গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৬

ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী

টকিং বার্বি ডল
 
ছোট্ট মেয়েটা নাম তার  'দীপান্বিতা'  । আমার নাতনীর বয়সী হবে।আমাদের আবাসনেই থাকে আমার বাড়ির পাসে । তার ৫ম জন্মদিন ১লা জানুয়ারি তে। আমাকে দু মাস আগেই বলে রেখেছে দাদু , আমার জন্মদিন ১লা জানুয়ারিতে । তুমি কিন্তু আমাকে গিফট দেবে । আমি মা বাবাকে বলে  তোমার পছন্দর খাবার আনাবো।
আমি বলি  নিশ্চয়ই মা। তুই তো আমার আহ্লাদী ঠাকুমা । তোকে গিফট না দিলে কাকে দেব বল !
হুম মনে থাকে যেন ।
ঠিক আছে মনে থাকবে দেখিস। তবে আমি যদি তার আগে মরে যাই ।
বালাই শাঠ ও কথা বলছ কেন  । তুমি না থাকলে আমায় গল্প কে শোনাবে? পাকা বুড়ির মত বলে।
তবে তোকে গল্প শোনাবার জন্য আমায় বেঁচে থাকতে হবে !
 তা কেন । তুমি শুনিও না কিন্তু তুমি থাক নাহলে আমিও তোমার সঙ্গে চলে যাব আকাশে।
দূর বোকা মেয়ে । তবে ওই পক্ষী রাজ ঘোড়া চড়ে তোর অস্ট্রেলিয়ান রাজকুমার যে মেলবোর্ন থেকে আসবে সে কাকে নিয়ে যাবে তার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া য়।
খুব রেগে যায় । তুমি খুব বাজে । ও আমার বন্ধু ।  আমাকে না রাগালে তোমার বুঝি ভাত হজম হয়না?
আমি হাঁসি । খুব মজা পাই ওকে রাগাতে আবার ও নাহলেও চলে না । ওই ত আমার প্রকৃত বন্ধু। 
অস্ট্রেলিয়ান রাজকুমার এর সিক্রেট  হচ্ছে .... ওর ই স্কুলের এক ছেলে তার জন্ম অস্ট্রেলিয়ার  মেলবোর্নে । সে নাকি ওর বেষ্ট ফ্রেন্ড । তাই এই রসিকতা। ওই বলেছিল সে কথা । ছেলেটি দেখতে ভারি সুন্দর কিন্তু ও আসলে মহারাষ্ট্রিয়ান । নাম অমিত আকোল্কার । 
এই অমিতকে নিয়ে দীপান্বিতার যত গল্প । ও কি টিফিন আনে , স্কুলে টিচার ওকে কি বলে। কেমন ড্রইং করে ইত্যাদি।
আমি চুপ করে শুনি । মাঝে মাঝে হুঁ  বলি । তারপর বলি তোর বেষ্ট ফ্রেণ্ড দের ডাক-বিনা ?
ডাকব তো । চকলেট দেব, গিফট দেব । আরও কত কি ।
আজকাল বাবা মায়েরা , ছেলে মেয়েদের জন্মদিন ইউরোপিয়ান স্টাইলে ওদের ধারায় করে । আমাদের আমলে বাবা মা নতুন ড্রেস পরিয়ে মন্দিরে পূজো দিতেন । সেদিন একটা বিশেষ দিন বলে গণ্য হত ।  বাড়িতে পায়েস নিশ্চই হত । সেটা মুখে দিয়েই মা বাবা আশীর্বাদ করতেন । গড় হয়ে প্রণাম করে তাঁদের আশীর্বাদই সবচেয়ে বড় পাওয়া ছিল।  সে রীতি প্রায় নেই । এখন কেবল কেক কাটা আর গিফট নেওয়া পরে গিফট দেওয়া । বেলুন দিয়ে সাজানো, লাইটের ডেকোরেশন ইত্যাদি।
