মহুলঘুটুর জমিদার
মহুলঘুটুর জমিদার নিবারণ বাঁড়ুজ্জে
আরামকেদারায় বসে হুঁকোয় টান দিতে দিতে মাঝে মাঝেই জয় রাধে, জয় রাধে সশব্দে
উচ্চারণ করছিলেন। বাড়ীর সকলেই জানে বাঁড়ুজ্জে মশায় যখনই রাধানাম জপ করেন তখনই তিনি
মনে মনে বদ মতলব আঁটেন। কার কাছে কত সুদ পাবেন,কার জমিটা
দখল নিতে হবে, কার দলিল বাজেয়াপ্ত করতে হবে ইত্যকার
চিন্তা করতেন। তাছাড়া রাধা নাম তাঁর এতই প্রিয় যে তাঁর ব্যাক্তিগত জীবনে রাধার
অভাব নেই। উপপত্নীর সংখ্যা নেই নেই করে প্রায় নয়। তারা বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন
থাকে খিদমত খাটা এবং দৈহিক তৃপ্তি দেওয়ার জন্য।
এহেন নিবারণ বাঁড়ুজ্জ্যের ঈশ্বর
ভক্তি চোখে পড়ার মত। সুর্য ওঠার আগেই শয্যাত্যাগ করে প্রথমেই রাধাকৃষ্ণ জপ। আর
তারপরেই বাগাল মুনিষের উপর একপ্রস্থ চোটপাট করেন অশ্রাব্য গালিগালাজ দিয়ে। তাদের
উঠিয়ে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে পুকুরে স্নানে যান।সেখান থেকে ফিরে তিলক ফোঁটা কেটে
রাধাগোবিন্দ মন্দিরে বসে যান পুজো করতে। তারপর জলযোগ করে আপন গদিতে বসেন হিসেব
নিকেশ করতে। এটা তাঁর নিত্যনৈমিত্তিক রুটিন বলা যেতে পারে।
সেদিন ভাদ্র সংক্রান্তি। মহুলঘুটু
জমিদারিতে বিশ্বকর্মা পুজোর খুব একটা চল নেই। তবে ছাতাপরবের ধুম পড়ে যায়। ছাতাপরব
একটা স্থানীয় লোক উৎসব। ছাতাটাঁড় এর বিশাল মাঠে মেলা বসে। খোলা আকাশের নিচে ঘুগনী
তেলেভাজা পাঁপড়, চায়ের সারি সারি দোকান বসে। মনিহারি, শাড়ী
গামছা,সস্তার ব্লাউজ শায়ার দোকান, বাচ্চাছেলের জন্য সস্তা খেলনার দোকানে ছয়লাপ। যেহেতু ভাদ্র মাসটা
একটু গোলমেলে মাস,এতদঞ্চলে মানুষের হাতে টাকা পয়সা থাকে
না বললেই চলে। তাই অধিকাংশ গরীব গুর্বো লোক তেলেভাজার গন্ধ শুঁকেই খাওয়ার আস্বাদ
নেয়, সস্তা রং করা মারকিনের বেলাজু ব্লাউজ, খড়িমাটির পাডার(পাওডার) আফগান সোনো (স্নো) কেনে বৌ এর জন্য। আর বাচ্চার
বায়না মেটাতে রঙীন লেবেঞ্চুস। মেলা জমে বিকেলের দিকে। ইন্দ্রের ছাতা উত্তোলন করেন
মহুলঘুটুর
জমিদার নিবারণ বাঁড়ুজ্জে।
নিবারণ বাঁড়ুজ্জ্যে যথারীতি রুটিন
মাফিক গদিতে বসে হিসেব নিকেশে ব্যাস্ত।এমন সময় তাঁর একুশ বর্ষীয়া নয় নং উপপত্নী
সটান এসেই বুধু ধোপার বিরুদ্ধে নালিশ জানালো,
-----ঠাকুর দাদা বুধুয়া আজ কুইলি গাভীন গাইটাকে
এমন পইনাঁইনছে যে গাইটা গাভড়াঁয় যাঁয়েছে। বহুত কষ্টে ধেনুয়াইল বঠে কিন্তু মরা ফেটা'ন। ইয়ার একটা বিহিত করতে হবেক।
এই খবরটা দিয়েই ফুলকি স্থানত্যাগ
করল। আসল ব্যাপারটা হলো গর্ভিনী গাইটা আগেরদিনই পাহাড়ী পাথরে পা হড়কে পড়ে গিয়েছিল।
গোয়ালে ফিরে সারারাত কষ্ট পেয়েছে। কেউ বুঝতে পারেনি। ভোর বেলায় একটা মৃত ফেটান
অর্থে বকনা বাছুরের জন্ম দিয়েছে। খুব জোর বেঁচে গেছে কুইলি অর্থে কালো গাইটা। বুধু
কিচ্ছু করেনি। বরং সকালে গোয়াল খুলে সেই প্রথম দেখে ব্যাপারটা। তাছাড়া যার গাই গরু
