ছোটবেলা থেকে গ্রামেই মানুষ বলা যায়।
আজ যে অঞ্চলে বসবাস করি, জীবনের প্রায়
পঞ্চাশটা বছর সেখানেই বসবাস করলেও, মিলি, সেন্টি, ডেকা, হেক্টোর মতো সেটারও সৌন্দর্যের, উন্নতির, পরিচিতির, ওজন বেড়ে বেড়ে ক্রমে পুরো গ্রাম থেকে, আধা গ্রাম, আধা শহর, পুরো শহরের, মর্যাদা ছাড়িয়ে এখন মেগা সিটির সম্মানে ভুষিত এক শহরের আকার
ধারণ করেছে। কিন্তু দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়ার মতো সেভাবে গ্রামের সৌন্দর্য কোন
দিনই লক্ষ্য করা হয় নি। আলোর পাশে অন্ধকার না থাকলে, প্রকৃত অন্ধকারের রূপ চেনাও যায় না। তাই
কোন গ্রামের সৌন্দর্য, নির্মল বিশুদ্ধ হাওয়া, সততা, টাটকা সবজী, পুকুরের মাছ, বাড়ির গরুর দুধ, কাঞ্চন, স্বর্ণ চাপা, বকুল, মালতী লতা, প্রজাপতির কথা শুনলে আজ আফসোস হয়, কেন সেদিন চোখ বুজে থাকলাম, কেন সেদিন বুক ভরে নিশ্বাস নিলাম না। তাই আজও সময়, সুযোগ পেলেই ছুটে যাই কাছেপিঠের কোন গ্রামে। মন
খারাপ হয়ে যায়, যখন দেখি
সেইসব গ্রামেও আধুনিকতার ছোঁয়া
লেগে গ্রাম্য সৌন্দর্য হারিয়েছে।
ঠিক যেমন কোন সুন্দরী নারী আধুনিক বিউটি পার্লারের সৌজন্যে নিজের স্বাভাবিক
সৌন্দর্য হারিয়ে কৃত্রিম চাকচিক্যের অধিকারী হয়।
তখন
আমি নতুন চাকরী পেয়ে কলকাতার ডালহৌসি অঞ্চলে একটা আকাশচুম্বি বাড়িতে কর্মরত। একদিন
গ্রাম নিয়ে আলোচনার সময়, আমার তিন
সহকর্মী স্বপন, বলাই ও মনোজ, হঠাৎ কোন একটা প্রত্যন্ত গ্রাম, তাদের ভাষায় ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুর, দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলো। আমি কাছেপিঠেই আমার
দেখা একটা গ্রামের কথা উল্লেখ করতেই ওরা রাজী হয়ে গেল। এই জায়গাটা আমার বাড়ি থেকে বেশ
কয়েকটা রেলওয়ে স্টেশন পরে অবস্থিত। এর আগেও আমরা কয়েকজন ঐ স্টেশনে গিয়ে মাঠের আল
ধরে, সাঁকো পেরিয়ে পায়ে হেঁটে অনেক ঘুরেছি। পরদিন
শনিবার অফিস ছুটির পরে আমার পছন্দ করা গ্রাম দেখতে যাওয়া পাকা হয়ে গেল।
শনিবার
অফিস ছুটির পরে, আমরা চারজন
আমাদের বাড়িতে এসে চা জলখাবার খেয়ে, রোদের তেজ একটু কমলে, ট্রেনে চেপে
নির্দিষ্ট স্টেশনে এসে হাজির হলাম। আজ কিন্তু ওদের নিয়ে অন্য দিকে এগলাম। এই এলাকা
আমার পরিচিত নয়। আল ধরে, পায়ে চলার
মাটির রাস্তা দিয়ে সোজা এগিয়ে যাওয়া, আবার
আন্দাজে আন্দাজে, প্রয়োজনে
স্থানীয় লোককে জিজ্ঞাসা করে করে, স্টেশনে ফিরে আসা। রেল লাইনের ওপর দিয়ে বেশ খানিকটা পথ
হেঁটে, একটা সরু বাঁশের সাঁকোর কাছে এসে হাজির হলাম।
ইংরাজী এক্স (X) অক্ষরের
মতো কিছু দুরে দুরে তিনটে বাঁশের খুঁটির ওপর দুটো বাঁশ, রেল লাইনের পাশের সরু ঝিলের এপার
থেকে ওপার পর্যন্ত ফেলা। খুঁটির একটু ওপর দিকে রিকেট রোগগ্রস্থ একটা খুব সরু বাঁশ