......... দিপুরা (আমি ওকে এই নামি ডাকি) বেশ কদিন হল  কোথায় গিয়েছে । আমি কোন খবর পাইনা ওদের। মনে মনে খুঁজি । আহা মেয়েটার ওপর মায়া পড়ে গিয়েছে । ওর টক টক কথা , চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাচ আমার মন কেড়ে নিয়েছে।  ওর মা বাবা কেও দেখিনা কদিন। মনে মনে ভাবি হয়ত স্কুলের পড়াশুনোর চাপ। তারপর নাচের  ক্লাস ,গানের ক্লাস , ড্রইং ক্লাস , ক্যারাটের ক্লাস ...... । সত্যি আজকাল মা বাবারা নিজেদের ছেলে মেয়ের ওপর এতো প্রেশার দেয় যে তাদের নিজের মতন বাঁচার অধিকারটুকু যেন ছিনিয়ে নেয় । সব এক একটা রোবটে পরিণত হচ্ছে আর সেই রোবটের রিমোট টা আছে মায়ের হাতে । যেমন বোতাম টিপবে ঠিক সেই রকম চলবে । খাও খাবে ... নাচো নাচবে ... গান কর গান করবে ...!!!!! এ কি ?   
 আমার মনে আছে কিন্তু দিপুর কথা । ওর বার্থ ডে গিফটের ফরমাসটকিং বার্বি ডল সেটা নিয়েই যাই ১লা জানুয়ারির দিন সন্ধ্যায় । কিন্তু একি ফ্ল্যাট টা এত ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কেন ? কেউ কি নেই ! লোকজন ত থাকার কথা । মিউজিক ,লাইট সব কোথায় ? তা ছাড়া কোন লোক জন নেই । তবে কি ওর বার্থ ডে পার্টি  হবেনা ! কিন্তু কেন?  এই ভেবে মনটা এক অজানা আশংকায় গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে ফ্ল্যাটের  কলিং বেল টিপলাম। দরজা খুলে দিলেন ওর বাবা । আমাকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন । উনি বললেন , “দিপুর ব্রেন টিউমার ধরা পড়েছে । ওরা মুম্বাই গিয়েছিল ওকে দেখাতে আশা ক্যানসার হসপিটাল এন্ড চিলড্রেন হসপিটাল এবং টাটা ক্যানসার হসপিটাল , মুম্বাইতে। কেমো দেওয়া হয়েছে। ওকে দেখলে চিনতে পারবেন না।
আমি আর দুঃখ রাখতে পারলামনা। ও যে আমাকে বলেছিল আমার সঙ্গে আকাশে চলে যাবে ।  তবে কি ও জানতো ওর রোগের কথা ! ওর সেদিনের কথাগুলো আমার ভিডিও রেকর্ডিং এর মত চোখের সামনে ভেশে উঠলো ; বালাই শাট ও কথা বলছ কেন  । তুমি না থাকলে আমায় গল্প কে শোনাবে? তবে তোকে গল্প শোনাবার জন্য আমায় বেঁচে থাকতে হবে !"  আমার চোখ ভারাক্রান্ত হল। আমি কেঁদে ফেললাম হাউ হাউ করে । ভগবান কেন এই কচি শিশুদের এই ভয়ংকর রোগ দেন ! কেন আর কিছুই আমার মাথায় এলোনা তখন  কিছু না বলে দিপুর বাবার হাতে বার্বি টকিং ডলটা দিয়ে বলি এটা ওকে দিয়ে দেবেন । এটাই ও চেয়েছিল। মানা করবেন না । ওই আমার প্রাণের বন্ধু । এই বলে দ্রুত পায়ে ওখান থেকে ফিরে আসি আমার নিজের ফ্ল্যটে । সারাদিন আমি ঠাকুর ঘরে গিয়ে ওর আরোগ্যের জন্য ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করি । আমি কি করতে পারি এ ছাড়া !