রাখালী করে পেট চলে সে গর্ভিনী গাইকে পঁইনাবে অর্থাৎ লাঠির বাড়ী মারবেই বা কেন?তারপর কুইলিকে
বাদ দিয়ে বাকী গরুগুলো নিয়ে গেছে মাঠে। আজকে ছাতা পরবের জন্য একবেলা কাজ। তাই জলদি
ফিরবে বুধু।
কিন্তু ফুলকি মিথ্যে নালিশ করলো
কেন নিবারণ বাঁড়ুজ্জ্যের কাছে? আসল ব্যাপারটা অন্যত্র। ফুলকি সুদেহী সমর্থ
জোয়ান বুধুকে দেখেই একতরফা প্রেমে পড়েছিল। আশনাই করার শত প্রলোভনের ফাঁদে পা দেয়নি
বুধু। বাড়ীতে কচি বৌ। তার সঙ্গে বেইমানি করা হবে যে। বৌকে সে বড্ড ভালবাসে।
ছাতাপরবে বৌকে ফুলাং তেল আর সোনার জল দেওয়া কানের ঝুমকো, কাঁচের
চুড়ি এনে দেবে বলেছে। এহেন বুধু ধোপা ফুলকির পাতা ফাঁদে পা দেয় নি। আবার ফুলকির
হয়েছে জ্বালা। একদিকে রাতে বুড়ো জমিদারের সঙ্গে শোয়া।ঘেন্নায় গা পিত্তি জ্বলে যায়।
যৌন অতৃপ্তি। বুড়োর নানান বায়নাক্কা। কিন্তু উপায়হারা। একদিকে ভরাযৌবনের খিদে,
অন্যদিকে পেটের খিদে। একদিকে বাবার ক্ষয়রোগ অন্যদিকে মা নুনিনালা
যৌনরোগাক্রান্ত,তায় ভাঙা কোমর। অগত্যা ফুল্কি বাধ্য হয়েছে
নিবারণ বাঁড়ুজ্জ্যের অঙ্কশায়িনী হতে। তবু ভেবেছিল বুধু হয়তো ওর ডাকে সাড়া দেবে।
সাড়া পায়নি। বরং বুধুর বৌপ্রীতি দেখে হিংসেতে জ্বলে পুড়ে মরে। তাই এই প্রতিশোধ
স্পৃহা। কিভাবে জমিদারের কান ভাংচি দিয়ে ওকে তাড়ানো যায়।
ফুলকির নালিশ শুনে খেরোর খাতা ফেলে
তিড়িং করে লাফিয়ে উঠলেন বাঁড়ুজ্জ্যে মশায়।
---- শালা হারামি বুধুয়া। হামারা গাভীন গাইকো
পিটা? বোলাও শালেকো। আরে এ রাখুয়া যা, ওনকো ঢুঁন্ডকে ইঁহা লাও। ওনকো পিঠের চামড়া লে কে মেরা জুতা বানায়েগা।
অভি বোলাও ও হারামিকো।
রেগে গেলে বাঁড়ুজ্জ্যে মশায়
কাঁচাপাকা হিন্দি বলেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাখু চালক কাঁপতে শুরু করেছে । ও জানে এ
রাগের কি পরিনাম,তবু বুধুর খোঁজে বেরুল রাখু। কিছুক্ষনের মধ্যেই বুধু এল জমিদার সমীপে। আসতেই
জমিদারের অশ্রাব্য গালিগালাজ। রাখুকে বললেন বাইরে যেতে। রাখু বেরিয়ে যেতেই সদর
দরজায় হুড়কো দিয়ে দিলেন। বাঁড়ুজ্জে মশায়ের হাতে বাঁশের লাঠি। যাকে এতদঞ্চলে পইনা
বলে।–
---শালা হারামির বাচ্চা--- গাভীন গাইকো তুম পিটা---উ
গাভড়া গিয়া শালা, ফেটানি বাছুর থা। শালা তুমহারা জী তোড়
দেগারে বেটা।--মারো শালেকো।
----হামি কিছু করি নাই ঠাকুর।হামি কোনদিন গাই
গরুকে পইনা দিঁয়ে মারি নাই ঠাকুর। কালীর কিরা ঠাকুর। আপনার পা ছুঁয়ে বলছি। আর
মারিয়েন না ঠাকুর।
কে কার কথা শুনে। বাঁড়ুজ্জে মশায়
নেচে নেচে মাথায় ঘাড়ে পিঠে পাছায় দুই হাঁটুতে মেরেই চলেছেন। বুধু চিৎকার করতে শুরু
করলো। চিৎকার শুনে বাঁড়ুজ্জে মশায়ের তৃতীয় পুরুষ,অর্থাৎ নাতি দেওয়াল টপকে হাজির।
দাদুর গেঞ্জি ধরে টেনে একপাশে সরিয়ে দিয়ে বলল
--- এ কি করছো দাদু। তোমাকে আগেও বলেছি এটা মধ্যযুগ
নয়। বর্বরতার যুগ নয়। কেউ কারো ক্রীতদাস নয়। ওর হাতে যদি আমি লাঠি ধরিয়ে দি আর ও
যদি তোমায় পাল্টা পিটোতে শুরু করে তাহলে তোমার মান সম্মান থাকবে?