এপার থেকে ওপার পর্যন্ত বাঁধা, সম্ভবত
পথচারীদের ঐ বাঁশ ধরে নিরাপদে পারাপার হওয়ার সুবিধার্থে।
স্বপন
যখন সাঁকোর মাঝামাঝি, তখন ওপার
থেকে স্থানীয় একজন, ট্রেন ধরার তাড়ায় কী সুন্দর ঐ সরু বাঁশের ওপর
দিয়ে ওকে পাশ কাটিয়ে এপারে চলে এল। বলাই যখন বহু প্রস্তুতি নিয়ে পার হওয়ার জন্য
সাঁকোর ওপর কয়েক পা মাত্র এগিয়েছে, ঠিক তখনই
ওপারে এক বৃদ্ধা গরু নিয়ে সাঁকোর কাছে এসে উপস্থিত। গরুর গলার দড়ি তাঁর হাতে
জড়ানো। মনোজ ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলো, “এই মরেছে, এ আবার গরু নিয়ে আগের লোকটার মতো সাঁকো পার হবে নাকি? এই বলাই সাবধান, গরু সাঁকো পার হবে”। বলাই ভয় পেয়ে প্রায় মিনতি করে বলে উঠলো, “ও মাসী একটু দাঁড়াও, আমি আগে পার হয়ে নি তারপরে তুমি তোমার গরুকে সাঁকো পার করাও”। ব্যাস্, বলাইয়ের
আদরেরে মাসী রেগে গিয়ে চিৎকার শুরু করে দিল— “তোমরা কিরকম নেকাপড়া জানা মানুষ বাপু? গরু কখনও তোমাদের মতো সাঁকো পার হতে পারে”? আমাদের সঙ্গে গরুর একমাত্র
পার্থক্যটি অবগত হয়ে, আমরা একে একে সাঁকোর ওপারে গিয়ে হাজির হলাম।
একটু
এগিয়েই আমার দুই সঙ্গীর ভীষণ জল পিপাসা পেল। তারা আমায় একটু ঠান্ডা
জলের ব্যবস্থা করতে বললো। তাদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, তারা যেন আমার জমিদারিতে অতিথি
হিসাবে এসে উপস্থিত হয়েছে, এবং আমার
দায়িত্ব
এই অতিথি নারায়ণদের সেবা করা। সামানেই একটা পাকা বাড়ি দেখে দরজায় টোকা দিলাম। এক
ভদ্রমহিলা দরজা খুলতে আমরা খাবার জল চাইলাম। ভদ্রমহিলা ভিতর থেকে এক ঘটি জল ও একটা
গ্লাশ নিয়ে এসে আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন আমরা কোথা থেকে আসছি এবং কার বাড়ি যাব। আমরা
জল খেয়ে ঠান্ডা হয়ে জানালাম, আমরা এখানে
কারো বাড়িতে আসি নি, আমরা গ্রাম দেখতে এসেছি।
বেশ
খানিকটা পথ এঁকেবেঁকে ছোট ছোট বাড়ির পাশ দিয়ে গিয়ে, আমরা একটা খালের ধারে এসে পৌঁছলাম। খালের ওপর সমান্তরাল
ভাবে দুটো রেল লাইনের মতো মোটা লোহার রড পাতা, তার ওপর রেল লাইনের কাঠের স্লীপার পাতা। পাকাপোক্ত ব্রীজ
হলে কী হবে, ব্রীজের বেশ কয়েকটা স্লীপার কিন্তু
চোখে পড়লো না। ব্রীজটার ঠিক আগে, ডানদিকে খালটার একবারে
পাশে একটা ছোট্ট মাঠের মতো জমি। তিন-চারটে বাচ্চা ছেলে
সেখানে খেলা করছে। আমরা মাঠটার একপাশে গিয়ে বসলাম। আমাদের একজন সঙ্গীর বোধহয়
গ্রাম্য পরিবেশ ও সুন্দর আবহাওয়ায়, হঠাৎ মুড়ি খাওয়ার ইচ্ছা জেগে উঠলো। কাছেপিঠে কোথাও কোন দোকানও
চোখে পড়ে নি। অগত্যা বাচ্চাগুলোকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, সামনেই একটা দোকানে মুড়ি, চানাচুর পাওয়া যায়। পাশে তেলেভাজার দোকানও
আছে। এ তো মেঘ না চাইতেই জল। বাচ্চাগুলোকে
