতি ওদের পেশা। অত্যন্ত হিংস্র ওরা। ওদের লিডার ভোলা ও বীরু চার। জাতিতে ময়রা। ঐ তল্লাটে ওরাই একছত্র অধিপতি। ওরা ভালো কাজও করে খারাপ কাজও করে। ডাকাতির টাকা দিয়ে যেমন গরীবদের জন্য স্কুল তৈরি
  করে দেয়,গরীব মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা দেয়, তেমনি প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিকেশ করা ওদের বাঁ হাতের খেল। দলের কেউ বেইমানি করলে তাকে চিরতরের জন্য স্তব্ধ করতে দুমিনিটও সময় লাগে না।
যেহেতু আমি সার্ভে করার সময় থিওডোলাইট নিয়ে কাজ করছিলাম, সে সময় ওরা ভেবেছিল আমি পুলিশের চর, দুরবীন নিয়ে ওদের গতিবিধি লক্ষ্য করছি,তাই বোমাবাজী।
ভোলা ও বীরু ওরা দুই ভাই। ভোলা ডাকাত হলেও কিছু নীতি মেনে চলত। অত্যাচারী সুদখোর জমিদার বাড়ি বেছে বেছে ডাকাতি করতো। ভুলেও স্ত্রীজাতির গায়ে হাত দিত না। বৃদ্ধ ও শিশুদের উপর কোন অত্যাচার করত না। পার্শ্ববর্তী  তিন চারটে গ্রামে ছোটদের জন্য স্কুল বাড়ী তৈরী করে দিয়েছিল।
দুঃস্থ পরিবারকেও সাহায্য করত নিঃশর্তে।

পাশের বালিগাড়া গ্রামের স্কুল পন্ডিত বংশী বাবুর ছেলে ভোলা আর বীরু। শোনা যায় বংশী বাবু নাকি খুবই গরীব ছিলেন। অভাবী সংসার হলেও আপ্রান চেষ্টা করে যেতেন দুই ছেলেকে মানুষ করতে। কোন এক জমিদারের কাছে টাকা শোধ না করতে পারার কারণে মিথ্যা চোর অপবাদ দিয়ে লেঠেল দিয়ে ওনাকে প্রকাশ্য রাস্তায় দিবালোকে হত্যা করআ হয়। সেই ঘটনা আর পাঁচজনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছিল ছোট্ট ভোলা আর বীরু।
সেদিন থেকেই ভোলা আর বীরুর জীবন অন্য খাতে বইতে শুরু করে। পলাশ রঙা রক্তের বদলা নেওয়ার শপথ নেয় ভোলা। অকাল বসন্তে পলাশের নেশা তীব্রতর হয়।
একদিকে কষ্ট করে পড়াশুনা চালিয়ে যায় মেধাবী ছাত্র ভোলা, অন্যদিকে বুকে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে দাউ দাউ করে। সেকেন্ড ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাশ করে মা সরস্বতীর সঙ্গে আড়ি হয়ে যায়।
[ তৃতীয় পর্ব ]
দুগাইয়ের আশ্বাস আর দাদুর উপর ভরসা করে বাক্স বেডিং নিয়ে আবারও রওয়ানা দিলাম। জীপ থেকে নেমে পাশের গ্রাম মুরাড্ডিতে বাড়ীর খোঁজ করলাম। কেউ বাড়ী ভাড়া দিতে চায় না। অগত্যা পরিতক্ত  এক কৃষি খামারের কোয়ার্টারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলাম। প্রোজেক্ট এরিয়ার কাছাকাছি। কোয়ার্টার পরিস্কার করতে গিয়ে বেরুলো বেশ কয়েকটি বিষধর সাপ আর কাঁকড়া বিছে। আগাছা পরিস্কার করিয়ে কার্বলিক এসিড ছড়িয়ে দুদিন পর বাড়িতে ঢুকলাম।
