ছোট্ট মেয়েটা নাম তার 'দীপান্বিতা' । আমার নাতনীর
বয়সী হবে।আমাদের আবাসনেই থাকে আমার বাড়ির পাসে । তার ৫ম জন্মদিন ১লা জানুয়ারি তে।
আমাকে দু মাস আগেই বলে রেখেছে “দাদু , আমার জন্মদিন ১লা জানুয়ারিতে । তুমি কিন্তু আমাকে গিফট দেবে । আমি
মা বাবাকে বলে তোমার পছন্দর
খাবার আনাবো।”
আমি বলি নিশ্চয়ই মা। তুই
তো আমার আহ্লাদী ঠাকুমা । তোকে গিফট না দিলে কাকে দেব বল !
হুম মনে থাকে যেন ।
ঠিক আছে মনে থাকবে দেখিস। তবে আমি
যদি তার আগে মরে যাই ।
বালাই শাঠ ও কথা বলছ কেন । তুমি না থাকলে
আমায় গল্প কে শোনাবে? পাকা বুড়ির মত বলে।
তবে তোকে গল্প শোনাবার জন্য আমায়
বেঁচে থাকতে হবে !
তা কেন । তুমি শুনিও না কিন্তু তুমি থাক নাহলে আমিও
তোমার সঙ্গে চলে যাব আকাশে।
দূর বোকা মেয়ে । তবে ওই পক্ষী রাজ
ঘোড়া চড়ে তোর অস্ট্রেলিয়ান রাজকুমার যে মেলবোর্ন থেকে আসবে সে কাকে নিয়ে যাবে তার
সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া য়।
খুব রেগে যায় । তুমি খুব বাজে । ও
আমার বন্ধু । আমাকে না রাগালে
তোমার বুঝি ভাত হজম হয়না?
আমি হাঁসি । খুব মজা পাই ওকে
রাগাতে আবার ও নাহলেও চলে না । ওই ত আমার প্রকৃত বন্ধু।
অস্ট্রেলিয়ান রাজকুমার এর সিক্রেট হচ্ছে .... ওর ই
স্কুলের এক ছেলে তার জন্ম অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে । সে নাকি ওর বেষ্ট ফ্রেন্ড । তাই এই
রসিকতা। ওই বলেছিল সে কথা । ছেলেটি দেখতে ভারি সুন্দর কিন্তু ও আসলে
মহারাষ্ট্রিয়ান । নাম অমিত আকোল্কার ।
এই অমিতকে নিয়ে দীপান্বিতার যত
গল্প । ও কি টিফিন আনে , স্কুলে টিচার ওকে কি
বলে। কেমন ড্রইং করে ইত্যাদি।
আমি চুপ করে শুনি । মাঝে মাঝে ‘হুঁ’ বলি । তারপর বলি তোর
বেষ্ট ফ্রেণ্ড দের ডাক-বিনা ?