একটু বলতেই, ওরা এনে দিতে
রাজী হ’ল।
আমরাও মুড়ি, চানাচুর, বাদাম ভাজা ও
চপের জন্য পয়সা দিয়ে, এবং তাদের লজেন্স ও বিস্কুট কিনে খাওয়ার পয়সা দিয়ে, শুকনো মাঠের
মাঝখানে উঠে গিয়ে বসে, গুলতানি শুরু করলাম।
বিকেল
শেষ হয়ে সন্ধ্যা নামবে নামবে করছে, বাচ্চাগুলোর
পাত্তা নেই। এমন সময় একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক একহাতে একটা জ্বলন্ত হারিকেন, অপর হাতে মাছ ধরার নাইলন জাল নিয়ে এসে হাজির হলেন। এখনও হারিকেন
জ্বালার মতো অন্ধকার নামেনি। ভদ্রলোক ব্রীজের এপারে হারিকেনটা রেখে, জাল হাতে ব্রীজ পেরিয়ে খালের জলের কাছে নামলেন মাছ ধরতে। খালের এপারে
আমরা, ঠিক ওপারেই ভদ্রলোক জল ও স্থলের সংযোগ
স্থলে দাঁড়িয়ে খ্যাপলা জাল ছুড়ে মাছ ধরছেন। আমরা একবার জিজ্ঞাসা করলাম— “দাদা কী মাছ পেলেন”? উত্তরে তিনি শুধু বললেন, “মাছ কোথায়? সামান্য কিছু চিংড়ি পড়েছে”। আমরা আবার নিজেরা গল্পে ব্যস্ত হয়ে
পড়লাম।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ মনে হ’ল ভদ্রলোক কিছু বলছেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে মনে হল তিনি ঝুঁকে
পড়ে নিজের মনে কিছু বলতে বলতে, তাঁর পা থেকে জালটা খোলার চেষ্টা
করছেন। হয়তো কোনভাবে তাঁর পায়ে জালটা জড়িয়ে গিয়ে থাকবে। আমরা আবার গল্পে মত্ত
হলাম। কিন্তু ভদ্রলোকের কথায় এত য্ন্ত্রণা ও আর্তনাদের সুর কেন? তাঁর দিকে তাকিয়ে
তাঁর কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, তিনি ঝুঁকে পড়ে তাঁর হাঁটুর নীচে জালের দড়িটা বাঁধবার
চেষ্টা করছেন ও তীব্র যন্ত্রণার সুরে একভাবে বলে যাচ্ছেন, “ও মা গো, জাত সাপে
কেটেছে গো। ও মা গো, জাত সাপে কেটেছে গো”। আমাদের আড্ডা দেওয়া মাথায় উঠলো, তাঁকে খালের
এপারে চলে আসতে বলে খালের ব্রীজটার কাছে এগিয়ে গেলাম।
ভদ্রলোক
জাল হাতে খোঁড়াতে খোঁড়াতে, কাতরাতে
কাতরাতে, এপারে
হারিকেনটার কাছে এসে বসে পড়লেন। যন্ত্রণা ও মৃত্যুভয়ে তিনি কাঁদতে
শুরু করেছেন। তাঁর পায়ে এখনও জালের দড়ি বাঁধা, পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের পাশে সাপে কাটার দাগ, এবং
ক্ষতস্থান থেকে খুব অল্প রক্ত বেরচ্ছে। শুনেছিলাম বিষাক্ত সাপে কামড়ালে ক্ষতস্থান
থেকে যে রক্তপাত হয়, তা নাকি ছানা
কাটা দুধের মতো হয়ে যায়। এই ভদ্রলোকের ক্ষতস্থান থেকে যে রক্তপাত হয়েছে, তা কিরকম ছানা কাটা মতো। হাঁটুর নীচে জালের নাইলন দড়িটা
বাঁধা। ওখানে দড়ি বাঁধলে রক্ত চলাচলের কোন অসুবিধা হয় না, তার ওপর ভদ্রলোক যেরকম ঘাবড়ে গিয়ে লাফঝাঁপ
করেছেন, তাতে
রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাও অনেক বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি ঊরুতে পরপর