এ দুদিন আমাদের বাসস্থান ছিল ছাদবিহীন নির্নিয়মান হাসপাতাল কোয়ার্টার। ফিল্ড হস্টেল তৈরী না হওয়া পর্যন্ত কৃষি খামারের কোয়ার্টারে থাকতে হয়েছিল।
সার্ভের কাজ শেষে মাটি পরীক্ষার কাজও শেষ। লে আউট দেওয়ার পরেই শুরু হল কাজ।
মিঃ চৌধুরী ও মিঃ মল্লিক দুই বড় ঠিকাদার কিছু স্থানীয় এবং বেশ কিছু শ্রমিক এনেছিলেন সুদুর মুর্শিদাবাদ থেকে।
প্রথম দিনেই বিপত্তি। পুজো হলো, নারকেল ফাটানো হলো, কিন্তু কে প্রথম মাটি কোপাবে তাই নিয়ে বচসা। কেউই প্রথম মাটি কোপাতে রাজী নয়, এ যায়গাটা নাকি ভুতুড়ে। যে প্রথম কোপাবে সে নাকি তিন দিনের মধ্যেই রক্তবমি করে মরবে।পলাশে রঙ ধরবে অকালে। কেউ রাজী না হওয়াতে, অগত্যা আমাকেই গাঁইতি ধরতে হলো। পাশে একজন ফুট কাটলো,
---- ই ইঞ্জিনারটা বাভন বঠে,পৈতা আছে কাঁধে,ইয়ার কিছু নাই হবেক।
আমি গাঁইতি নিয়ে মাটিতে কোপ মারতে শুরু করলাম। বার পাঁচেক কোপ মারতেই দেখি এক মাথার খুলি। সবাই চমকে উঠে পালাবার চেষ্টা করছিল। বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওদের বললাম 
----"তোরা ওইপাশে মাটি খুঁড়তে শুরু কর। ওদিকে মাটিটাও নরম আছে।"
ওরা জনা পঞ্চাশ মিলে মাটি খোঁড়া শুরু করল। ঘন্টা দুই পরে আবারও বিপত্তি। গুনে গুনে দেখলাম এগারোটা মাথার খুলি থরেথরে সাজানো। ওরা তো ভয় পেয়েইছিল। আমিও বাদ ছিলাম না।
ওই বারোটা খুলির সৎকার করে আবারও পরদিন ফিরে পূজা করা হলো। এমন কি দুটো পাঁঠাবলিও হলো।
সবাই পাঁঠার ঝোল আর ভাত খেয়ে তার পরদিন আবার কাজ শুরু হলো। না আর খুলি পাওয়া যায়নি। কিন্তু কার খুলি, কেন খুলি এর জবাব পাওয়া যায় নি। পলাশে রঙ ধরতে গিয়েও ধরল না। পলাশ গাছে কচি পাতা গজালো।
[ চতুর্থ পর্ব ]
ভোলা চারকে নিয়ে অনেক কিংবদন্তি আছে। ভোলা প্রখর বুদ্ধিমান, তার চেহারা কেমন তা কেউ জানতো না। কেউ জানলেও বলত না। এমনকি পুলিশ ফাঁড়িতেও কোন ছবি ছিল না। তার জন্য পুলিশ বহু চেষ্টা করেও ওকে ধরতে পারেনি। শোনা যায় ভোলা একবার নিজের চেহারার বিবরণ ও তার অপকর্মের কাহিনী  শোনাতে তদানীন্তন ডি সি (ডেপুটি কমিশনার)  ও পদস্থ পুলিশ অফিসারের সঙ্গে বৈঠক করেছিল। বৈঠক শেষে পেপার ওয়েটের তলায় একটা চিরকুট ছেড়ে  এসেছিল।  চিরকুটে নাকি লেখা ছিল " All of you are fools. I was at here."