ওদিকে তখন বুধু নেতিয়ে পড়েছে,গোটা গায়ে
রক্তের দাগ। ধুতি গেঞ্জি ভিজে গেছে রক্তে। কোন মতে ধরে ওঠালো ওই নাতি অমল।
হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়ে ওর বাড়ীতে পৌছে দিয়ে এলো। তখনো নাটক বাকী।
দুপুর বেলা খাওয়া দাওয়া সেরে বাঁড়ুজ্জে
মশায় খাটিয়ায় শুয়ে আরাম করছিলেন। হঠাৎ মস্তিস্কের কোন রসায়ন কাজ করল জানা যায় নি
তবে হাঁক পাড়লেন,
----রাখুয়া আ আ আ আ আ
হাঁক শুনতেই রাখু হাজির। বাঁড়ুজ্জে
মশায় বললেন,
----এই লে তিরিশ টাকা। ভিখুর কাপড়ের দোকান থেকে একটা
সরুপাড় ধুতি আর একটা চৌত্রিশ সাইজের ভালবাসা হাতওলা গেঞ্জি নিয়ে আয়। অভি।
রাখু ধুতি গেঞ্জি নিয়ে এলো। ওনি
এবার বুধুয়া আর বুধুর ঠাকুমা ধুঁন্দি বহুকে ডেকে পাঠালেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই
অশীতিপর ধুন্দি বহু বুধুকে সঙ্গে করে এলো। নাটকের পরবর্তী দৃশ্য দেখার জন্য নাতি
অমলও হাজির হলো।।
ধুঁন্দি সাষ্টাঙ্গ হয়ে বাঁড়ুজ্জে
মশায়ের পায়ে মাথা ঠুকে বলল,
----ঠাকুর বাবা আপনি মাই বাপ। ও ভুল করিনছে বাপ,
মাফ করিন দিহ বাপ।
---- না না ঠিক আছে এই নে আজ ছাতা পরব। পরব দিনে উয়াকে একটা লৈতন ধুতি আর গঞ্জি দিছি। না দিলে উয়ার মনটা খারাপ হবেক।
---- না না ঠিক আছে এই নে আজ ছাতা পরব। পরব দিনে উয়াকে একটা লৈতন ধুতি আর গঞ্জি দিছি। না দিলে উয়ার মনটা খারাপ হবেক।
ধুন্দি নাতি বুধুকে বলল
---- দেখ বুধুয়া ঠাকুরবাবা লিতই ভগমান আছে। উনার
দয়ার শরীল। পন্নাম কর,পন্নাম কর। দেখ ভাই ভুলচুক হল্যে তো
ঠাকুর বাবা টুয়েক আধেক রাগতেই পারেন।ওনারা তুলসী পাতের জাত। ছটোজাইতকে ছটোই থাইকতে
হয় রে বকা।
অমল এতক্ষন দাঁত কিড়মিড় করছিল বলেই
ফেলল
---- সব ঠিক আছে,কিন্তু
কুকুরের মত মুততে পারলে কই ? তুলসীর মুখে তো মুততে পারতে।
বুধু বা ধুঁন্দি কেউই কথার অর্থ
বুঝল কিনা কে জানে। বরং ধুতি গেঞ্জির সঙ্গে নগদ তিনটে টাকা পেয়ে ধুঁন্দি ও বুধু
দ্বিতীয়বার প্রনাম করে মহানন্দে বাড়ী ফিরে গেলো।
মহুলঘুটুর জমিদার এবার প্রস্তুতি
শুরু করলেন ছাতাটাঁড় যাওয়ার জন্য। কেননা তিনিই তো ইন্দ্র দেবের ছত্র ওঠাবেন।
পাল্কি চড়ে নিবারণ বাঁড়ুজ্জ্যে ছাঁতাটাঁড়ের উদ্দ্যেশে রওয়ানা দিলেন।
অমল ফ্যালফ্যাল করে শুন্য দৃষ্টিতে
চেয়ে থাকলো উদাস রাস্তার দিকে।