ডাকব তো । চকলেট দেব, গিফট দেব ।
আরও কত কি ।
আজকাল বাবা মায়েরা , ছেলে মেয়েদের জন্মদিন ইউরোপিয়ান স্টাইলে ওদের ধারায়
করে । আমাদের আমলে বাবা মা নতুন ড্রেস পরিয়ে মন্দিরে পূজো দিতেন । সেদিন একটা
বিশেষ দিন বলে গণ্য হত ।
বাড়িতে পায়েস নিশ্চই হত । সেটা মুখে দিয়েই মা বাবা আশীর্বাদ
করতেন । গড় হয়ে প্রণাম করে তাঁদের আশীর্বাদই সবচেয়ে বড় পাওয়া ছিল। সে রীতি প্রায়
নেই । এখন কেবল কেক কাটা আর গিফট নেওয়া পরে গিফট দেওয়া । বেলুন দিয়ে সাজানো, লাইটের ডেকোরেশন
ইত্যাদি।
......... দিপুরা (আমি ওকে এই নামি
ডাকি) বেশ কদিন হল
কোথায় গিয়েছে । আমি কোন খবর পাইনা ওদের। মনে মনে খুঁজি । আহা
মেয়েটার ওপর মায়া পড়ে গিয়েছে । ওর টক টক কথা , চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাচ আমার মন কেড়ে নিয়েছে। ওর মা বাবা কেও
দেখিনা কদিন। মনে মনে ভাবি হয়ত স্কুলের পড়াশুনোর চাপ। তারপর নাচের ক্লাস ,গানের ক্লাস , ড্রইং ক্লাস , ক্যারাটের ক্লাস ...... । সত্যি আজকাল মা বাবারা নিজেদের ছেলে
মেয়ের ওপর এতো প্রেশার দেয় যে তাদের নিজের মতন বাঁচার অধিকারটুকু যেন ছিনিয়ে নেয় ।
সব এক একটা রোবটে পরিণত হচ্ছে আর সেই রোবটের রিমোট টা আছে মায়ের হাতে । যেমন বোতাম
টিপবে ঠিক সেই রকম চলবে । খাও খাবে ... নাচো নাচবে ... গান কর গান করবে ...!!!!! এ
কি ?
আমার মনে আছে কিন্তু দিপুর কথা । ওর বার্থ ডে গিফটের
ফরমাস“টকিং বার্বি ডল” সেটা নিয়েই যাই ১লা জানুয়ারির দিন সন্ধ্যায় । কিন্তু একি ফ্ল্যাট
টা এত ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কেন ? কেউ কি নেই ! লোকজন ত
থাকার কথা । মিউজিক ,লাইট সব কোথায় ? তা ছাড়া কোন লোক জন নেই
। তবে কি ওর বার্থ ডে পার্টি
হবেনা ! কিন্তু কেন? এই ভেবে মনটা এক অজানা আশংকায় গুটি
গুটি পায়ে এগিয়ে ফ্ল্যাটের
কলিং বেল টিপলাম। দরজা খুলে দিলেন ওর বাবা । আমাকে দেখে কান্নায়
ভেঙ্গে পড়লেন । উনি বললেন ,
“দিপুর ব্রেন টিউমার ধরা পড়েছে । ওরা মুম্বাই গিয়েছিল ওকে দেখাতে
আশা ক্যানসার হসপিটাল এন্ড চিলড্রেন হসপিটাল এবং টাটা ক্যানসার হসপিটাল , মুম্বাইতে। কেমো দেওয়া হয়েছে। ওকে দেখলে চিনতে পারবেন
না।”
আমি আর দুঃখ রাখতে পারলামনা। ও যে
আমাকে বলেছিল “আমার সঙ্গে আকাশে চলে যাবে । তবে কি ও জানতো ওর রোগের কথা ! ওর
সেদিনের কথাগুলো আমার ভিডিও রেকর্ডিং এর মত চোখের সামনে ভেশে উঠলো ; বালাই শাট ও
কথা বলছ কেন । তুমি না থাকলে আমায়
গল্প কে শোনাবে? তবে তোকে গল্প শোনাবার জন্য আমায় বেঁচে থাকতে হবে !" আমার চোখ ভারাক্রান্ত
হল। আমি কেঁদে ফেললাম হাউ
হাউ করে । ভগবান কেন এই কচি শিশুদের এই ভয়ংকর রোগ দেন ! কেন ? আর কিছুই আমার
মাথায় এলোনা তখন কিছু না বলে দিপুর বাবার হাতে বার্বি টকিং ডলটা দিয়ে বলি এটা ওকে
দিয়ে দেবেন । এটাই ও চেয়েছিল। মানা করবেন না । ওই আমার প্রাণের বন্ধু । এই বলে
দ্রুত পায়ে ওখান থেকে ফিরে আসি আমার নিজের ফ্ল্যটে । সারাদিন আমি ঠাকুর ঘরে গিয়ে
ওর আরোগ্যের জন্য ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করি । আমি কি করতে পারি এ ছাড়া !