দুঃসাহস দেখাতে গিয়েই প্রথম ভুলটা করে ফেলেছিল ভোলা। পলাশের বৃতির চেহারা আর গড়ন দেখে ফেললো পুলিশ মহল। তাও কিনা আঠারো বছর বাদে। পাশাপাশি গ্রাম যশপুর,ভেটি,মুরাড্ডি,রামচন্দ্রপুর মানপুর সব যায়গাতে চলতে লাগলো তল্লাশী। কিন্তু কোথায় ভোলা। গ্রামের লোকের মুখে কুলুপ। তাই সোর্স হিসেবে পুলিশ ইয়াসিনকে ঠিক করল,যে কিনা আসানসোলের বড় দুস্কৃতীকারী। সেও সুবিধা ও সুযোগ  পেয়ে ভোলার সাম্রাজ্যে পা রাখলো।  এহেন সময়ে ভোলার মা মারা গেলেন। বালিগাড়া গ্রামে রব শোনা গেল ভোলা মায়ের পারলৌকিক কাজ করতে গ্রামে আসবে। পুলিশের সোর্স পুলিশকে কনফার্ম করলো। বালিগাড়া গ্রামের বাড়িতে একদিকে মাইকে মন্ত্রোচ্চারণ হচ্ছে,অন্যদিকে গোটা বাড়ী ঘিরে রেখেছে অজস্র পুলিশ। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। মন্ত্রোচ্চারণ  শেষে দুপুর দেড়টায় ঘরের ভেতর পুলিশ  ঢুকে দেখে ভোলা নেই। চিরুনি তল্লাশি করে পুলিশ কিচ্ছু পায়নি। নারী ছদ্মবেশে ভোলা ততক্ষনে পগারপার। তিনদিন বাড়ি ঘেরাও করেও পুলিশ তার টিকি দেখতে না পেয়ে অধোমুখে ব্যারাকে ফিরে গেল। ঠিক পাঁচ দিনের মাথায় এক রাখাল ছেলে গৌরাঙ্গী পাহাড় থেকে নেমে এসে বলল
---- পাহাড়ের উপরে একটা মানুষের মাথা দেখলাম। মুখে দাড়ি আছে।
পরে জানা গেলো ওটা ইয়াসিনের কাটা মুন্ডু। পুলিশ  মরিয়া হয়ে উঠলো ভোলাকে ধরার জন্য।
বীরু অর্থাৎ ভোলার ভাই, ভোলার বিপরীত চরিত্রের। বীরু অত্যাচারী, চুরি, ডাকাতি,ধর্ষনে সিদ্ধহস্ত। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে থাকতো দিনের বেশির ভাগ সময়। প্রতিরাত্রে নিত্য নুতন শয্যাসঙ্গিনী নিয়ে মেতে উঠত। কোন মেয়ে অবাধ্য হলেই চরম শাস্তি দিতো। এই একটা বিষয়ে গ্রামের মানুষ বীরুর উপর তিতিবিরক্ত হয়ে পড়েছিল।  কিন্তু যেহেতু ওর দাদার নাম ভোলা, তাই কেউ প্রতিবাদ করার সাহস করেনি। এর জন্য গ্রামের লোকেদের গোপন ক্ষোভটা গিয়ে পড়ে ভোলা চারের উপর। দুগাই ভোলাকে বলে,
---- দেখ খুড়া বীরু ভাইপোর উপর গাঁয়ের লোক বহুত বিরক্ত। উ যে অন্যায় কামগুলা ক'রছে সেটা তো ঠিক লহে। তুঁই তো বলিনছিলি বিটি ছা মা বহিনের মতন। উয়াদের গায়ে কেউ হাত দিলে হাতট কাটিন লিব। লোক ভা'বছে তোর পশ্রয়ে উয়ার এত বাড়বাড়ন্ত। উ যা খুশি ক'রত্যে পারে,আর তোর জন্যে কেউ কিছু ব'লতে পারছ্যে নাই। শেষমেশ
  তরেই উপর লোকের রাগ হবেক।
----হম