তিনটে রুমাল শক্ত করে বেঁধে দিয়ে জালের দড়িটা খুলে দিলাম। কিন্তু তারপর? এবার কী করবো? বাচ্চাগুলোও তো এখনও ফিরে আসে নি, অথচ ভদ্রলোকের বাড়িতে তো একটা খবর দেওয়া প্রয়োজন। ভদ্রলোককে
তাঁর বাড়ি কোথায় জিজ্ঞাসা করলে ভয়ে না শারীরিক অসুস্থতায় জানিনা, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকছেন। এর মধ্যে একটু দুরে একজনকে দেখতে পেয়ে, চিৎকার করে তাকে ডেকে আনা হ’ল। আগুন্তুক সাপে কাটা ভদ্রলোকটিকে দেখে
চিনতে পারলেন। আমরা তাকে যত শীঘ্র সম্ভব এই ভদ্রলোকের বাড়িতে একটা খবর দিতে বললাম। লোকটি এতটুকু সময় নষ্ট না করে, ছুটে চলে গেলেন
অল্প
কিছুক্ষণের মধ্যেই সঙ্গে দু’জন লোক নিয়ে
ছুটতে ছুটতে যিনি এসে উপস্থিত হলেন, তাঁকে দেখে চিনতে পারলাম। হ্যাঁ, তিনি সেই
ভদ্রমহিলা, যিনি
আমাদের তৃষ্ণার জল দিয়ে পিপাসা মিটিয়ে ছিলেন। ভদ্রমহিলা এসে ভয়ে চিৎকার করে কাঁদতে
শুরু করলেন। তাঁর কথায় জানতে পারলাম, উনি এই
ভদ্রলোকের স্ত্রী। তাঁকে বললাম, ভদ্রলোককে যত শীঘ্র সম্ভব কোন হাসপাতালে নিয়ে যেতে, এবং হাসপাতালের ডাক্তারের নির্দেশ
ছাড়া কারো কথায় পায়ের বাঁধন না খুলতে। সময় নষ্ট না করে, তাঁর সঙ্গী দু’জন পাঁজাকোলা করে ভদ্রলোককে নিয়ে ছুটলেন। পিছন পিছন ভদ্রমহিলাও হারিকেন
ও জালটা হাতে নিয়ে দৌড় শুরু করলেন।
আমরা
ছোট মাঠটায় এসে বসতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, মাঠে অনেক গর্ত। সেগুলো গরু বাঁধার খুঁটির গর্ত, না সাপের গর্ত জানি না। আমরা গর্তের ওপর চটি পেতে বসে, আশপাশের গর্তের ওপর বাকী চটি চাপা দিয়ে
দিলাম। অন্ধকার নেমে আসছে। এখানে থাকাও বিপজ্জনক। তাছাড়া অনেকটা পথ হেঁটে স্টেশনে
যেতে হবে। কিন্তু বাচ্চাগুলোর জন্য চিন্তা হচ্ছে। ওরা এখনও ফেরে নি। ওরা না ফিরলে
আমরা যেতেও পারছি না।
হঠাৎ
একটা লোক এসে হাজির। তিনি এসেই বলতে শুরু করলেন—“সাপে কেটেছে তো? জাত সাপে কাটলে কেউ ওরকম চিৎকার করে? ও আর বাঁচবে
বলে মনে করো না। ওর কী আর এ জগতে শত্রু নেই? সে তো জানতে পারলেই বাণ মারবে। সেই বাণের বিষ
পিঁপড়েতে যদি খেয়ে নেয়, তাহলে ওঝার বাবারও ক্ষমতা নেই ওকে বাঁচায়”। লোকটা আরও কত কথা যে বলে গেলেন তার
ইয়ত্তা নেই। বুঝলাম ইনি একটি কুসংস্কারের জাহাজ। কুসংস্কারসাগর বললেও ভুল বলা হবে
না। ইতিমধ্যে বাচ্চাগুলো ঠোঙা হাতে ফিরে এসেছে। মুড়ি, তেলেভাজা খাবার ইচ্ছা আর নেই। বাচ্চাগুলোকে
ওগুলো খেয়ে নিতে বলে, লোকটাকে
বললাম, “আমরা এখানে নতুন, অন্ধকার নেমে এসেছে তাই আপনি যদি আমাদের একটু স্টেশনে পৌঁছে
দেন, তাহলে খুব ভাল হয়”। তিনি আমাদের স্টেশনে পৌঁছে দিতে রাজী হলেন।
আমরা
তার সাথে যেদিক থেকে এসেছি সেদিকে না গিয়ে, একবার উল্টো দিক দিয়ে হাঁটতে শুরু
করলাম। একবারে সরু পায়ে হাঁটার পথ, দুপাশে