---- উয়াকে একটুয়েক বকিন দে ন। অন্তত
  বিটিছায়ের উপর অত্যাচারট কমাক ন ভালা।
---- উ শুধরিবেক নাই কাকা।
ভোলা প্রতিদিন সকালবেলা স্নান সেরে কালীপুজো করতো তারপর মুখে কিছু দিত। যেখানেই থাকুক না কেন কালীর ফটো পুজা বন্ধ হয়নি। এমনি একদিন মানপুর গ্রামে এক সাগরেদের বাড়ীতে  সকালবেলায় কালীপুজায় বসেছিল। এমন সময় পুলিশ ঘিরে ফেললো সারাবাড়িটা। পুজা অসমাপ্ত রেখে পাঁচিল ডিঙিয়ে পালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু বিধাতা অলক্ষে হয়তো হেসেছিলেন। ঝাঁকে ঝাঁকে  গুলি ছুটে এল তার শরীরে। প্রথম গুলিটা লাগলো পায়ে,তবু খোঁড়াতে খোঁড়াতে দৌড়ে ঢুকে গেলো বাঁশঝোপে। কিন্তু শেষরক্ষা হলনা। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল ভোলা।
ফাল্গুনের
  কৃষ্ণচুড়া সকালে একটা পলাশ টুপ করে খসে পড়ল।
[ পঞ্চম পর্ব ]
পূর্ণ উদ্দমে বাঁধ তৈরীর কাজ শুরু হল। ঠিকেদারের ক্যাম্প,শ্রমিকদের থাকার ধাওড়াতে ভরে গেল মাঠের একাংশ। তখনও জে সি পি মেশিনের চল হয়নি।সব কাজই ম্যানুয়ালি করতে হত। ট্রাক, ড্রাইভার, খালাসি, মুর্শিদাবাদের বহু শ্রমিক,ও স্থানীয় শ্রমিকে ছয়লাপ। মাঠ নদী লোকে লোকারণ্য। বাঙ্ময় হয়ে উঠলো নির্জন মাঠ, মৌন গৌরাঙ্গী আর আমার লজ্জাবতী কাজলী নদি। এ যেন কাজলীর বিয়ের উৎসব। ভেটির পাহাড় থেকে গৌরাঙ্গী পাহাড়ের দুরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার।এই এক কিলোমিটার দুরত্ব বাঁধ দিতে হবে। একপাশে তৈরী হবে স্পীলওয়ে।  দুই পাহাড়ের মধ্যিখানে বয়ে যাচ্ছে লজ্জাবতী কিশোরী কাজলী। কলকল, ছলাৎ ছলাৎ। চঞ্চলা কিশোরী একদিন যৌবনবতী হবে। বর্ষায় ঘুঁঙুরের টুপটাপ শব্দে নেচে উঠবে। খেয়ালী কাজলীকে তো ছেড়ে দিতে হবে মাঝে মধ্যে সাগর পিয়াসী স্রোতবতীকে। তাই স্পীলওয়েতে দরজা বসাতে হবে। তারজন্যই বিশাল কর্মকান্ড। রঙ ধরবে পলাশে। সবুজ হবে অহল্যাভূমি, শস্যবতী হবে আদিগন্ত মাঠ। মৌন মূক গৌরাঙ্গীর বুকে গড়ে উঠবে নিত্য নুতন রিসর্ট। মুছে যাবে কঙ্কালের ইতিহাস।
এই স্বপ্ন মেদুরতাই উৎসাহ যুগিয়ে যাচ্ছিল বিশাল কর্মকান্ডের প্রাথমিক নির্মান পর্বে।
বারোঘর তেরো উঠানের মত শ্রমিকদের ধাওড়া গুলো ভারী অদ্ভুত। অনেকটা তাঁবুর মত। কিন্তু ত্রিপল কাপড় দিয়ে নয়। তিনদিকে ছিটেবেড়ার দেওয়ালে খড় দিয়ে ঢাকা উপরে পাতলা খড়ের ছাওনি। সামনে ছোট্ট ছয় বাই আটের গোবর নিকানো উঠান। এক একটা পঁচিশ  জনের দলের জন্য নয়টি ধাওড়া। তার মধ্যে একটা রান্নাঘর।
স্থানীয় শ্রমিকদের কাজের নির্দিষ্ট সময় থাকলেও মুর্শিদাবাদের শ্রমিকের কোন বাঁধা ধরা সময় ছিল না। রাত হোক বা দিন যে কোন সময় তাদের কাজে লাগানো হত। তবে আট ঘন্টার বেশী নয়।
দেখতাম তারা অবসর সময়ে গম্ভীরা বা ভাওইয়া গাইত। ভারী সুন্দর লাগতো ঐ গান শুনতে। বেঁচে থাকার অন্যতম রসদ ছিল ঐ গান।
বেশ কিছুদিন কেটে গেল। খনন কার্য প্রায় শেষের দিকে। সিমেন্ট, ছড়, বালি পাথর সবকিছু মজুত হতে লাগল আস্তে আস্তে। মাঠে স্তুপাকৃত বালি আর চিপ্স,বোল্ডার ইত্যাদি। দিন কয়েক পরেই দ্বিতীয় পর্বের কাজ শুরু হবে।
এমনসময় একদিন সন্ধ্যের গোড়ায় গোড়ায় হঠাৎ দেখি সবাই ভূত ভূত চিৎকার করতে করতে দৌড়ে পালাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
 
---কি ব্যাপার ওরা দৌড়ে পালাচ্ছে কেন?
ঠিকাদারের ম্যানেজার সিংজী বলে উঠলেন
----এ শালারা ভূতের ডরে পালাছে।সব বকবাস। ভুত বলে কিছু আছে নাকি। শালারা ডরপুক আছে।
আমি বললাম ----চলুন সিংজী একবার দেখে আসা যাক।
সিংজী প্রথমে দোনামনা করতে লাগলেন,
----আপনে যান স্যার, সব ফালতু আছে।
 
সিংজীকে বললাম ---- আরে চলেন না। দেখেই আসা যাক না ব্যাপারটা কি?
একরকম জোর করেই সিংজীকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি বেশ কয়েকজন সাহসী গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর উৎসুক হয়ে কি যেন দেখছে। আমাদের দেখেই যায়গা ছাড়লো। আমিও আর পাঁচজনের মত দেখে অবাক হলাম একটা সিঁদুর লেপা বটপাতা ধীরে ধীরে চলছে। এটা দেখেই সিংজী ধুতি সামটে দে দৌড়
 
---- আই বাপ এতো বঢ়িয়া ভূত আছে রে বাবা।
 
সিংজীর দৌড়ানো দেখে হেসে ফেললাম। ভাবলাম ধুতি না খুলে যায়। তাহলে আবার ফ্যসাদ। কে একজন বলে উঠল,
---- স্যার আবার জোড়া পাঁঠা বলি দিয়ে বিশাই চন্ডীর পূজা দিতে হবেক। পরশু শ'নবার আমাবস্যা,ঐ দিনটতে পূজা দিলে ভূত পেরেত আর উপদ্রব
  নাই করবেক। সবাই দেখি ওর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলে উঠলো,
----হঁ হঁ তাই হোক। পূজাটা হলে করতেই হবেক।
আমি যে চমকাইনি তা নয়। তবু সাহসে ভরকরে আমার স্টিল ছাতার বাঁটটা আচমকা গেঁথে দিলাম ঐ সিঁদুর লেপা পাতাটায়।  কয়েক সেকেন্ড পরেই ছাতাটা মাটি থেকে উঠাতেই দেখি ছাতার সঙ্গে পাতাটাও উঠে এসেছে। অত্যন্ত কম আলো। তবু পর্যবেক্ষন করে দেখলাম, পাতার বোঁটা একটা কালো সুতায় বাঁধা। কালক্ষেপ না করে ছেঁড়া সুতোকে ধরে একটা কাঠিতে গোটাতে গোটাতে চললাম সুতার অভিমুখে। শেষ প্রান্তের ধাওড়ার মুখে আসতেই দেখি অন্যপ্রান্তে মনোহর মাহাতো সুতো গোটাচ্ছে। আমাকে দেখেই চমকে উঠলো মনোহর।