ঝোপঝাড়। তাঁকে সামনে এগিয়ে দিয়ে, আমরা লাইন দিয়ে তার পিছন পিছন হাঁটছি। উদ্দেশ্য মহৎ, যা কিছু ঝড়ঝাপটা, তাঁর ওপর দিয়েই যাক। অতিরিক্ত সতর্কতা হিসাবে মার্চ-পাষ্ট করার মতো করে পা ঠুকে ঠুকে হাঁটছি। খুব অল্প সময়ের
মধ্যে স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। এবার কিন্তু সাঁকোও পার হতে হ’ল না, রেলের ঝিলও চোখে পড়লো না। আসলে আমরা
যাবার সময় স্টেশনে নেমে, অর্ধবৃত্তাকারে
চক্কর দিয়ে আবার স্টেশনে ফিরে এলাম।
স্টেশন
প্ল্যাটফর্মে ঢুকে দেখি ঐ ভদ্রমহিলা ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন, সঙ্গে দু’জন লোক। ভদ্রলোককে একটা স্ট্রেচারে শোয়ানো আছে। ক্ষতস্থানটা
কিরকম নীলচে কালো রঙ হয়ে গোদের মতো ফুলে গেছে। আমাদের রুমালের বাঁধন খোলা হয় নি।
আমরা ভদ্রমহিলাকে সান্তনা দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কোন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জানা গেল
উলুবেড়িয়া হাসপাতাল। ট্রেন এসে গেলে তাঁরা চলে গেলেন। আমরাও উল্টো দিকের ট্রেনে
ফিরে আসলাম।
পরদিন
রবিবার। সোমবার অফিস গিয়ে সঙ্গীদের বললাম, আমাদের সামনে ঘটনাটা ঘটেছে, কাজেই আমাদের একটা দায়িত্ব থেকেই যায়।
ওরা বললো আমার বাড়ি থেকে যেহেতু ভদ্রলোকের বাড়ি খুব বেশী দুরত্ব নয়, তাই আমি অফিস থেকে দুপুরে বেড়িয়ে তাঁর বাড়ি গিয়ে যেন একটু
খোঁজ নেই। আমি এ প্রস্তাবে রাজী হলাম না। কারণ ভদ্রলোক যদি মারা গিয়ে থাকেন, যা কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকের এলাকা দেখে
আসলাম, বিশ্বাস নেই, আমরা ঐ
গ্রামে গেলাম, তাঁর বাড়িতে কড়া নেড়ে
জল খেয়ে আসলাম, আর আমাদের
সামনেই ঘটনাটা ঘটলো। আমরা তাঁর সেবা করার নাম করে বাণ মেরেছি
বলে ধারণা হয়ে থাকলে যথেষ্ট বিপদের সম্ভাবনা আছে।
শেষ
পর্যন্ত উলুবেড়িয়া হাসপাতালে ফোন করলাম। প্রথমে এক ভদ্রলোক ফোনটা ধরে কথা শুরু
করার সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা নামিয়ে রাখলেন। কিছুক্ষণ পরে আবার ফোন করতে এক ভদ্রমহিলা
ধরলেন। আমি প্রথমেই বললাম, দয়া করে ফোনটা কাটবেন না, আমার একটা ব্যাপার জানার ছিল। তাঁকে
মোটামুটি ভদ্রলোক কোথা থেকে গেছেন, কখন গেছেন
ইত্যাদি বলার পর তিনি বললেন, “পেশেন্টের নাম কী, কত নম্বর বেড”? আমি সমস্ত ঘটনা জানিয়ে বললাম আমি কিছুই জানি না, তবে আমার একটা দায়িত্ব থেকেই যায়, তাই তিনি কেমন আছেন জানতে চাইছি। ভদ্রমহিলা
আমাক ফোনটা ধরে থাকতে বললেন।
বেশ
কিছুক্ষণ পরে তিনি জানালেন যে, ভদ্রলোককে অবজার্ভেশনে রাখা হয়েছিল। এখন চিকিৎসা চলছে তবে তিনি
এখন সম্পূর্ণ বিপদ মুক্ত। কথাটা শুনে খুশী ও নিশ্চিন্ত হলেও, সাহস করে তাঁকে কিন্তু দেখতে যেতে পারি নি।