---- স্যার আপনি।
---- হ্যাঁ আমি।তোমার ভূতটা ধরে এনেছি। এই দেখ ছাতায় গেঁথে রেখেছি।
 
---- সা স্যা স্যার। হামার কন দষ নাই।ঐ শালারা হামকে হুচকাঁয়ছে। বললেক একটা ভুতের ব্যাবস্থা কর তাহিলে পাঁঠা মাংসের যগাড়টা হঁয়ে যাবেক। হা দেখুন এখন শালারা পাছুয়াছে, দৌগিন পালাছ্যে।
আমি ওকে ধমকাবো কি হেসে বাঁচিনা ওর অবস্থা দেখে। বেচারা যে এভাবে ধরা পড়ে যাবে ভাবেনি। আমি বললাম,
---- হ্যাঁরে বাপ হামকে বললেই পারথিস,হামি ঠিকাদারকে বলিন জড়া পাঁঠা কেনে যাচাই মাংসের ব্যাবস্থা করথি।
---- একবার বলিন দিহেন ন সার। মাংস বহুত দিনলে নাই খাওয়া হয়।
এই গরীব গুর্বো মানুষগুলোর উপর মায়া হলো। শোষিত মানুষগুলো কি সহজ সরল। মুখে বলতে না পেরে ছলনার আশ্রয় নিয়েছে। কয়েকটুকরো পাঁঠার মাংসের জন্য। অথচ আমরা? প্রতিদিন প্রায় মুরগী নয়ত খাসির মাংস দিয়ে ঠিকাদারের ক্যাম্পে মধ্যাহ্ন ভোজন সারছি।
নিজের উপরই ঘেন্না ধরতে শুরু করল।
প্রথম যেদিন ঢালাই বা সিমেন্টের কাজ শুরু হবে তার আগের দিন জম্পেশ ভোজ হলো। সব শ্রমিকের নেমতন্ন। পাতা পেড়ে আদিগন্ত মাঠে বসিয়ে দেওয়া হল ওদের। খিচুড়ি, একটা পাঁচমিশালি তরকারী, চাটনি  আর খাসি মাংস। কি আনন্দটাই না ওরা পেল। অন্তত একটা দিন তো ওরা পেট পুরে খেলো। অন্যান্য দিন দেখতাম স্থানীয় শ্রমিকরা নিয়ে আসতো জামবাটিতে করে পান্তাভাত, শাকপাতা, নুন আর কাঁচা লংকা। ওদের বাচ্চা ছেলে মেয়েদের ঐ একই খাবার। সদ্য মা হওয়া  মেয়ে শ্রমিকরা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাইয়ে পলাশ গাছের তলায় মাটির উপর কাঁথা পেতে শুইয়ে দিয়ে ঝুপি ঢাকা দিয়ে আসত। ঝুপি মানে বেতের উল্টানো শঙ্কুর মত। যা দিয়ে সাধারনত চেঙ,ল্যাঠা,মাগুর মাছ ধরা হয় তাকেই স্থানীয় ভাষায় বলে ঝুপি। অন্যদিকে মুর্শিদাবাদের শ্রমিকের বাঁধাধরা খাবার। প্রত্যেকের জন্য একবেলার বরাদ্দ পাঁচশ গ্রাম চালের ভাত, দেড়শো গ্রাম আলুসেদ্ধ,সপ্তাহে একদিন পঞ্চাশ গ্রাম কুচো মাছ, চারটে কাঁচা লংকা, সপ্তাহে  চার বান্ডিল বিড়ি ও একটা দিয়াশলাই। "সত্য সেলুলাস কি বিচিত্র এই দেশ।"

(শেষ অংশ পরের সংখ্যায় )